লিথুয়ানিয়াকে ঘিরে মুখোমুখি রাশিয়া-পশ্চিমা বিশ্ব

আন্তর্জাতিক ডেস্ক

ইউক্রেনে অব্যাহত রয়েছে রাশিয়ার হামলা। প্রতিদিনই দুই দেশের সামরিক বাহিনীর সদস্যসহ শত শত মানুষের প্রাণ যাচ্ছে। গতকালও খারকিভে রাশিয়ার হামলায় ১৫ জন নিহত হয়েছে। এই যুদ্ধেই বিশ্ব যখন খাদ্যসংকটের মুখে তখন নতুন করে লিথুয়ানিয়াকে কেন্দ্র করে পশ্চিমা বিশ্বের সঙ্গে মুখোমুখি অবস্থানে রাশিয়া। কিছু আন্তর্জাতিক সংবাদমাধ্যমে আশঙ্কা করা হচ্ছে, লিথুয়ানিয়াকে রাশিয়ার হুমকি এবং পশ্চিমা বিশ্ব লিথুয়ানিয়াকে যেভাবে জোর সমর্থন দিচ্ছে তাতে দুই পরাশক্তির মধ্যে সংঘাত বেধে যেতে পারে। আর সেটি বাস্তবে রূপ নিলে বিশ্বে ভয়াবহ পরিস্থিতি সৃষ্টির আশঙ্কা আছে।

যে কারণে বিরোধ

রাশিয়ার জাতীয় নিরাপত্তার জন্য কালিনিনগ্রাদ কৌশলগতভাবে অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ এক ভূখণ্ড। এই ভূখণ্ডটি রাশিয়া ১৯৪৫ সালে দখল করে নেয়। রাশিয়ার মূল ভূখণ্ডের সঙ্গে কালিনিনগ্রাদের স্থলপথে কোনো সংযোগ নেই। রুশ এই ভূখণ্ড ইউরোপীয় ইউনিয়নের কয়েকটি দেশ ঘিরে রেখেছে। রাশিয়ার বাল্টিক নৌবহরের সদর দপ্তর এই কালিনিনগ্রাদে। এই নৌবহরে ৬০ যুদ্ধজাহাজ এবং ১০ হাজার সামরিক বাহিনীর সদস্য রয়েছে। নিয়মিত এই নৌবহর বাল্টিক সাগরে নৌমহড়া দেয়। এর আগে মস্কো সেখানে পরমাণু অস্ত্র বহন করতে সক্ষম এরকম এক ক্ষেপণাস্ত্র ইস্কান্দর ব্যালিস্টিক মিসাইল মোতায়েন করেছিল। সেখানেই পণ্য সরবরাহে বাধা দিচ্ছে সাবেক সোভিয়েত ইউনিয়নের দেশ লিথুয়ানিয়া। দেশটি তার ভেতর দিয়ে রেলপথে কিছু পণ্য রুশ ভূখণ্ড কালিনিনগ্রাদে পরিবহনের ওপর নিষেধাজ্ঞা আরোপ করেছে।

পশ্চিমা সামরিক জোট ন্যাটোর সদস্য লিথুয়ানিয়ায় কর্তৃপক্ষ গত সপ্তাহে ঘোষণা করে, ইউরোপীয় ইউনিয়ন (ইইউ) যেসব পণ্যের ওপর নিষেধাজ্ঞা আরোপ করেছে সেসব পণ্য তারা তাদের ভূখণ্ডের ভেতর দিয়ে কালিনিনগ্রাদে নিয়ে যাওয়ার অনুমতি দেবে না। রাশিয়ার হুমকি সত্ত্বেও সেটি গতকাল পর্যন্ত অব্যাহত ছিল।

লিথুয়ানিয়ার পররাষ্ট্রমন্ত্রী গ্যাব্রিয়েলিয়াস ল্যান্ডসবার্গিস বলেছেন, এখানে লিথুয়ানিয়া নিজেরা কিছু করছে না। এই নিষেধাজ্ঞা আরোপ করেছে ইইউ যা গত ১৭ জুন থেকে কার্যকর হওয়া শুরু হয়েছে। তিনি বলেন, ইউরোপিয়ান কমিশনের সঙ্গে আলোচনা করে এই কমিশনের গাইডলাইন অনুসারেই এই সিদ্ধান্ত নেওয়া হয়েছে।

ইউরোপীয় ইউনিয়ন যেসব পণ্যের ওপর নিষেধাজ্ঞার আরোপ করেছে তার মধ্যে রয়েছে কয়লা, ধাতব পদার্থ, নির্মাণসামগ্রী এবং অত্যাধুনিক প্রযুক্তি। কিন্তু রাশিয়া বলছে যে, এধরনের নিষেধাজ্ঞার মাধ্যমে আন্তর্জাতিক আইন ভঙ্গ করা হয়েছে।

কালিনিনগ্রাদ অঞ্চলের গভর্নর আন্তন আলিখানভ বলেছেন, কালিনিনগ্রাদ যেসব পণ্য আমদানি করে তার ৫০ শতাংশ এই নিষেধাজ্ঞার আওতায় পড়বে। গভর্নর বলেন, আমরা মনে করি, কালিনিনগ্রাদের মুক্তভাবে পণ্য আমদানি ও রপ্তানির যে অধিকার রয়েছে এই নিষেধাজ্ঞা তার গুরুতর লঙ্ঘন।

রাশিয়ার কড়া হুমকি

লিথুয়ানিয়ার এই সিদ্ধান্তের পরই রুশ পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয় মস্কোতে ইইউর রাষ্ট্রদূত মারকাস এডেরারকে তলব করে। তিনি বলেন, যেসব পণ্যের ওপর নিষেধাজ্ঞা আরোপ করা হয়নি সেগুলো কালিনিনগ্রাদে নিয়ে যাওয়ার অনুমতি দেওয়া হচ্ছে। রুশ সচিবালয় ক্রেমলিন বলছে, লিথুয়ানিয়ার এই সিদ্ধান্ত নজিরবিহীন এবং বেআইনি। তারা বলছে, এটি শত্রুতামূলক আচরণ এবং লিথুয়ানিয়াকে অবশ্যই এই সিদ্ধান্ত বাতিল করতে হবে।

রুশ পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয় বলছে, কালিনিনগ্রাদ এবং রুশ ফেডারেশনের বাকি অংশের সঙ্গে মালবাহী রেল চলাচল সম্পূর্ণভাবে শুরু করা না হলে জাতীয় স্বার্থ রক্ষার জন্য রাশিয়ার পদক্ষেপ গ্রহণের অধিকার রয়েছে। তবে কী ধরনের পদক্ষেপ নেওয়া হতে পারে এবং কখন সেসব ব্যবস্থ নেওয়া হবে সে বিষয়ে রাশিয়ার পক্ষ থেকে কিছু বলা হয়নি।

বিবিসির রাশিয়া বিষয়ক সম্পাদক স্টিভ রোজেনবার্গ বলছেন, লিথুয়ানিয়ার এই সিদ্ধান্তে রুশ কর্মকর্তারা অত্যন্ত ক্রুদ্ধ। তারা এটিকে রাশিয়ার বিরুদ্ধে অবরোধ আরোপের মতো ঘটনা হিসেবেই দেখছেন।

রুশ প্রেসিডেন্ট ভ্লাদিমির পুতিনের একজন মুখপাত্র দিমিত্রি পেসকভ সোমবার বলেছেন, ‘পরিস্থিতি আসলেই গুরুতর এবং যে কোনো ব্যবস্থা কিংবা সিদ্ধান্ত নেওয়ার আগে গভীর বিশ্লেষণের প্রয়োজন। আগামী কয়েক দিন ধরে বিষয়টি বিশ্লেষণ করে দেখা হবে।’

তার একদিন পর মঙ্গলবার প্রেসিডেন্ট পুতিনের একজন ঘনিষ্ঠ মিত্র নিকোলাই পাত্রুশেভ রাশিয়ার উত্তর-পশ্চিমাঞ্চলে জাতীয় নিরাপত্তার বিষয়ে আলোচনার জন্য কালিনিনগ্রাদে গেছেন। রাশিয়ার ক্ষমতাধর নিরাপত্তা পরিষদের সেক্রেটারি পাত্রুশেভ।

বুধবার এক প্রশ্নের জবাবে রুশ পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের মুখপাত্র মারিয়া জাখারভ বলেন, কূটনৈতিক নয়, বাস্তবভিত্তিক হবে। তিনি বলেন, লিথুয়ানিয়া এবং ইইউ যদি কোনো সমাধানে না আসে এবং তাদের পদক্ষেপের পরিবর্তন না ঘটায় তাহলে অবশ্যই যে কোনো পদক্ষেপ নিতে পারে মস্কো এবং কিছু একটা করা মস্কোর জন্য অপরিহার্য। এরই মধ্যে অবসরপ্রাপ্ত রুশ জেনারেল ইভগেনি বুজিনিস্কাই পুতিনকে কালিনিনগ্রাদে পরমাণু অস্ত্র পাঠানোর আহ্বান জানিয়েছেন। তিনি বলেন, পশ্চিমারা আগুন নিয়ে খেলছে।

লিথুয়ানিয়াকে পশ্চিমা বিশ্বের জোর সমর্থন

রাশিয়ার হুমকি মোকাবিলায় প্রস্তুত লিথুয়ানিয়া। তবে দেশটির প্রেসিডেন্ট আশা করছেন, রাশিয়া সামরিক কোনো পদক্ষেপ নেবে না। তবে মস্কো বিদ্যুৎ সংযোগ বিচ্ছিন্ন করলে সেজন্য তারা প্রস্তুত আছে বলে জানিয়েছেন। ইইউর পররাষ্ট্রনীতি বিষয়ক প্রধান জোসেফ বোরেল লিথুয়ানিয়াকে সমর্থন জানিয়ে বলেছেন, তিনি রাশিয়া হুমকির ঘটনায় উদ্বিগ্ন। তিনি দাবি করেন, লিথুয়ানিয়া এককভাবে কোনো পদক্ষেপ নেয়নি, বরং ইইউর নিষেধাজ্ঞাই দেশটি বাস্তবায়ন করছে। তার মতে, রাশিয়ার লিথুয়ানিয়াকে এককভাবে দায়ী করা একটা প্রপাগান্ডা।

ইউক্রেন ইইউ এবং ন্যাটোর সদস্য নয়। ফলে ইউক্রেন যুদ্ধে সরাসরি জড়ায়নি ন্যাটো। কিন্তু লিথুয়ানিয়া ন্যাটোর সদস্য। ফলে লিথুয়ানিয়ার ওপর কোনো ধরনের হামলা হলে রাশিয়া ন্যাটোর সঙ্গে সরাসরি সংঘাতে জড়িয়ে পড়তে পারে।

ইতিমধ্যে ন্যাটোর সদস্য রাষ্ট্রগুলো বলেছে, তারা রাশিয়ার হুমকি মোকাবিলায় লিথুয়ানিয়ার পাশে দাঁড়াবে। মার্কিন পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের মুখপাত্র নেড প্রাইস বলেছেন, লিথুয়ানিয়া ন্যাটো জোটের সদস্য। আমরা ন্যাটোর অঙ্গীকার অনুযায়ী, অবশ্যই সব সদস্য রাষ্ট্রের পাশে দাঁড়াব। তিনি বলেন, ন্যাটোর গুরুত্বপূর্ণ অংশীদার লিথুয়ানিয়ার পাশে আছে যুক্তরাষ্ট্র। নেড প্রাইস কালিনিনগ্রাদে পণ্য সরবরাহে লিথুয়ানিয়ার বাধা দেওয়ার পদক্ষেপকে সমর্থন দেন।

ব্রিটিশ পররাষ্ট্রমন্ত্রী লিজ ট্রাস লিথুয়ানিয়ার পদক্ষেপকে সমর্থন করে জানান, কালিনিনগ্রাদে রাশিয়ার পণ্য পৌঁছাতে যে বাধা লিথুয়ানিয়া দিচ্ছে তাকে পুরোপুরি সমর্থন করে তার দেশ। রাশিয়ার হুমকির বিরুদ্ধে সবাইকে ঐক্যবদ্ধ ও শক্তিশালী অবস্থান নিতে হবে বলেও উল্লেখ করেন লিজ ট্রাস।

ফিনল্যান্ডের সশস্ত্র বাহিনীর প্রধান জেনারেল টিমো কিভিনেন বলেছেন, লিথুয়ানিয়াকে কেন্দ্র করে তারা সম্ভাব্য যুদ্ধের প্রস্তুতি নিচ্ছে। তার মতে, লিথুয়ানিয়ার ওপর হামলা হলে পুরো ন্যাটো জোট এগিয়ে আসবে এবং এতে তৃতীয় বিশ্বযুদ্ধ বেধে যাওয়ার আশঙ্কা আছে। ফিনল্যান্ড ইতিমধ্যে ন্যাটোর সদস্য হওয়ার আবেদন করেছে। সাবেক সোভিয়েত ইউনিয়নের সঙ্গে দুটি যুদ্ধ করেছে ফিনল্যান্ড। এতে ১ লাখের বেশি ফিনিশ নিহত হয়েছে। দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের পর থেকে ফিনল্যান্ড রাশিয়ার বিরুদ্ধে যুদ্ধের জন্য ব্যাপক সামরিক প্রস্তুতি গ্রহণ শুরু করে।

ব্লু বে অ্যাসেট ম্যানেজমেন্টের জ্যেষ্ঠ সার্বভৌম কৌঁসুলি টিমোথি অ্যাশের মতে, কালিনিনগ্রাদ রাশিয়ার জন্য খুবই গুরুত্বপূর্ণ। ফলে তারা যে একটা প্রতিক্রিয়া দেখাবে সেটা নিশ্চিত। তবে সেই প্রতিক্রিয়াটা সামরিক হয় কি না, সেটাই আতঙ্কের।

তিনি বলেন, প্রেসিডেন্ট পুতিন জানেন যে, লিথুয়ানিয়ায় হামলার অর্থ হচ্ছে ন্যাটোর ওপর হামলা। ন্যাটোর আর্টিকেল ৫ অনুযায়ী, ন্যাটো কোনো দেশের ওপর হামলার অর্থ হচ্ছে পুরো জোটের ওপর হামলা।

অ্যাশ বলছেন, যেখানে ইউক্রেনে যুদ্ধে রাশিয়া হিমশিম খাচ্ছে সেখানে কী লিথুয়ানিয়ায় হামলার ঝুঁকি পুতিন নেবেন কি না, সেটাও একটা প্রশ্ন। তবে বেলারুশের মাধ্যমে রাশিয়া হামলা চালাতে পারে। আবার বাল্টিক সাগরে অবরোধ আরোপ করে লিথুয়ানিয়ার পণ্য সরবরাহে বাধা দিতে পারে রাশিয়া। এর ফলে ন্যাটো এবং ইইউর সঙ্গে রাশিয়ার সংঘাত বাধার আশঙ্কা আছে বলে মনে করেন অ্যাশ।

সূত্র : বিবিসি ও উইওন টিভি

শেয়ার করুন