সদ্য সমাপ্ত অর্থবছরে(২০২১-২০২২) বাংলাদেশের রপ্তানি বাণিজ্যে রেকর্ড সৃষ্টি হয়েছে। বাংলাদেশের রপ্তানি আয় প্রথমবারের মতো ৫০ বিলিয়ন মার্কিন ডলারের ল্যান্ড মার্ক অতিক্রম করেছে। অর্থবছরের পুরো সময়ে বাংলাদেশ ৫ হাজার ২০৮ কোটি মার্কিন ডলার মূল্যের পণ্য রপ্তানি করেছে। এটা আগের বছরের তুলনায় ৩৪ দশমিক ৩৮ শতাংশ বেশি। এই সময়ে বাংলাদেশ ৪ হাজার ২৬১ কোটি মার্কিন ডলারের তৈরি পোশাক রপ্তানি করেছে। রপ্তানি বাণিজ্যে তৈরি পোশাক সামগ্রির এই তেজি ভাবের কারণেই মূলত সার্বিক রপ্তানি আয়ের ক্ষেত্রে রেকর্ড সৃষ্টি হয়েছে। মোট রপ্তানি আয়ে তৈরি পোশাক সামগ্রির অবদান ৯০ শতাংশেরও বেশি।
তৈরি পোশাক শিল্প মালিকদের সংগঠন বিজিএমইএ ২০৩০ সালের মধ্যে তৈরি পোশাক রপ্তানির পরিমাণ ১০০ বিলিয়ন মার্কিন ডলারে উন্নীত করার পরিকল্পনা করেছে। অর্থাৎ আগামী ৯ বছরে তৈরি পোশাক রপ্তানির সার্বিক পরিমাণ ৫ হাজার ৭৮৪ কোটি মার্কিন ডলার বাড়ানো হবে। একই সময়ে তৈরি পোশাক শিল্পে কর্মসংস্থান ৬০ লাখে উন্নীত করা হবে। ২০২০ সালে বিশ্ব বাজারে বাংলাদেশের তৈরি পোশাকের অংশিদারিত্ব ছিল ৬ দশমিক ২৬ শতাংশ। ২০২১ সালে তা ৭ শতাংশে উন্নীত হয়েছে। ২০২৫ সালের মধ্যে বিশ্ববাজারে বাংলাদেশের তৈরি পোশাক সামগ্রির অংশিদারিত্বের হার দাঁড়াবে ১০ শতাংশে। বিদায়ী অর্থবছরে তৈরি পোশাক ছাড়াও হোম টেক্সটাইল, চামড়া ও চামড়াজাত দ্রব্য, কৃষি প্রক্রিয়য়াজাত পণ্য, পাট ও পাটজাত পণ্য খাত থেকে রপ্তানি আয় হয়েছে ১০০ কোটি মার্কিন ডলারের বেশি। বাংলাদেশের ইতিহাসে আর কখনোই একসঙ্গে পাঁচটি খাতে ১০০ কোটি মার্কিন ডলারের বেশি রপ্তানি আয় করতে পারেনি।
বাংলাদেশ গত অর্থবছরে রেকর্ড পরিমাণ রপ্তানি আয় করেছে এটা যে কোনো বিচারেই উল্লেখের দাবি রাখে। বিশেষ করে করোনার অতিমারি এবং রুশ-ইউক্রেন যুদ্ধের কারণে যখন বিশ্ব অর্থনীতি মারাত্মকভাবে বিপন্ন হয়ে পড়ার উপক্রম হয়েছে। এমন এক অবস্থায় বাংলাদেশের রপ্তানি এভাবে বৃদ্ধি পাওয়াটা অবশ্যই ইতিবাচক। কিন্তু প্রশ্ন হলো, করোনার প্রকোপ সত্বেও রপ্তানি আয়ের ক্ষেত্রে এমন রেকর্ড সৃষ্টি হলো কীভাবে? বাংলাদেশি উদ্যোক্তারা বেশি পরিমাণ পণ্য উৎপাদন ও রপ্তানি করার কারণেই এমন রেকর্ড সৃষ্টি হয়েছে সরলভাবে তা ভাবার কোনো অবকাশ নেই।
করোনা উত্তর বিশ্ব অর্থনীতি যখন পুনরুদ্ধার প্রক্রিয়ার মধ্যে ছিল ঠিক তখনই শুরু হয় রুশ-ইউক্রেন যুদ্ধ। মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র এবং তার মিত্র দেশগুলো ভেবেছিল, অর্থনতিক অবরোধ আরাপ করে রাশিয়াকে খুব সহজেই ঘায়েল করা যাবে। কিন্তু বাস্তবে তা হয়নি। যুদ্ধের কারণে বরং রাশিয়ার অর্থনীতি আরো শক্তিশালি হয়েছে। রাশিয়ার জ্বালানি তেল এবং গ্যাসের উপর ইউরোপীয় ইউনিয়নের বেশির ভাগ দেশই ব্যাপক মাত্রায় নির্ভরশীল। রাশিয়া শর্ত দিয়েছে যে, তাদের দেশ থেকে জ্বালানি তেল এবং গ্যাস আমদানি করতে হলে রুবলের মাধ্যমে মূল্য পরিশোধ করতে হবে। অধিকাংশ দেশই রাশিয়ার এই শর্ত মেনে নিতে বাধ্য হয়েছে। ফলে রাশিয়ান মুদ্রা রুবলের বিনিময় হার স্মরণকালের মধ্যে সর্বোচ্চ পর্যায়ে উন্নীত হয়েছে। এদিকে রাশিয়া এবং ইউক্রেন থেকে খাদ্য পণ্য রপ্তানি কার্যত বন্ধ রয়েছে। ফলে বিশ্বব্যাপী মূল্যস্ফীতি, বিশেষ করে খাদ্য পণ্যের মূল্য অস্বাভাবিকভাবে বৃদ্ধি পেয়েছে। খাদ্য পণ্যের মূল্যবৃদ্ধির কারণে বিশ্বব্যাপী সার্বিক মূল্যস্ফীতি চরম পর্যায়ে উন্নীত হয়েছে। এই অবস্থায় বিশ্বের উন্নত দেশগুলোর বেশির ভাগই তাদের নিত্যদিনের ব্যয় কমিয়ে আনতে সচেষ্ট রয়েছে। বাংলাদেশের রপ্তানি আয়ের ক্ষেত্রে সাফল্য অর্জিত হবার পেছনে বিশ্বব্যাপী উচ্চ মাত্রার মূল্যস্ফীতি প্রভাবক ভূমিকা পালন করছে। বাংলাদেশ তুলনামূলক কম দামি পোশাক রপ্তানি করে। যেহেতু বিশ্বব্যাপী উন্নত দেশগুলোর নাগরিকেরা তাদের জীবন যাত্রার ব্যয় কমানোর জন্য চেষ্টা করছেন, তাই তারা উচ্চ মূল্যের পণ্য ক্রয়ের পরিবর্তে তুলনামূলক সস্তা দামের পণ্য ক্রয় করছেন।
বাংলাদেশ মূলত সস্তা মূল্যের তৈরি পোশাক রপ্তানি করে। তাই বিশ্ব বাজারে বাংলাদেশের তৈরি পোশাক প্রাধান্য পাচ্ছে। বাংলাদেশ থেকে তৈরি পোশাক বা অন্যান্য পণ্য রপ্তানির পরিমাণ বৃদ্ধি পায়নি তেমন একটা। কিন্তু আন্তর্জাতিক বাজারে প্রতিটি পণ্যের মূল্যই বৃদ্ধি পেয়েছে। ফলে রপ্তানি আয় বেড়েছে। একই কারণে আমাদের আমদানি ব্যয়ও অস্বাভাবিকভাবে বেড়েছে। কাজেই রপ্তানি আয় বৃদ্ধির এই ইস্যু নিয়ে উল্লসিত হবার তেমন কিছু নেই। বরং আমাদের আন্তর্জাতিক বাণিজ্যে যে সব সমস্যা রয়েছে তা নিয় আমাদের জাতীয়ভাবে চিন্তা ভাবনা করা প্রয়োজন।
সদ্য সমাপ্ত অর্থবছরে বাংলাদেশের রেকর্ড পরিমাণ রপ্তানি আয় সম্ভব হয়েছে মূলত বিশ্ববাজারে বিভিন্ন পণ্যের অস্বাভাবিক ঊর্ধ্বমূল্যের কারণে। একই কারণে বাংলাদশর আমদানি ব্যয়ও গত অর্থবছরে ব্যাপকভাবে বৃদ্ধি পেয়েছে। আন্তর্জাতিক বাণিজ্য বাংলাদেশের প্রতিকূলে সৃষ্ট ঘাটতির পরিমাণ অতীতের যে কোনো সময়ের রেকর্ড অতিক্রম করেছে। গত অর্থবছরের প্রথম ১১ মাসে আন্তর্জাতিক বাণিজ্য বাংলাদেশের প্রতিকূলে ঘাটতির পরিমাণ দাঁড়িয়েছে ২ হাজার ৮১ কোটি ৬০ লাখ মার্কিন ডলার। আগের বছর একই সময়ে এই ঘাটতির পরিমাণ ছিল ৭০ কোটি মার্কিন ডলার। আর পুরো অর্থবছরে এই ঘাটতির পরিমাণ ছিল ২ হাজার ২৮০ কোটি মার্কিন ডলার। ২০২১-২০২২ অর্থবছরে রপ্তানি প্রবৃদ্ধি হয়েছে ৩৪ দশমিক ৩৮ শতাংশ। আর আমদানি ব্যয়ের প্রবৃদ্ধি হয়েছে প্রায় ৪৪ শতাংশ। আন্তর্জাতিক বাণিজ্যে এই বৈসাদৃশ্যের কারণে কারেন্ট অ্যাকাউন্ট ব্যালন্সে বড় ধরনের ঘাটতি সৃষ্টি হয়েছে। গত অর্থবছরের প্রথম ১১ মাসে বাংলাদেশের ক্যারেন্স অ্যাকাউন্ট ব্যালেন্সি ঘাটতি দাঁড়িয়েছে ১ হাজার ৭২৩ কোটি ৩০ লাখ মার্কিন ডলার। আগের বছর একই সময়ে এই ঘাটতির পরিমাণ ছিল ২৭৮ কোটি ৩০ লাখ মার্কিন ডলার। তবে গত অর্থবছরে সরাসরি বিদেশি বিনিয়োগ আহরণের ক্ষেত্রে সাফল্য অর্জিত হয়েছে। গত অর্থবছরের প্রথম ১১ মাসে বাংলাদেশ মোট ৪২৭ কোটি মার্কিন ডলার সরাসরি বিদেশি বিনিয়োগ আহরণ করতে সক্ষম হয়েছে।
বাংলাদেশের রপ্তানি বাণিজ্য চলছে অনেকটাই পরিকল্পনাবিহীনভাবে। ফলে এই খাতর সম্ভাবনাকে পুরোপুরি কাজে লাগানো যাচ্ছে না। বাংলাদেশের পণ্য রপ্তানি বাণিজ্যের সবচেয়ে বড় দুর্বলতা হচ্ছে সীমিত সংখ্যক দেশ ও সামান্য কিছু পণ্যের উপর অতিমাত্রায় নির্ভর হয়ে রপ্তানি কার্যক্রম পরিচালিত হচ্ছে। বাংলাদেশ থেকে প্রায় ২০০ পণ্য বিভিন্ন দেশে রপ্তানি করা হয়। এর মধ্যে শীর্ষস্থানীয় ৫টি পণ্য থেকে আসে মেট রপ্তানি আয়ের ৯০ শতাংশেরও বেশি। এর মধ্যে তৈরি পোশাক বাদ দিলে বাংলাদেশের রপ্তানি একেবারেই কমে যাবে। অথচ তৈরি পোশাক শিল্প পুরোপুরি আমদানিকৃত কাঁচামাল নির্ভর। ফলে এই খাত জাতীয় অর্থনীতিতে মাত্র ৬০ থেকে ৬৫ শতাংশ মূল্য সংযোজন করে। অথচ তৈরি পোশাকের পাশাপাশি স্থানীয় কাঁচামাল নির্ভর পণ্য বেশি পরিমাণে রপ্তানি করা গেলে এই খাতের আয় যেমন বাড়তো তেমনি জাতীয় অর্থনীতিতে অধিক মূল্য সংযোজন হতে পারতো।
বাংলাদেশের রপ্তানি বাণিজ্য কার্যত ইউরোপীয় ইউনিয়ন ও মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র নির্ভর। ইউরোপীয় ইউনিয়নে বাংলাদেশের প্রায় ৬৫ শতাংশ পণ্য রপ্তানি করা হয়। আর মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রে ২৮ শতাংশ পণ্য রপ্তানি করা হয়। ইউরোপীয় ইউনিয়ন বাংলাদেশকে শুল্কমুক্ত পণ্য রপ্তানি সুবিধা জিএসপি প্রদান করে বলেই দেশগুলোতে বাংলাদেশি পণ্যের এতো চাহিদা সৃষ্টি হয়েছে। ২০২৬ সালে বাংলাদেশ চূড়ান্তভাবে উন্নয়নশীল দেশের তালিকায় উত্তীর্ণ হলে ইউরোপীয় ইউনিয়ন ২০২৯ সাল পর্যন্ত জিএসপি সুবিধা প্রদান করবে। তারপর তারা জিএসপি+ সুবিধা প্রদান করলেও বাংলাদেশের বিদ্যমান অবস্থায় এই সুযোগ গ্রহণ করা সম্ভব হবে না। বাংলাদেশ যদি জিএসপি সুবিধা হারায় তাহলে রপ্তানি বাণিজ্যে ব্যাপক ধস নামতে পারে।
আন্তর্জাতিক বাজারে বাংলাদেশি তৈরি পোশাক সামগ্রি রপ্তানির ক্ষেত্রে সবচেয়ে বড় প্রতিপক্ষ হচ্ছে ভিয়েতনাম। ভিয়েতনাম সম্প্রতি ইউরোপীয় ইউনিয়ন থেকে জিএসপি সুবিধা পেয়েছে। কাজেই বাংলাদেশকে আগামীতে ইউরোপীয় ইউনিয়নভুক্ত দেশগুলোতে তৈরি পোশাক রপ্তানির ক্ষেত্রে বড় ধরনের প্রতিযোগিতার মুখোমুখি হতে হবে। বাংলাদেশ যেসব দেশ থেকে সবচেয়ে বেশি পরিমাণ পণ্য আমদানি করে সেই সব দেশে আমাদের রপ্তানির পরিমাণ খুবই সামান্য। যেমন বাংলাদেশ চীন ও ভারত থেকে সবচেয়ে বেশি পণ্য আমদানি করে থাকে। কিন্তু এই দেশ দু’টি বাংলাদেশ থেকে খুব সামান্য পরিমাণ পণ্য আমদানি করে। আবার ইউরোপীয় ইউনিয়ন এবং মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রে বাংলাদেশ সবচেয়ে বেশি পরিমাণ পণ্য রপ্তানি করে কিন্তু এই দু’টি অঞ্চল থেকে বাংলাদেশের আমদানির পরিমাণ খুবই কম। আন্তর্জাতিক বাণিজ্যের এই অসঙ্গতি দূর করতে না পারলে বাণিজ্যিক সম্ভাবনাকে সঠিকভাবে কাজে লাগানো যাবে না। অনেক দিন ধরেই অর্থনীতিবিদগণ রপ্তানি পণ্য তালিকায় ভিন্নমুখিতা আনয়নের জন্য তাগিদ দিয়ে আসছেন। কিন্তু এ ব্যাপারে তেমন কোনো অগ্রগতি হচ্ছে না। স্থানীয় কাঁচামাল নির্ভর পণ্য রপ্তানির প্রতি আমাদের গুরুত্ব দিতে হবে।
আগামীতে রপ্তানি বৃদ্ধির উদ্যোগের পাশাপাশি আমদানি ব্যয় কমানোর চেষ্টা করতে হবে। সরকার অবশ্য এ ক্ষেত্রে বেশ কিছু ইতিবাচক পদক্ষেপ গ্রহণ করেছে। সম্প্রতি রপ্তানি নিষিদ্ধ পণ্য তালিকা ১২টি হতে ২৬টিতে উন্নীত করা হয়েছে। ১২৩টি পণ্য আমদানির ক্ষেত্রে শুল্ক বাড়ানো হয়েছে। ২৭ ধরনের তুলনামূলক স্বল্প প্রয়োজনীয় পণ্য আমদানির ক্ষেত্রে ৭৫ থেকে শতভাগ এলসি মার্জিন আরোপ করা হয়েছে। এসব উদ্যোগের ফলে অপ্রয়োজনীয় বিলাসজাত পণ্য আমদানি কিছুটা হলেও কমে আসবে। মুদ্রা বাজারে অস্থিতিশীলতার পেছনে বিভিন্ন কারণ থাকতে পারে। অনেকেই মনে করছেন, আন্তর্জাতিক বাণিজ্যের আড়ালে দেশ থেকে মুদ্রা পাচার হচ্ছে। মার্কিন ডলারের চাহিদা অস্বাভাবিকভাবে বৃদ্ধি পাবার পেছনে এটাও একটি কারণ। বিষয়টি অনুসন্ধানের দাবি রাখে। আগামী বছরের শেষের দিকে জাতীয় নির্বাচন অনুষ্ঠিত হবে। আগামী নির্বাচন নানা কারণেই অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। যারা রাজনৈতিক ক্ষমতা ব্যবহার করে অবৈধ অর্থ কামিয়েছেন তারা এই নির্বাচনের আগে দেশ থেকে অর্থ পাচার বৃদ্ধি করতে পারেন। তাই এ ব্যাপারে এখনই সতর্ক হতে হবে। বৈদেশিক মুদ্রা ব্যবহারের ক্ষেত্রে আমাদের সতর্ক থাকতে হবে।