৮০০ কোটি জনসংখ্যার বিশ্ব ও বাংলাদেশ

মোহাম্মদ মঈনুল ইসলাম

ভারত জনসংখ্যায় চীনকে টপকে যাচ্ছে
ফাইল ছবি

জনসংখ্যার প্রক্ষেপণ বলছে, এ বছর নভেম্বর মাসে বিশ্বের জনসংখ্যা পৌঁছে যাবে ৮ বিলিয়ন বা ৮০০ কোটিতে। নিঃসন্দেহে এটি একটি মাইলফলক—একদিকে চ্যালেঞ্জ, আরেক দিকে সম্ভাবনার। জনসংখ্যা ইস্যুতে সচেতনতা বাড়ানোর লক্ষ্যে ১১ জুলাই উদ্‌যাপিত হয়েছে বিশ্ব জনসংখ্যা দিবস।

এ বছর বিশ্ব জনসংখ্যা দিবস ২০২২-এর মূল প্রতিপাদ্য ছিল, ৮০০ কোটি জনসংখ্যার এ বিশ্বে সবার জন্য সহনশীল ভবিষ্যৎ, সুযোগকে কাজে লাগানো এবং অধিকার ও পছন্দ নিশ্চিত করা। নিঃসন্দেহে ৮০০ কোটি জনসংখ্যায় পৌঁছানো একটি মাইলস্টোন। তবে সংখ্যার চেয়ে ব্যক্তির অধিকার ও পছন্দকে কেন্দ্র করেই এ দিবসের আলোচনা।

universel cardiac hospital

এ ক্ষেত্রে জনসংখ্যা বাড়ানো বা কমানো নয় বরং সবার সুযোগ গ্রহণে সমান প্রবেশগম্যতা ও সুযোগকে কাজে লাগাতে প্রতিবন্ধকতা দূর করা—প্রান্তিক বা পিছিয়ে রয়েছে, এমন জনগোষ্ঠী, যেমন নারী, যুব, বয়স্ক, প্রতিবন্ধী ও স্থানান্তরিত জনগোষ্ঠীর দিকে বিশেষ দৃষ্টি রাখা। জনমিতিক সহনশীলতা নিশ্চিত করতে সবার মানবাধিকার—ব্যক্তির প্রজননস্বাস্থ্য অধিকার ও পছন্দকে গুরুত্ব প্রদান।

১৯৯৪ সালের সেপ্টেম্বর মাসের ৫-১৩ তারিখে মিসরের কায়রোতে অনুষ্ঠিত আন্তর্জাতিক জনসংখ্যা ও উন্নয়ন সম্মেলনে (আইসিপিডি) বাংলাদেশসহ পৃথিবীর ১৭৯টি দেশ জনসংখ্যা ও উন্নয়ন–সংক্রান্ত যে কর্মসূচি চূড়ান্ত করে, তার কেন্দ্রে রয়েছে অধিকার ও উন্নয়ন। তখন থেকেই জনসংখ্যা ও উন্নয়ন বিষয়ে এক ‘প্যারাডাইম’ শিফট ঘটে, যেখানে জনসংখ্যার পরিমাণগত দিক থেকে গুণগত দিকেই অধিকতর গুরুত্ব আরোপ করে—যেখানে ব্যক্তির অধিকার ও পছন্দই হচ্ছে মুখ্য। এ ক্ষেত্রে প্রজননস্বাস্থ্য ও অধিকার, জেন্ডার সমতা, নারীর ক্ষমতায়ন, পরিবার পরিকল্পনার মতো বিষয়গুলোতে লাভ করে বিশেষ গুরুত্ব, যা জনসংখ্যা ও উন্নয়ন বিষয়ে দেশীয় ও বৈশ্বিক নীতি-পরিকল্পনায় সংযুক্ত হয়।

জনসংখ্যা ও উন্নয়নবিষয়ক এ যুগান্তকারী সম্মেলনের ২৫ বছর পূর্তিতে ২০১৯ সালের নভেম্বরের ১২-১৪ তারিখে কেনিয়ার নাইরোবিতে অনুষ্ঠিত আন্তর্জাতিক সম্মেলন (আমি নিজেও এ সম্মেলনে একাডেমিয়া থেকে প্রতিনিধিত্বকারী) প্রদানকৃত পুনঃপ্রতিশ্রুতিগুলো বাস্তবায়ন ও ২০৩০ সালের মধ্যে তিন শূন্য লক্ষ্যমাত্রা (প্রথমটি: শূন্য মাতৃমৃত্যুর হারে নিয়ে যাওয়া, দ্বিতীয়: পরিবার পরিকল্পনার ক্ষেত্রে অপূর্ণ চাহিদা শূন্যতে নিয়ে আসা এবং তৃতীয়ত: যৌন ও জেন্ডারভিত্তিক নির্যাতন দূরীকরণ ও বাল্যবিবাহ শূন্যতে নিয়ে আসা) বড় চ্যালেঞ্জ হিসেবে আবির্ভূত হয়েছে—বিশেষ করে আমাদের বাংলাদেশের ক্ষেত্রে যদিও আর্থসামাজিক ও প্রজননস্বাস্থ্য ও অধিকার উন্নয়নে রয়েছে উল্লেখযোগ্য অগ্রগতি। অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধি, মাথাপিছু আয় বৃদ্ধি, দারিদ্র্যের হার হ্রাস, সর্বাধিক কর্মক্ষম জনগোষ্ঠী নিয়ে প্রথম জনমিতিক লভ্যাংশ অর্জনের সুযোগের সময়কাল অতিক্রম করছে বাংলাদেশ।

করোনা মহামারির আগে প্রাথমিক বিদ্যালয়ে শিক্ষার্থী ভর্তির ক্ষেত্রে ছেলে–মেয়ের অনুপাতে রয়েছে লক্ষণীয় সাফল্য। পাঁচ বছরের নিচে বয়সীদের ক্ষেত্রে শিশুমৃত্যুর হার, মোট প্রজনন হার হ্রাস, জন্মনিয়ন্ত্রণ পদ্ধতি ব্যবহারের হার বৃদ্ধি ও আয়ুষ্কাল বৃদ্ধিতে রয়েছে সাফল্য। এসব অগ্রগতির পাশাপাশি নতুন ও উদ্ভূত চ্যালেঞ্জ কিংবা অসম উন্নয়নও লক্ষণীয়। যুবগোষ্ঠী ও দ্রুত বয়স্ক জনগোষ্ঠীর সংখ্যা বাড়ছে। বেকারত্বের হারে তেমন কোনো পরিবর্তন আসেনি। আয়বৈষম্যে কোনো উন্নতি হয়নি বরং বেড়েছে।

আমাদের দরকার জনসংখ্যাকে উন্নয়নের কেন্দ্রবিন্দুতে রেখে জনসংখ্যার গতিময়তা (পপুলেশন ডিনামিকস) অর্থাৎ জন্ম, মৃত্যু ও স্থানান্তরের বিষয়গুলোকে অনুধাবন এবং সে অনুযায়ী চ্যালেঞ্জ ও সম্ভাবনাকে কাজে লাগাতে কর্ম-উদ্যোগ গ্রহণ করা, গুণগত উন্নয়নে অধিকার ও পছন্দকে নিশ্চিত করা। এ জন্য নীতিবিষয়ক বিতর্ক ও আমাদের পর্যালোচনামূলক আলোচনাকে অব্যাহত রাখতে যথাযথ পরিবেশ নিশ্চিত করতে হবে।

প্রাথমিক–পরবর্তী মাধ্যমিকে স্কুলে ঝরে পড়ার হার বেশি। দ্রুত নগরায়ণ হচ্ছে। নগরজীবনে উদ্ভূত হচ্ছে নতুন নতুন চ্যালেঞ্জ। জলবায়ুর পরিবর্তন বা পরিবেশগত (প্রাকৃতিক দুর্যোগ, নদীভাঙন, বন্যাসহ) বিভিন্ন কারণে শহরে স্থানান্তরিত হচ্ছে মানুষ। যুক্ত হয়েছে প্রতিবেশী মিয়ানমার থেকে আসা ১০ লক্ষাধিক রোহিঙ্গা বাস্তুচ্যুত জনগোষ্ঠী। জন্মনিয়ন্ত্রণের পদ্ধতি ব্যবহারের হার রোহিঙ্গা দম্পতিদের মধ্যে অনেক কম। প্রতিবছর রোহিঙ্গা ক্যাম্পে জন্ম নিচ্ছে ৩০ হাজারের বেশি শিশু। প্রজননস্বাস্থ্য সেবা এবং পরিবার পরিকল্পনা ও অধিকার নিশ্চিত করা একটি চ্যালেঞ্জ।

এ বছরের জনসংখ্যা দিবস বিশ্বে ৮০০ কোটি জনসংখ্যাকে বিবেচনায় রেখে উদ্‌যাপন করা হচ্ছে। পূর্বে আমাদের এ বিশ্ব কখনো ৮০০ কোটি জনসংখ্যায় পৌঁছায়নি। ৮০০ কোটি জনসংখ্যা মানে ৮০০ কোটি শক্তি—বড় সংখ্যা, বড় চ্যালেঞ্জ ও বড় সম্ভাবনা। বিশ্বের এ জনসংখ্যার বিচারে বাংলাদেশে রয়েছে প্রায় ২ দশমিক ২ শতাংশ জনগোষ্ঠী। অনুপাত ও সংখ্যার বিচারে এটি মোটেও কম নয়। বিশ্বের অষ্টম জনবহুল এ দেশের জনঘনত্ব সর্বাধিক, যেখানে বর্তমানে প্রতি বর্গকিলোমিটারে বাস করে ১২৬৫ জনের বেশি, যা ক্রমান্বয়ে বাড়ছে। আমাদের আয়তন সীমিত। ফলে নীতি-পরিকল্পনায় জনসংখ্যার ঘনত্বকে সর্বদা বিবেচনায় রাখা উচিত।

বাংলাদেশ পরিসংখ্যান ব্যুরোর প্রাক্কলিত তথ্যে ২০২১ সালের জানুয়ারিতে বাংলাদেশের জনসংখ্যা ছিল প্রায় ১৭ কোটি বা ১৭০ মিলিয়ন। সম্প্রতি হয়ে যাওয়া জনশুমারি ও গৃহগণনা ২০২২ থেকে জানা যাবে দেশের বর্তমান জনসংখ্যা। তবে সেটিও কতটুকু গ্রহণযোগ্য হবে, তা নির্ভর করছে গুণগত উপাত্ত সংগ্রহ হয়েছে কি না, তার ওপর।

বর্ষাকালে ও স্থানীয় পর্যায়ে কোথাও কোথাও নির্বাচন চলাকালে সম্পাদিত এ শুমারির সময়ে সিলেট ও উত্তরাঞ্চলের অনেক জায়গা ছিল বন্যাকবলিত। অনেক মানুষ ছিল গৃহহীন। তা ছাড়া দেশের অন্যান্য স্থানেও সবাইকে গণনায় অন্তর্ভুক্ত করা হয়েছে কি না, সঠিকভাবে নির্ধারিত সব প্রশ্নের উত্তর সংগ্রহ করা হয়েছে কি না, ভাসমান জনগোষ্ঠীরা সঠিকভাবে গণনায় অন্তর্ভুক্ত হয়েছে কি না, এসব নিয়ে আমার মতো অনেকেরই হয়তো রয়েছে প্রশ্ন।

বাংলাদেশের ১৭ কোটির বেশি জনসংখ্যাকে ১৭ কোটির বেশি সম্ভাবনায় রূপান্তর করতে হলে আমাদের দরকার রাজনৈতিক প্রতিশ্রুতি ও তার বাস্তবায়ন। মানব পুঁজি হতে হলে করতে হবে শিক্ষা ও স্বাস্থ্যে প্রত্যাশিত বিনিয়োগ।

অধিকার ও পছন্দের ভিত্তিতে সম্ভাবনা ও সুযোগের প্রেক্ষাপটে জনসংখ্যার সঠিক আকার ও বণ্টন (যেমন বয়স, লিঙ্গ, অঞ্চল, ধর্ম, নৃগোষ্ঠী, প্রতিবন্ধী, কর্ম) সম্পর্কে জানা অত্যন্ত জরুরি; বিশেষ করে কোভিড-১৯ মহামারি–উত্তর সময়ে নীতি ও পরিকল্পনা গ্রহণ এবং তার সঠিক বাস্তবায়নে। জনসংখ্যার সঙ্গে অধিকতর সম্পর্কিত জাতীয় নীতি—যেমন জাতীয় জনসংখ্যা নীতি ২০১২, জাতীয় স্বাস্থ্য নীতি ২০১১, জাতীয় শিক্ষা নীতি ২০১০, জাতীয় শ্রম নীতি ২০১২, জাতীয় নারী উন্নয়ন নীতি ২০১১, জাতীয় দক্ষতা উন্নয়ন নীতি ২০১১, জাতীয় প্রবীণ নীতিমালা ২০১৩—এমন অনেক নীতিরই দরকার আপডেট করা, বিশেষ করে টেকসই উন্নয়ন অ্যাজেন্ডা-এসডিজিকে লক্ষ্য করে।

আমাদের দরকার জনসংখ্যাকে উন্নয়নের কেন্দ্রবিন্দুতে রেখে জনসংখ্যার গতিময়তা (পপুলেশন ডিনামিকস) অর্থাৎ জন্ম, মৃত্যু ও স্থানান্তরের বিষয়গুলোকে অনুধাবন এবং সে অনুযায়ী চ্যালেঞ্জ ও সম্ভাবনাকে কাজে লাগাতে কর্ম-উদ্যোগ গ্রহণ করা, গুণগত উন্নয়নে অধিকার ও পছন্দকে নিশ্চিত করা। এ জন্য নীতিবিষয়ক বিতর্ক ও আমাদের পর্যালোচনামূলক আলোচনাকে অব্যাহত রাখতে যথাযথ পরিবেশ নিশ্চিত করতে হবে।

লেখক : অধ্যাপক ও সাবেক চেয়ারম্যান, পপুলেশন সায়েন্সেস বিভাগ, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়

শেয়ার করুন