শিক্ষক লাঞ্ছনা এখন শিক্ষক হত্যায় ঠেকেছে!

র আ ম উবায়দুল মোকতাদির চৌধুরী

শিক্ষক
শিক্ষক। প্রতীকী ছবি

দেশজুড়ে ঢাকার আশুলিয়ার হাজী ইউনুস আলী স্কুল অ্যান্ড কলেজের প্রভাষক উৎপল সরকারকে হত্যা এবং নড়াইলের মির্জাপুর ইউনাইটেড কলেজের অধ্যক্ষ স্বপন কুমার বিশ্বাসকে অপদস্থ করার ঘটনায় নিন্দা ও প্রতিবাদ চলছে। ২৯ জুন রাজধানী ছাড়াও দেশের বিভিন্ন স্থানে বিক্ষোভ, মানববন্ধন ও সমাবেশ হয়েছে। অনেক সামাজিক, রাজনৈতিক, সাংস্কৃতিক ও শিক্ষকদের সংগঠন নিন্দা জানিয়ে বিবৃতি দিয়েছে। এসব বিবৃতিতে দুটি ঘটনায় জড়িতদের দ্রুত আইনের আওতায় এনে দৃষ্টান্তমূলক শাস্তির দাবি জানানো হয়। কেউ কেউ স্থানীয় প্রশাসনের নির্বিকার ভূমিকা নিয়েও প্রশ্ন তুলেছেন। অবশ্য প্রভাষক উৎপলকে হত্যার মূল অভিযুক্ত বখাটে ছাত্র আশরাফুল ইসলাম জিতুকে গতকাল সন্ধ্যায় গাজীপুর থেকে গ্রেপ্তার করেছে র‌্যাব। এ ছাড়া জিতুর বাবা উজ্জ্বল হোসেনকে গতকাল ৫ দিনের রিমান্ডে পাঠিয়েছেন আদালত।

শিক্ষক (বলা যায়, বিশেষ করে যারা সংখ্যালঘু) লাঞ্ছনা এখন শিক্ষক হত্যায় উপনীত হয়েছে। ছাত্রীদের বখাটে উত্যক্ত করার প্রতিবাদ করলে সাভারে প্রভাষক উৎপল সরকারকে সকলের সামনে পিটিয়ে হত্যা করা হয়েছে। প্রশ্ন জাগে, শিক্ষক হত্যার জন্য কি ১৯৭১ সালে এই বাংলাদেশ স্বাধীন করেছি? ধারণা করা যায়- এই সনাতন ধর্মাবলম্বী শিক্ষকরা আর বেশি দিন থাকবেন না। ১০/২০ বছর পর তাদের সংখ্যা এমনিতেই কমে যাবে। কিন্তু যে কোমলমতী শিক্ষার্থীরা এই কাজগুলো করছে, শিক্ষকদের হত্যা কিংবা আঘাত করছে, গলায় জুতোর মালা পরিয়ে দিচ্ছে, তাদের হাতেই কিন্তু বাংলাদেশের ভবিষ্যৎ! তাহলে সেটা কোন দেশ হবে বলে ধরে নেওয়া যায়?

২০১৩ সালে আমরা দেখেছি পাবনায় একজন ছাত্র তথাকথিত অভিযোগে শিক্ষককে দুই হাতে ইট দিয়ে মাঠের মধ্যে দাঁড় করিয়ে রেখেছিল। সেটা কিন্তু মিডিয়াতে আসেনি। তারপর আমরা ক্রমাগত শ্যামল কান্তির ঘটনা দেখেছি। কিন্তু যে সংসদ সদস্য শিক্ষার্থীদের সামনে তাকে চড় মেরেছিলেন, তাকে কি জবাবদিহিতায় আনা হয়েছিল? হয়নি। তারপর আমরা দেখেছি শিক্ষক হৃদয় মণ্ডলকে। তাকে মারধর করা হয়েছে, জেলে নেওয়া হয়েছে। সেই ঘটনার মধ্যেই দেখলাম আশালতা নামের আরেকজন শিক্ষিকাকে। তার বিরুদ্ধে মিথ্যা অভিযোগ আনা হলো, ছাত্রীরা বোরখা পরেছে বলে তিনি তাদের পিটিয়েছেন। কিন্তু পরে ছাত্রীরাই বলেছেন, আমরা স্কুল ড্রেস পরিনি বলে তিনি বকাঝকা করেছেন। অথচ, সেটিকে সাম্প্রদায়িকরণ করা হয়েছে।

উল্লেখ্য, সম্প্রতি ফেসবুকে ভারতীয় জনতা পার্টির (বিজেপি) নূপুর শর্মার সমর্থনে মির্জাপুর ইউনাইটেড ডিগ্রি কলেজের এক শিক্ষার্থীর পোস্ট দেওয়াকে কেন্দ্র করে গত ১৮ জুন বিক্ষোভ করে শিক্ষার্থীরা। এরপর গুজব ছড়িয়ে পড়ে পোস্ট দেওয়া ওই শিক্ষার্থীর পক্ষ নিয়েছেন কলেজের ভারপ্রাপ্ত অধ্যক্ষ স্বপন কুমার বিশ্বাস। এ ঘটনার পর পুলিশ পাহারায় তাকে ক্যাম্পাসের বাইরে নিয়ে যাওয়া হয়। এসময় তাকে দাঁড় করিয়ে পুলিশের সামনেই গলায় জুতার মালা পরিয়ে হেনস্তা করা হয়। পরে তাকে পুলিশি হেফাজতে নিয়ে যাওয়া হয়। ধরে নিলাম, নূপুর শর্মার ছবি ফেসবুকে শেয়ার করে, তাকে প্রণাম জানিয়ে ছাত্র রাহুল দেব রায় না হয় অপরাধ করেছে। কিন্তু এক্ষেত্রে শিক্ষক স্বপন কুমার বিশ্বাসের অপরাধ কী? কেন শিক্ষককে প্রহার ও জুতার মালা পরানো হলো? এর আসলে কোনো যৌক্তিক কারণ নেই।

আসলে দেশে এত উন্নয়নের সমান্তরালে এসব হচ্ছেটা কী? এখন সংখ্যালঘু সম্প্রদায়ের শিক্ষক ছাত্রদের নড়াচড়া করলেও যেন ধর্ম অবমাননার অভিযোগ আসে। দুর্বল ভেবে তাদের টার্গেট করা হয়- বিষয়টি অত্যন্ত সাংঘাতিক এবং গুরুতর। ২০২২ সালে এসেও সংখ্যালঘু ছাত্র এবং শিক্ষকের ভবিতব্য একই বৃত্তে আবর্তিত হচ্ছে। ঘটনাগুলোর স্বরূপ হয়তো আলাদা। কিন্তু মূলভাব যে একই। আমরা শিক্ষকদের নির্যাতন-নিপীড়ন-হত্যা, অপমান করাসহ বিভিন্ন অত্যাচারের বিরুদ্ধে বিচার বিভাগীয় তদন্তপূর্বক দোষী ব্যক্তিদের দৃষ্টান্তমূলক শাস্তির দাবি জানাই।

লেখক : সংসদ সদস্য, যুদ্ধাহত বীর মুক্তিযোদ্ধা
পঁচাত্তর-পরবর্তী প্রতিরোধ যোদ্ধা
সম্পাদক, মত ও পথ

শেয়ার করুন