সাংবাদিক সোহানা পারভীন তুলির লাশ উদ্ধারের ঘটনায় আরেক সাংবাদিক রফিকুল ইসলাম রঞ্জুকে জিজ্ঞাসাবাদ করেছে পুলিশ।
বৃহস্পতিবার (১৪ জুলাই) দুপুরে পুলিশের ধানমন্ডি জোনের ঊর্ধ্বতন পুলিশ কর্মকর্তারা রঞ্জুকে জিজ্ঞাসাবাদ করেন।
রঞ্জুর সঙ্গে তুলির ‘প্রেমের সম্পর্ক’ ছিল বলে জানতে পেরেছে তদন্ত সংশ্লিষ্ট পুলিশ কর্মকর্তারা। লাশ উদ্ধারের আগের দিনও তুলির রায়েরবাজার মিতালী রোডের বাসায় গিয়েছিলেন তিনি। ওই বাসার দারোয়ানের দেওয়া একটি মোটরসাইকেলের নম্বরের সূত্র ধরে রফিকুল ইসলাম রঞ্জুকে শনাক্ত করেছে পুলিশ। তাকে ঢাকা না ছাড়ার নির্দেশনা দিয়েছে পুলিশ।
পুলিশের ধানমন্ডি জোনের সহকারী কমিশনার আব্দুল্লাহ আল মাসুম জানান, তুলির লাশ উদ্ধারের ঘটনায় একটি ইউডি (আনন্যাচারাল ডেথ) মামলা হয়েছে। আমরা বিষয়টি গুরুত্ব দিয়ে তদন্ত করছি। ইতোমধ্যে এই ঘটনায় একজনকে ডেকে এনে জিজ্ঞাসাবাদ করা হয়েছে। আমরা সার্বিক বিষয় খতিয়ে দেখছি।
বুধবার দুপুরে রায়েরবাজারের মিতালী রোডের বাসা থেকে সোহানা পারভীন তুলির ঝুলন্ত লাশ উদ্ধার করে পুলিশ। তুলিকে ফোনে না পেয়ে তার ঘনিষ্ঠ বান্ধবী নন্দিতা বাসায় গিয়ে দরজায় নক করে। কিন্তু ভেতর থেকে সাড়া না পেয়ে দারোয়ানের সহযোগিতায় দরজা ভেঙে তুলিকে গলায় ওড়না পেঁচিয়ে সিলিং ফ্যানের সঙ্গে ঝুলতে দেখতে পান। পরে তিনি বিষয়টি হাজারীবাগ থানাকে জানালে পুলিশ ঘটনাস্থলে ছুটে যায়। খবর দেওয়া হয় সিআইডির ক্রাইম সিন ইউনিটের সদস্যদের। ক্রাইম সিন ইউনিট ঘটনাস্থল থেকে আলামত সংগ্রহের পর তুলির মরদেহ সোহরাওয়ার্দী মেডিক্যাল কলেজ হাসপাতাল মর্গে পাঠানো হয়। বৃহস্পতিবার সকালে ময়নাতদন্ত শেষে তার লাশ যশোরের গ্রামের বাড়িতে নিয়ে যাওয়া হয়।
তুলির লাশ উদ্ধারের পর প্রাথমিক আলামত বিশ্লেষণ করে উপস্থিত পুলিশ কর্মকর্তারা জানান, প্রাথমিক তদন্তে আত্মহত্যা মনে হয়েছে। ঘরের দরজা ভেতর থেকে লক ছিল। বাসার অন্য কোনও জায়গা দিয়ে কোনও ব্যক্তির বের হওয়ার কোনও পথও ছিল না। এছাড়া তুলির শরীরে কোনও আঘাতের চিহ্ন পাওয়া যায়নি। তবু ময়নাতদন্ত রিপোর্ট হাতে পেলে মৃত্যুর প্রকৃত কারণ জানা যাবে বলে জানান পুলিশ কর্মকর্তারা।
তুলির মরদেহ উদ্ধারের পর ওই বাসার নিরাপত্তাকর্মী আজিমুদ্দিন জানান, বছর তিনেক ধরে তুলি ওই বাসার দ্বিতীয় তলার একটি ফ্ল্যাটে ভাড়া থাকতেন। মাঝে মধ্যে তার ছোট ভাই মোহাইমেনুল ইসলাম বাবুও ওই বাসায় থাকতেন। এছাড়া প্রতি সপ্তাহে তার বন্ধু পরিচয় দিয়ে এক ব্যক্তি মোটরসাইকেলযোগে আসা যাওয়া করতেন। একদিন আগেও (মঙ্গলবার, ১২ জুন) ওই ব্যক্তি দুপুর ১২টার দিকে তুলির বাসায় আসেন। এক ঘণ্টা পর অজ্ঞাত ওই বন্ধু তুলির বাসা থেকে বের হয়ে যান।
নিরাপত্তাকর্মীর দেওয়া তথ্যের ভিত্তিতে হাজারীবাগ থানা পুলিশ তুলির ওই বন্ধুকে খুঁজে বের করার চেষ্টা করে। একটি মোটরসাইকেলের নম্বর প্লেটের সূত্র ধরে জানা যায়, জলপাই রঙের ওই মোটরসাইকেলটির মালিক রফিকুল ইসলাম রঞ্জু নামে এক সাংবাদিক। তিনি একটি দৈনিক পত্রিকায় যুগ্ম বার্তা সম্পাদক হিসেবে কর্মরত রয়েছেন। পরে ওই পত্রিকার প্রশাসন বিভাগের মাধ্যমে তাকে ধানমন্ডি থানার তৃতীয় তলায় জোনাল এসি আব্দুল্লাহ আল মাসুমের কার্যালয়ে ডাকা হয়। দুপুরে রঞ্জু ধানমন্ডি থানার তৃতীয় তলায় গেলে তাকে প্রায় ঘণ্টাখানেক জিজ্ঞাসাবাদ করেন পুলিশ কর্মকর্তারা।
সংশ্লিষ্ট সূত্র জানায়, পুলিশের জিজ্ঞাসাবাদে রফিকুল ইসলাম রঞ্জু তুলির সঙ্গে দীর্ঘদিন ধরে সম্পর্ক থাকার কথা স্বীকার করেছেন। একটি দৈনিক পত্রিকায় একসঙ্গে কর্মরত থাকা অবস্থায় তাদের এই সম্পর্কের সূচনা হয়। মাঝখানে কয়েক বছর বিরতির পর গত দুই বছর ধরে তাদের মধ্যে আবারও সম্পর্ক গড়ে ওঠে।
রফিকুল ইসলাম রঞ্জু জিজ্ঞাসাবাদে জানিয়েছেন, ঘটনার একদিন আগে তিনি তুলির বাসায় গিয়েছিলেন। তার সঙ্গে স্বাভাবিক সম্পর্কই ছিল। কোনও মনোমালিন্য বা ঝগড়া না হওয়ার দাবি করেন তিনি। তুলি যে আত্মহত্যা করতে পারে এ বিষয়ে তার কোনও ধারণাই ছিল না।
তদন্ত সংশ্লিষ্ট একটি সূত্র জানিয়েছে, রফিকুল ইসলাম রঞ্জুর দেওয়া তথ্যে কিছুটা গরমিল রয়েছে। রঞ্জু ওই বাসা থেকে বের হওয়ার পর তুলির মোবাইল থেকে তার মোবাইলে একটি কল ও একটি খুদে বার্তা গিয়েছিল। কিন্তু তুলির কল ও খুদে বার্তার কোনও জবাব দেননি রঞ্জু। বরং রঞ্জু তার মোবাইল থেকে তুলির পাঠানো খুদে বার্তাটিও ডিলিট করে ফেলেছেন। রঞ্জুর মোবাইল থেকে ওই খুদে বার্তাসহ মোবাইলে কি ধরনের আলাপচারিতা হতো তা জানার চেষ্টা চলছে। কী কারণে তুলি আত্মহত্যার মতো সিদ্ধান্ত নিলেন, তা খতিয়ে দেখা হচ্ছে।
তদন্ত সংশ্লিষ্ট এক কর্মকর্তা জানান, স্বাভাবিক সম্পর্ক বিদ্যমান থাকলে রঞ্জু তুলির কল ও খুদে বার্তার জবাব দিতেন। তাদের মধ্যে এমন কোনও বিষয় নিয়ে মনোমালিন্য হয়েছিল বলেই রঞ্জু তুলির কলের রেসপন্স করেননি। এখন তারা বিষয়টি ক্লিয়ার হওয়ার জন্য তুলির ও রঞ্জুর মোবাইল ফরেনসিক পরীক্ষা করে দেখবেন।
উল্লেখ্য, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের গণযোগাযোগ ও সাংবাদিকতা বিভাগের ২০০২-০৩ শিক্ষাবর্ষের শিক্ষার্থী ছিলেন সোহানা তুলি। তিনি দৈনিক আমাদের সময়, দৈনিক কালের কণ্ঠে কাজ করছেন। ২০২১ সালের মে মাসে তিনি বাংলা ট্রিবিউনের চাকরি ছাড়েন। এরপর কিছু দিন একটি বেসরকারি প্রতিষ্ঠানে কাজ করেছেন সোহানা তুলি। সম্প্রতি একটি অনলাইন শপ খুলে নারী উদ্যোক্তা হিসেবে আত্মপ্রকাশ করেছিলেন তিনি।