দেশের তিনটি বিশ্ব ঐতিহ্যের মধ্যে দুটিই অবস্থিত বাগেরহাটে। একদিকে অপার সৌন্দর্যের সুন্দরবন, অন্যদিকে ঐতিহাসিক ষাটগম্বুজ মসজিদ। রয়েছে ইউনেসকো ঘোষিত ১৭টি স্থাপনা। পদ্মা সেতু চালু হওয়ায় বাগেরহাটের পর্যটনশিল্পে ইতোমধ্যে বইতে শুরু করেছে সুবাতাস।
পদ্মা সেতুর ফলে ঢাকা থেকে তিন থেকে সাড়ে তিন ঘণ্টায় আসা সম্ভব হবে বাগেরহাটে। এতে বাগেরহাটে এত দিন যারা পথের দূরত্ব ও ভোগান্তি অনুভব করতেন, তারা কম সময়ের মধ্যে পৌঁছে যাবেন প্রাকৃতিক ভূস্বর্গের এ জেলায়।
জানা যায়, ২০২১-২২ অর্থবছরে সুন্দরবনের বাগেরহাট অংশে পর্যটক এসেছেন ১ লাখ ২০ হাজার জন। এতে রাজস্ব আয় এসেছে ১ কোটি ২৫ লাখ টাকা। অন্যদিকে বাগেরহাটের প্রাণকেন্দ্রে অবস্থিত ষাটগম্বুজ মসজিদে এসেছেন ১ লাখ ৮০ হাজার দর্শনার্থী। রাজস্ব আয় হয়েছে ৬০ লাখ টাকা। পদ্মা সেতু চালু হলে এই সংখ্যা কয়েক গুণ বেড়ে যাবে বলে মনে করেন সংশ্লিষ্টরা।
পর্যটনশিল্পের সঙ্গে জড়িত ব্যবসায়ীরা বলছেন, বাগেরহাটে প্রবেশ ও বের হওয়ার জন্য যাতায়াতের প্রধান ব্যবস্থা হচ্ছে সড়কপথ। আর এই সড়কপথে সহজ যোগাযোগব্যবস্থা না থাকায় দুর্ভোগে পড়তে হত মানুষদের। তবে পদ্মা সেতু চালুর মধ্য দিয়ে সেই চিরচেনা চিত্র একেবারেই পাল্টে যাবে। ঘুরে দাঁড়াবে সম্ভাবনাময় বাগেরহাটের পর্যটনশিল্প।
স্থানীয় ট্যুরিস্ট গাইড রাজু আকুঞ্জি বলেন, বিশ্ব ঐতিহ্য ষাটগম্বুজ মসজিদ ও সুন্দরবন বিশ্ব ঐতিহ্যের অংশ। বাগেরহাটে যে পরিমাণ দর্শনার্থী বর্তমানে ঘুরতে আসেন, পদ্মা সেতু হওয়ায় এই সংখ্যা অনেক বেড়ে যাবে। দর্শনার্থী বাড়লে গাইডের প্রয়োজনীয়তাও বাড়বে। ফলে কর্মসংস্থানের সুযোগ সৃষ্টি হবে।
বাগেরহাট খানজাহান আলী (র.) মাজার এলাকার হোটেল ব্যবসায়ী মো. কামরুজ্জামান বলেন, পথের ভোগান্তির কারণে বাগেরহাটে পর্যটকদের আনাগোনা কম থাকে। এ কারণে আর্থিকভাবে ক্ষতিগ্রস্ত হতে হয় হোটেল ব্যবসায়ীদের। পদ্মা সেতু খুলে দিয়েছে। এবার বছরজুড়ে পর্যটকদের আগমন ঘটবে বাগেরহাটে। চাপ থাকবে হোটেল-মোটেলগুলোতেও। নতুন নতুন হোটেল-মোটেল তৈরি হবে। ফলে বাড়বে কর্মসংস্থানের সুযোগও।
ষাটগম্বুজ ইউনিয়ন পরিষদের (ইউপি) চেয়ারম্যান শেখ আক্তারুজ্জামান বাচ্চু বলেন, সেতু চালু হওয়ায় বাগেরহাটসহ গোটা দক্ষিণাঞ্চলে সমৃদ্ধি ফিরে আসবে। নতুন নতুন কর্মসংস্থান সৃষ্টি হবে। বেকারত্ব কমবে। কৃষি, শিল্প, শিক্ষা, স্বাস্থ্য প্রভৃতি ক্ষেত্রে অভাবনীয় অগ্রগতি হবে। এখানে সরকারি-বেসরকারি উদ্যোগে নানা ধরনের প্রতিষ্ঠান গড়ে উঠবে। বিশেষ করে পর্যটনশিল্পের বিকাশ ঘটবে।
সুন্দরবন-সংলগ্ন স্থানীয়রা জানান, সুন্দরবনের কাছেই আমাদের বসবাস। ফলে বনকেন্দ্রিক পর্যটনশিল্পের সঙ্গে আমাদের অনেকেই জড়িত। পদ্মা সেতুর দ্বার উন্মোচনের কারণে পাশাপাশি সুন্দবনের বিভিন্ন পয়েন্টের অবকাঠামো ও যাতায়াতব্যবস্থার উন্নতি হবে। আমাদেরও ব্যবসা-বাণিজ্য ভালো হবে, দর্শনার্থীরাও এসে বেশি আনন্দ পাবে।
বাগেরহাট প্রত্নতত্ত্ব অধিদপ্তরের কাস্টোডিয়ান মো. যায়েদ জানান, ষাটগম্বুজ মসজিদে ২০২১-২২ অর্থবছরে এসেছেন ১ লাখ ৮০ হাজার দর্শনার্থী। রাজস্ব আয় হয়েছে ৬০ লাখ টাকা। তবে পদ্মা সেতু যে অমীত সম্ভাবনা দেখাচ্ছে, তাতে দর্শনার্থীসংখ্যা ধারণার চেয়েও বেশি হবে। এখন স্থানীয়রা দর্শনার্থীদের জন্য থাকা-খাওয়ার ব্যবস্থা (হোম স্টে) করতে পারলে বেশ লাভবান হবে।
এ ছাড়া দর্শনার্থীদের সুবিধার্থে ষাটগম্বুজের সামনের বিশ্রামাগার নির্মাণকাজ সম্পন্ন হয়েছে। পাশাপাশি মসজিদ-সংলগ্ন ঘোড়াদিঘিকে নান্দনিক করতে ওয়াকওয়ে তৈরি করা হয়েছে বলে জানান তিনি।
সুন্দরবন পূর্ব বন বিভাগের বিভাগীয় বন কর্মকর্তা মো. বেলায়েত হোসেন বলেন, ২০২১-২২ অর্থবছরে সুন্দরবনের বাগেরহাট অংশে পর্যটক এসেছেন ১ লাখ ২০ হাজার জন। সরকারের রাজস্ব আয় এসেছে ১ কোটি ২৫ লাখ টাকা। পদ্মা সেতুর ফলে এই সংখ্যা কয়েক গুণ বাড়বে বলে দাবি করেন তিনি। পাশাপাশি সুন্দরবনকে আরও বেশি পর্যটনবান্ধব করে গড়ে তুলতে সুন্দরবনের আলীবান্ধা ও আন্ধারমানিক দুটি পর্যটনকেন্দ্র নির্মাণকাজ চলছে বলে জানান এই কর্মকর্তা।
আগত পর্যটকদের সুবিধার্থে পর্যটন করপোরেশনের অর্থায়নে ১২ কোটি ৭৭ লাখ ৬ হাজার টাকা ব্যয়ে বাগেরহাটের ষাটগম্বুজ ইউনিয়নে একটি তিন তারকা মানের হোটেল নির্মাণের কাজ চলছে বলে জানান বাগেরহাট জেলা প্রশাসক মো. আজিজুর রহমান।
তিনি বলেন, প্রায় ৮০ ভাগ কাজ ইতমধ্যে শেষ হয়েছে। বাগেরহাটে দর্শনীয় অসংখ্যা স্থাপনা রয়েছে। পদ্মা সেতুর হাত ধরে অচিরেই বাগেরহাটের পর্যটনশিল্প দারুণভাবে বিকাশিত হবে।