পদ্মা সেতুর দুই প্রান্তের উদ্বোধনে যা যা হলো

মত ও পথ ডেস্ক

পদ্মা সেতু উদ্বোধন করছেন প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা
পদ্মা সেতু উদ্বোধন করছেন প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা

পদ্মা সেতুর উদ্বোধন হয়েছে। প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা নিজেদের সক্ষমতার প্রতীক পদ্মা সেতুর উদ্বোধন করেন। সেতু উদ্বোধনে উচ্ছ্বাসে ভাসছেন দুই পারের বাসিন্দারা। সেতু চালুর মধ্য দিয়ে খুলে গেল দক্ষিণ ও দক্ষিণ-পশ্চিমাঞ্চলের ২১টি জেলার সঙ্গে রাজধানী ঢাকাসহ দেশের অপরাপর অংশের সংযোগ, যোগাযোগ এবং সম্ভাবনার অনন্ত দুয়ার।

৬ দশমিক ১৫ কিলোমিটার দীর্ঘ এই সেতুর উদ্বোধন উপলক্ষে মাওয়া থেকে জাজিরা—দুই প্রান্তেই আয়োজন করা হয় বিশেষ অনুষ্ঠানের। মাওয়া প্রান্তের সুধী সমাবেশ দিয়ে শুরু, মাওয়া ও জাজিরা প্রান্তে উদ্বোধনের আনুষ্ঠানিকতা এবং শিবচরের কাঁঠালবাড়িতে জনসমাবেশের মধ্য দিয়ে শেষ হয় উদ্বোধনী পর্ব। সমাবেশে কয়েক লাখ মানুষ অংশ নেন।

universel cardiac hospital

পদ্মা সেতুর উদ্বোধন উপলক্ষে মাওয়া প্রান্তে আয়োজন করা হয় সুধী সমাবেশের। সকাল নয়টার আগে থেকেই সুধী সমাবেশে আমন্ত্রিত অতিথিরা মাওয়া প্রান্তের অনুষ্ঠানস্থলে আসতে শুরু করেন। ১০টার আগেই আসন গ্রহণ করেন অতিথিরা।

সুধী সমাবেশে সরকারের মন্ত্রী, স্পিকার, রাজনীতিবিদ, কূটনৈতিক, শিক্ষাবিদসহ বিশিষ্টজনেরা অংশ নেন। ১০টায় অনুষ্ঠানস্থলে পৌঁছান প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা।

অনুষ্ঠানে শুভেচ্ছা বক্তব্য দেন মন্ত্রিপরিষদ সচিব খন্দকার আনোয়ারুল ইসলাম। সভাপতির বক্তব্য দেন সড়ক পরিবহন ও সেতুমন্ত্রী ওবায়দুল কাদের। অনুষ্ঠানে শিল্পকলা একাডেমি ও পদ্মা বহুমুখী সেতু কর্তৃপক্ষ নির্মিত থিম সং পরিবেশন করা হয়। চলচিত্র ও প্রকাশনা অধিদপ্তর এবং পদ্মা বহুমুখী সেতু কর্তৃপক্ষ নির্মিত প্রামাণ্যচিত্র প্রদর্শন করা হয়।

সুধী সমাবেশের বক্তব্যে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা বলেন, অনেক বাধাবিপত্তি উপেক্ষা করে, ষড়যন্ত্রের জাল ছিঁড়ে আজ পদ্মা সেতু উদ্বোধন করা হয়েছে। এই সেতু শুধু সেতু নয়, শুধু ইট-সিমেন্ট-কংক্রিটের কাঠামো নয়, এই সেতু আমাদের অহংকার, আমাদের গর্ব। সক্ষমতার, মর্যাদার প্রতীক।

তিনি পাশে থাকায় বাংলাদেশের জনগণের প্রতি কৃতজ্ঞতা জানান। পদ্মা সেতুর উদ্বোধনের ঐতিহাসিক দিনে যার যার অবস্থান থেকে দেশ ও দেশের মানুষের কল্যাণে কাজ করার শপথ নেওয়ার আহ্বান জানান প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা।

দেশের নিজস্ব অর্থায়নে নির্মিত পদ্মা সেতু প্রকল্পের জমকালো উদ্বোধন উপলক্ষে প্রধানমন্ত্রী স্মারক ডাকটিকিট, স্যুভেনির শিট, উদ্বোধনী খাম এবং বিশেষ সিলমোহর উন্মোচন করেন। এ সময় মঞ্চে ডাক ও টেলিযোগাযোগমন্ত্রী মোস্তাফা জব্বার, ডাকসচিব খলিলুর রহমান এবং ডাক অধিদপ্তরের মহাপরিচালক ফয়জুল আজিম উপস্থিত ছিলেন।

এরপর পদ্মা সেতু উদ্বোধন উপলক্ষে বাংলাদেশ ব্যাংকের ১০০ টাকার বিশেষ স্মারক নোট উন্মোচন করেন। এ সময় বাংলাদেশ ব্যাংকের গভর্নর ফজলে কবির উপস্থিত ছিলেন। প্রধানমন্ত্রী মঞ্চে সেতু–সংশ্লিষ্ট ব্যক্তিদের সঙ্গে ছবি তোলেন।

সুধী সমাবেশস্থল থেকে প্রধানমন্ত্রীর গাড়িবহর মাওয়া প্রান্তের সেতুর ফলকের স্থানে এগোতে থাকে। প্রথম যাত্রী হিসেবে টোল দিয়ে পদ্মা সেতু পাড়ি দেন প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা। বেলা ১১টা ৪৮ মিনিটে পদ্মা সেতুর মাওয়া প্রান্তে প্রধানমন্ত্রী নিজ হাতে টোল দেন। এরপর তাঁর গাড়িবহর সেতু উদ্বোধনের জন্য ফলকের স্থানে যায়।

প্রধানমন্ত্রীসহ অতিথিরা গাড়ি থেকে নামেন। সেখানে প্রথমে মোনাজাত করা হয়। মন্ত্রিপরিষদ সচিব খন্দকার আনোয়ারুল ইসলাম মোনাজাত পরিচালনা করেন। দুপুর ১২টার একটু আগে সুইচ টিপে সেতুর ফলক উন্মোচন করেন তিনি। সেতু উদ্বোধনের সময় প্রধানমন্ত্রীর সঙ্গে ছিলেন সড়ক পরিবহন ও সেতুমন্ত্রী ওবায়দুল কাদের, প্রধানমন্ত্রীর অর্থনৈতিক উপদেষ্টা মশিউর রহমান, সাবেক যোগাযোগমন্ত্রী সৈয়দ আবুল হোসেন, সাবেক সেতুসচিব মোশাররফ হোসেন ভূঁইয়া প্রমুখ। প্রধানমন্ত্রীর মেয়ে সায়মা ওয়াজেদও এ সময় সঙ্গে ছিলেন।

প্রধানমন্ত্রী সেতুর ফলক উন্মোচনের পাশাপাশি ফলকের স্থানে নির্মিত বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান ও তাঁর ম্যুরাল উদ্বোধন করেন। এ সময় আকাশে রঙিন ধোঁয়া ওড়ানো হয়। প্রধানমন্ত্রী নিজে ‘জয় বাংলা, জয় বঙ্গবন্ধু’ স্লোগান দেন। উপস্থিত সবাই হাততালি দেন।

উদ্বোধনের পর প্রধানমন্ত্রী গাড়িবহর নিয়ে মাওয়া পয়েন্ট থেকে শরীয়তপুরের জাজিরা পয়েন্টের উদ্দেশে যাত্রা শুরু করেন। এ সময় মন্ত্রিপরিষদের সদস্য, আওয়ামী লীগের জ্যেষ্ঠ নেতা ও সংশ্লিষ্ট কর্মকর্তারা সঙ্গে ছিলেন। কাল রোববার সকাল থেকে টোল দিয়ে সাধারণ যানবাহন চলাচল শুরু করবে সেতু দিয়ে।

জাজিরার দিকে যাওয়ার পথে দুপুর ১২টা ১২ মিনিটের দিকে গাড়ি থামিয়ে নেমে যান প্রধানমন্ত্রী। প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা যখন পদ্মা সেতু অতিক্রম করেন, তখন বিমানবাহিনীর ছয়টি হেলিকপ্টার তাঁকে অভিবাদন জানায়। পদ্মা সেতুতে দাঁড়িয়ে তিনি বিমানবাহিনীর মহড়া দেখেন।

এরপর দুপুর ১২টা ২৬ মিনিটের দিকে তিনি আবার গাড়িতে ওঠেন। সেখান থেকে তিনি জাজিরা প্রান্তে পৌঁছান। জাজিরা প্রান্তেও দুপুর ১২টা ৩৮ মিনিটের দিকে ফলক উদ্বোধন করেন প্রধানমন্ত্রী। এর আগে সেখানে মোনাজাত হয়।

বেলা ১১টা ৫০ মিনিটে মাদারীপুরের শিবচর উপজেলার কাঁঠালবাড়িতে অবস্থিত জনসভার মঞ্চ থেকে আওয়ামী লীগের প্রেসিডিয়াম সদস্য জাহাঙ্গীর কবির নানক ঘোষণা দেন, পদ্মা সেতু উদ্বোধন করেছেন প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা। তিনি মুন্সিগঞ্জের মাওয়া প্রান্ত থেকে সেতু পেরিয়ে জাজিরার দিকে আসছেন। এমন ঘোষণার পর জাজিরা ও শিবচর প্রান্তে থাকা লাখো জনতা উল্লাসে ফেটে পড়েন। তরুণেরা মিছিল করেন, বাঁশি বাজিয়ে আনন্দ করতে থাকেন। আনন্দ মিছিল করেছেন আওয়ামী লীগের নেতাকর্মীরা।

মাওয়া প্রান্তে উদ্বোধনের পর পদ্মা সেতু পাড়ি দিয়ে জাজিরা প্রান্তে যান প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা। দুপুর সাড়ে ১২টার দিকে প্রধানমন্ত্রী জাজিরা প্রান্তে সেতুর ফলক উন্মোচন করেন। প্রধানমন্ত্রীর গাড়িবহর দুপুর সাড়ে ১২টার দিকে জাজিরা প্রান্তে পৌঁছায়। সেখানে মোনাজাত হয়। এরপর ‘পিতা ও কন্যা থিম’–এর ম্যুরাল-২ ও সেতুর ফলক উন্মোচন করেন প্রধানমন্ত্রী।

প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা পদ্মা সেতুর মুন্সিগঞ্জের মাওয়া প্রান্ত ও জাজিরার নাওডোবা প্রান্তের উদ্বোধন কার্যক্রম শেষে কাঁঠালবাড়ির জনসভাস্থলে পৌঁছান। এরপর মঞ্চে বাজানো হয় বাংলাদেশের লোকগানের উজ্জ্বল নক্ষত্র শিল্পী আবদুল আলীমের ‘সর্বনাশা পদ্মা নদী’ গানটি।

এরপর বাজানো হয় ‘ও নদীরে, একটি কথা সুধাই শুধু তোমারে’ গানটি। এরপর আওয়ামী লীগের নেতা-কর্মীদের ‘জয় বাংলা’ স্লোগানে জনসভাস্থল মুখরিত হয়ে ওঠে।

বিমানবাহিনীর হেলিকপ্টারগুলো কাঁঠালবাড়ি ঘাটে মঞ্চের ওপর দিয়ে চক্কর দেয়। আরেকটি হেলিকপ্টার থেকে ফুল ছিটিয়ে জনসভায় আসা লোকজনকে অভিবাদন জানানো হয়।

মাদারীপুরের কাঁঠালবাড়িতে দুপুর ১২টায় পদ্মা সেতুর উদ্বোধন উপলক্ষে সমাবেশ শুরু হয়। ভোরের আলো ফুটতে না ফুটতেই সাধারণ মানুষের পদচারণে মুখর হয়ে ওঠে জনসভাস্থল। দক্ষিণের নানা প্রান্ত থেকে দলে দলে মানুষ আসেন সমাবেশস্থলে। বাস, ট্রাক, মোটরসাইকেল—যে যেভাবে পারেন, দূরদূরান্ত থেকে ছুটে আসেন। নানা রঙের টি-শার্ট তাঁদের গায়ে। ঢাক, ঢোল ও বাঁশি বাজিয়ে আসেন তারা।

নাচতে নাচতে, মিছিল করতে করতে আসেন তারা। অনেকের হাতে ছিল ব্যানার ও ফেস্টুন। আওয়ামী লীগের নেতাকর্মী ও বিভিন্ন শ্রেণিপেশার মানুষে পদ্মার তীরের ছয় কিলোমিটার এলাকা ভরে যায়।

শেয়ার করুন