বাধ্যতামূলক আয়কর রিটার্ন : পুনর্বিবেচনা প্রয়োজন

নিরঞ্জন রায়

আয়কর রিটার্ন
আয়কর রিটার্ন। নমুনা ছবি

এখন থেকে সরকারি ও বেসরকারি উভয় সংস্থা থেকে অনেক অত্যাবশ্যকীয় সেবা নেওয়ার পূর্বশর্ত হিসেবে জুড়ে দেওয়া হয়েছে আয়কর রিটার্ন দাখিলের বাধ্যবাধকতা। ২০২২-২৩ সালের জন্য ঘোষিত বাজেটে এই সিদ্ধান্ত গৃহীত হয়েছে বলে স্থানীয় পত্রিকায় প্রকাশিত সংবাদ থেকে জানা যায়। অর্থ মন্ত্রণালয় মোট ৩৮ ধরনের সেবাকে নির্ধারণ করে দিয়েছে, যা পেতে হলে জনগণকে বাধ্যতামূলকভাবে আয়কর রিটার্ন দাখিলের প্রমাণপত্র জমা দিতে হবে। দেশে আয়কর রিটার্ন দাখিলের সংখ্যা বৃদ্ধি করার উদ্দেশ্যে এই সিদ্ধান্ত গ্রহণ করা হয়েছে।

সিদ্ধান্তটি আপাতদৃষ্টিতে ভালো মনে হওয়াই স্বাভাবিক। এই সিদ্ধান্তের কারণে দেশে করদাতা বা আয়কর রিটার্ন জমা দেওয়ার সংখ্যা কতটা বৃদ্ধি পাবে, তা হয়তো ভবিষ্যৎ বলতে পারবে। তবে এই সিদ্ধান্তের কারণে যে দেশের মানুষের ভোগান্তি চরমে পৌঁছবে এবং সমাজে এক ধরনের বিশৃঙ্খল অবস্থার সৃষ্টি হবে, তা মোটামুটি নিশ্চিত করেই বলা যায়। এই নির্ধারিত ৩৮ সেবার মধ্যে এমন কিছু সেবা অন্তর্ভুক্ত আছে, যা বর্তমানে অত্যাবশ্যক এবং বেশির ভাগ জনগণ এই সেবা গ্রহণ করে থাকে। ব্যক্তিগত পর্যায় থেকে করপোরেশন পর্যায় এবং দরিদ্র জনগণ থেকে শুরু করে ধনাঢ্য ব্যক্তি—সবাই এসব সেবা গ্রহণ করে থাকে। পাঁচ লাখ টাকা বা তার বেশি পরিমাণ টাকার সঞ্চয়পত্র ক্রয়, স্থায়ী আমানতে জমা রাখা, এমনকি ব্যাংকঋণ গ্রহণের ক্ষেত্রে আয়কর রিটার্ন জমাদানের প্রমাণপত্র বাধ্যতামূলকভাবে দাখিল করতে হবে। জুলাই থেকেই এই সিদ্ধান্ত কার্যকর হবে। অর্থাৎ যারা আয়কর রিটার্ন জমা দেয়নি, তারা চলতি মাস থেকে আর এই সেবা পাবে না। এই আদেশটি এতই কঠোর করে করা হয়েছে যে এর কোনো রকম ব্যত্যয় ঘটলে ১০ লাখ বা তার বেশি টাকা জরিমানা গুনতে হবে। কোনো রকম বিচার-বিশ্লেষণ, আলাপ-আলোচনা এবং সমাজের ক্ষতিকর প্রভাবের কোনো রকম চিন্তা-ভাবনা না করে হঠাৎ করে এ রকম একটি কঠোর সিদ্ধান্ত সরকার কেন গ্রহণ করল, তা আমাদের কাছে মোটেই বোধগম্য নয়। কারণ এই সিদ্ধান্ত গ্রহণের ফলে জনভোগান্তি চরমে পৌঁছবে এবং অনেক ক্ষেত্রে ভয়ংকর স্থবিরতা নেমে আসবে।

universel cardiac hospital

যেকোনো সিদ্ধান্ত গ্রহণের আগে প্রথমে বিবেচনা করা হয় যে সিদ্ধান্তটি বাস্তবায়ন করা যাবে কি না। বাস্তবায়নযোগ্য না হলে যত ভালো সিদ্ধান্তই হোক না কেন, তা গ্রহণ করে কোনো লাভ হয় না। এ রকম সিদ্ধান্ত গ্রহণ করাও যায় না। বেশ কয়েক বছর আগে আমেরিকা ও কানাডার বিভিন্ন শহরের সড়ক দুর্ঘটনায় মৃত্যুহার বেড়ে যাওয়ায় এখানকার কিছু বিশেষজ্ঞ চিকিৎসক গবেষণা করে সড়কের গতি ঘণ্টায় ৬০ কিলোমিটার থেকে কমিয়ে ৪৫ কিলোমিটার করার পক্ষে মতামত দেন। কারণ এতে মৃত্যুহার অর্ধেকে নেমে আসবে। এটি একটি উত্তম ব্যবস্থা হলেও এখানকার নীতিনির্ধারকরা সেই সিদ্ধান্ত গ্রহণ থেকে বিরত থাকেন। কারণ এটি বাস্তবায়ন বা প্রয়োগ করা সম্ভব হবে না। এটি প্রয়োগ করতে গেলে পুলিশ বাহিনীর যে পরিমাণ সদস্য থাকা প্রয়োজন, তা তাঁদের নেই এবং রাখাও সম্ভব নয়। আমাদের দেশে কোনো সিদ্ধান্ত গ্রহণের ক্ষেত্রে তা বাস্তবায়নের দিকটি খুব কমই বিবেচনা করা হয়। আর নির্ধারিত সেবা পেতে আয়কর রিটার্ন দাখিলের প্রমাণপত্র প্রদান বাধ্যতামূলক করার সিদ্ধান্ত গ্রহণের আগে এর বাস্তবায়নের দিকটি যে মোটেই বিবেচনা করা হয়নি, তা মোটামুটি নিশ্চিত করেই বলা যায়। দেশে টিআইএন (ট্যাক্স আইডেনটিফিকেশন নম্বর) আছে মাত্র ৪০ লাখ নাগরিকের আর আয়কর রিটার্ন দাখিল করে মাত্র ২২ লাখ নাগরিক। অথচ দেশের সাত-আট কোটি নাগরিক কোনো না কোনোভাবে এসব সেবা নিয়ে থাকে। এই জুলাই থেকেই এসব সেবা গ্রহণের জন্য আয়কর রিটার্ন দাখিলের প্রমাণপত্র প্রদানের বাধ্যবাধকতা কার্যকর হবে। এটি কিভাবে সম্ভব? জাতীয় রাজস্ব বোর্ড (এনবিআর) চাইলেও তো এত বিপুলসংখ্যক জনগোষ্ঠীর আয়কর রিটার্ন এত স্বল্প সময়ের মধ্যে গ্রহণ করতে পারবে না। এমনকি বিশেষ উদ্যোগ গ্রহণ ব্যতিরেকে আগামী দু-তিন বছরেও সম্ভব নয়। তাহলে যে বিপুলসংখ্যক জনগোষ্ঠী আগে আয়কর রিটার্ন জমা দেয়নি, তারা চাইলেও তো এত অল্প সময়ের মধ্যে আয়কর রিটার্ন জমা দিতে পারবে না এবং তখন তাদের সেবার কী হবে? নতুন সেবার কথা না হয় বাদই দিলাম। চলমান সেবাও তো আটকে যাবে। এ ছাড়া যাদের বার্ষিক আয় করযোগ্য আয়সীমার নিচে, তাদের তো আয়কর রিটার্ন জমাদানের কোনো প্রয়োজনীয়তা নেই। অথচ তারাও এখন এই সিদ্ধান্তের কারণে মারাত্মক সমস্যার সম্মুখীন হবে।

এই সিদ্ধান্তের কারণে সমাজে যে এক ভয়ংকর বিশৃঙ্খল অবস্থার সৃষ্টি হবে তা-ই নয়, সেই সঙ্গে অর্থনীতিতেও পড়বে মারাত্মক নেতিবাচক প্রভাব। নতুন ব্যবসা-বাণিজ্য শুরু করা সম্ভব হবে না। ফলে দেশের জিডিপিতে বেসরকারি খাতের অবদান বৃদ্ধি পাবে না। এমনকি চলমান ব্যবসা-বাণিজ্য নানা রকম সমস্যা ও হয়রানির শিকার হবে। অনেকে ট্রেড লাইসেন্স বা অন্যান্য লাইসেন্স নবায়ন করতে পারবে না। ফলে তাদের ব্যবসা আক্ষরিক অর্থে অবৈধ ব্যবসায় পরিণত হবে। যদি কেউ কোনোভাবে অবৈধ ব্যবসা হিসেবেও পরিচালনা করতে চায়, তা-ও পারা যাবে না। কারণ তাদের ব্যাংকঋণ বা ব্যাংকে গচ্ছিত অর্থ নবায়ন করা সম্ভব হবে না। ফলে দেশের অর্থনীতিতে নেতিবাচক প্রভাব পড়তে বাধ্য। এমনকি দেশের ব্যাংকিং খাতে খেলাপি ঋণের পরিমাণ অস্বাভাবিক হারে বেড়ে যাবে। আয়কর রিটার্ন দাখিলের প্রমাণ জমাদানের অভাবে অনেকের ঋণ সুবিধা নবায়ন করা সম্ভব হবে না। একটি নির্দিষ্ট সময়, বিশেষ করে ৯০ দিন ধরে ঋণ সুবিধা নবায়ন করা না হলে সেই ঋণ খেলাপি বা ক্লাসিফায়েড ঋণে পরিণত হয়। দেশের ব্যাংকিং খাতে খেলাপি ঋণের অবস্থা খুবই খারাপ। এর মধ্যে যদি অর্থ মন্ত্রণালয়ের এ রকম সিদ্ধান্তের কারণে অনেক ভালো ঋণ অকারণে খেলাপি হয়ে যায়, তাহলে খেলাপি ঋণ পরিস্থিতি আরো মারাত্মক আকার ধারণ করবে। আমাদের দেশের অনেক সাধারণ মানুষ এবং অবসরপ্রাপ্ত ব্যক্তিরা সঞ্চয়পত্র ক্রয় করে বা ব্যাংকে গচ্ছিত রেখে তা থেকে যে উপার্জন হয়, তা দিয়ে তাঁদের জীবিকা নির্বাহ করেন। এই অসহায় সাধারণ মানুষ মারাত্মক বিপদের সম্মুখীন হবেন। এমনকি কিছু প্রতিষ্ঠান ও ব্যক্তি ব্যাংকে অর্থ জমা রেখে তার ওপর অর্জিত অর্থ দিয়ে অনেক জনকল্যাণ কাজ করে থাকেন। এই সিদ্ধান্তের কারণে সেসব কাজেও বিঘ্ন সৃষ্টি হবে। এ ছাড়া এই সিদ্ধান্তের কারণে দেশের বেশির ভাগ মানুষের মাঝে তড়িঘড়ি করে আয়কর রিটার্ন দাখিলের প্রবণতা শুরু হয়ে যাবে এবং সেই সুযোগে অনেক দুষ্ট লোক নানা রকম প্রতারণার আশ্রয় নিয়ে সাধারণ মানুষকে সর্বস্বান্ত করতে পারে।

এ কথা অস্বীকার করার উপায় নেই যে দেশে করদাতার সংখ্যা উল্লেখযোগ্য হারে বৃদ্ধি করতে হবে। ১৭ কোটি মানুষের দেশে মাত্র ২২ লাখ লোকের আয়কর রিটার্ন দাখিলের বিষয়টি সত্যি উদ্বেগের ও লজ্জাজনক। এটি কোনোভাবেই মেনে নেওয়া যায় না। বিশেষ করে দেশের মাথাপিছু আয় প্রায় তিন হাজার ডলার ছুঁই ছুঁই, সেখানে এই নগণ্যসংখ্যক করদাতা কোনোভাবেই গ্রহণযোগ্য নয়। সঠিক তথ্য-প্রমাণ না থাকলেও দেশের মানুষের জীবনযাত্রার ধরন দেখে খুব সহজেই অনুমান করা যায় যে দেশে প্রায় চার কোটির বেশি মানুষ এখন কর দিতে সক্ষম। ফলে তাদের আয়করের আওতায় আনার কোনো বিকল্প নেই। এমনকি দেশের প্রত্যেক প্রাপ্তবয়স্ক নাগরিকের জন্য আয়কর রিটার্ন দাখিলের ব্যবস্থা করা প্রয়োজন সবার আগে। উল্লেখ্য, আয়কর রিটার্ন দাখিল এবং আয়কার প্রদান দুটি সম্পূর্ণ ভিন্ন বিষয়। আয়কর রিটার্ন জমা দেবে সবাই, কিন্তু আয়কর প্রদান করবে শুধু তারাই, যাদের আয় করযোগ্য। কিন্তু এটি জোরজবরদস্তির বিষয় নয়। মানুষকে ভয় দেখিয়ে বা বিপদে ফেলে কিছু মানুষকে আয়কর দাখিলে বাধ্য করা গেলেও অধিকসংখ্যক মানুষকে আয়কর রিটার্নের আওতায় আনা সম্ভব হবে না। আধুনিক রাষ্ট্রব্যবস্থায় তেমনটি হওয়া উচিতও নয়। আয়কর রিটার্ন দাখিলে যে বেহাল, তা তো এক দিনে হয়নি, বরং দীর্ঘদিন ধরে জনগণকে আয়কর রিটার্ন দাখিলে উদ্বুদ্ধ করতে না পারার কারণে আজকের এই অবস্থা। তাই দীর্ঘদিনের পুঞ্জীভূত সমস্যা একটি কঠোর সিদ্ধান্ত গ্রহণের মাধ্যমে রাতারাতি সমাধান করা সম্ভব হবে না। এ জন্য দেশের আয়কর রিটার্ন দাখিল পদ্ধতিকে সম্পূর্ণ আধুনিকায়ন করার মাধ্যমে অনলাইন রিটার্ন দাখিলের সুযোগ অবারিত করতে হবে সবার আগে। এনবিআরের প্রচলিত ওয়েবসাইটের মাধ্যমে এই অনলাইন রিটার্ন দাখিল নিশ্চিত করা সম্ভব নয়। এ জন্য প্রয়োজন অধিক মাত্রার পৃথক একটি ব্যাপক ও বিস্তৃত সফটওয়্যার, যা এনবিআরের নিয়ন্ত্রণে থাকবে। সেই সঙ্গে পৃথক আয়কর রিটার্ন সফটওয়্যার তৈরি করতে হবে, যা ব্যবহার করে এনবিআরের সনদপ্রাপ্ত এজেন্টরা গ্রামের প্রত্যন্ত অঞ্চল থেকে সামান্য ফি নিয়ে মানুষের আয়কর রিটার্ন দাখিল করবেন। এভাবে আয়কর রিটার্ন দাখিলের আধুনিকায়ন করে দেশের সব নাগরিককে রিটার্ন দাখিলের আওতায় আনতে হবে সবার আগে। তারপর এই সিদ্ধান্ত বাস্তবায়ন করতে হবে। তা না হলে এক ধরনের লেজে-গোবরে অবস্থার সৃষ্টি হবে এবং সাধারণ মানুষের ভোগান্তি চরমে উঠবে। এর বিরূপ প্রভাবে জনগণের মতামত সরকারের বড় বড় অর্জনের কথা বেমালুম ভুলে গিয়ে সরকারের বিপক্ষে চলে যেতে পারে। ভুলে গেলে চলবে না যে আগামী বছর জাতীয় নির্বাচনের বছর। তাই নির্ধারিত ৩৮ সেবায় আয়কর রিটার্ন দাখিলের বাধ্যবাধকতার সিদ্ধান্ত পুনর্বিবেচনার দাবি রাখে।

লেখক : অ্যান্টি মানি লন্ডারিং স্পেশালিস্ট ও ব্যাংকার, টরন্টো, কানাডা

শেয়ার করুন