মাহফুজ আনাম মুক্তিযুদ্ধে অংশ নেননি কেন?

নিজস্ব প্রতিবেদক

ইংরেজি পত্রিকা ডেইলি স্টারের সম্পাদক মাহফুজ আনাম বিভিন্ন সময় নিজেকে কখনো সরাসরি, কখনো ইনিয়ে-বিনিয়ে একাত্তরের ‘মুক্তিযোদ্ধা’ বলে দাবি করেন। দেশের শীর্ষসারির কোনো সংবাদমাধ্যমের সম্পাদকের এভাবে মিথ্যাচারের নজির আর নেই। বাঙালির শ্রেষ্ঠতম অর্জন মুক্তিযুদ্ধ নিয়েই শুধুু নয়, নানা কিছুতেই মিথ্যাচারের আশ্রয় নেন তিনি। দৈনিক প্রথম আলো-ডেইলি স্টারের (পত্রিকা দুটির মালিক ট্রান্সকম গ্রুপ) উদ্দেশ্যপ্রণোদিত সাংবাদিকতার মধ্য দিয়ে হাজার কোটি টাকা কামানো মাহফুজ নিজের সম্পদের পরিমাণ নিয়েও মিথ্যাচার করেন। প্রকাশ করেন না সঠিক তথ্য। দেন না সরকারকে কর (ট্যাক্স)।

ডেইলি স্টারের মাহফুজসহ প্রথম আলোর সম্পাদক মতিউর রহমানের অবৈধ সম্পত্তি নিয়ে দেশের দুটি গোয়েন্দা সংস্থার কাছে তথ্য আছে। নির্ভরযোগ্য গোয়েন্দা সূত্রে সেসব তথ্য মত ও পথের কাছে এসেছে। এসব তথ্য বিশ্লেষণ করে দেখা যায়, দুজনেই হাজার কোটি টাকা করে অবৈধ সম্পত্তির মালিক। ভারতের বিচ্ছিন্নতাবাদী ও সন্ত্রাসী সংগঠন উলফার টাকায় তাদের জীবনে অর্থনৈতিক চাকচিক্য এসেছে। বিশেষ করে, মাহফুজ আনাম উলফার টাকায় রাতারাতি ‘বড় সাংবাদিক’ বনে যান। তাঁরা দুজনেই ট্রান্সকমকে বিদেশে টাকাপাচারে সহযোগিতা করে আসছেন। মুক্তিযুদ্ধের সময় মাহফুজের হাস্যকর ভূমিকার কথাও ওঠে এসেছে মত ও পথের অনুসন্ধানে।

আলোচিত ও বিতর্কিত রাজনৈতিক পরিবারে জন্ম সাংবাদিক মাহফুজ আনামের। তাঁর বাবা রাজনীতিক ও লেখক আবুল মনসুর আহমদ পাকিস্তান আমলে ১৯৫৬ সালে কেন্দ্রীয় সরকারের মন্ত্রী হন। পাকিস্তান আমলের ‘দুর্নীতিবাজ মন্ত্রী’ হিসেবে তিনি ব্যাপক নিন্দা কুড়ান। রাজনৈতিক আদর্শের বিচারে আবুল মনসুর সুবিধাবাদী ছিলেন। তাঁর লেখা ‘আমার দেখা রাজনীতির পঞ্চাশ বছর’ বইয়েও এর নজির আছে। আবুল মনসুরের বাবা ও মাহফুজ আনামের দাদা উগ্র ওহাবিদের বালাকোট আন্দোলনে অংশ নেন। যা নানা বিতর্কের জন্ম দেয়।

মুক্তিযুদ্ধে অংশ নিয়েছেন কী না, মত ও পথের এমন প্রশ্নে আজ বৃহস্পতিবার মাহফুজ আনাম বলেন, ‘আমি মুক্তিযোদ্ধা হতে সেনাবাহিনীতে যোগ দিয়েছিলাম। একাত্তর সালের আগস্টের দিকে একদিন শুনলাম, আর্মিতে শর্ট সার্ভিস কমিশনে সেকেন্ড ব্যাচ নেবে। সেখানে একজন ক্যাডেট নির্বাচিত হয়ে ট্রেনিংয়ে চলে গেলাম। ঘটনাচক্রে আমাদের ট্রেনিং চলাকালেই দেশ স্বাধীন হয়ে যায়। তাই আমি মুক্তিযোদ্ধা নই।’ তাঁর সঙ্গে মুঠোফোন সেটে এ কথোপকথনের রেকর্ড আছে মত ও পথের কাছে। অনেকে মনে করেন, পাকিস্তানমনস্ক মাহফুজ আসলে মুক্তিযুদ্ধে অংশ নিতে চাননি। তাঁর জন্ম এ দেশে হলেও বেড়ে ওঠা ও পড়াশোনা পাকিস্তানে।

ভারতীয় বিচ্ছিন্নতাবাদী সংগঠন ‘ইউনাইটেড লিবারেশন ফ্রন্ট আসামের’ (উলফা) অর্থায়নে বাজারে আসে প্রথম আলো-ডেইলি স্টার। নব্বইয়ের দশকের শুরুতে সন্ত্রাসী সংগঠন হিসেবে উলফাকে নিষিদ্ধ করে ভারতের সরকার। মার্কিন যুুক্তরাষ্ট্রের স্টেট ডিপার্টমেন্টের সন্ত্রাসী সংগঠনের তালিকায়ও উলফার নাম আছে। প্রথম আলো-ডেইলি স্টারের মালিক ট্রান্সকম গ্রুপ। এর প্রতিষ্ঠাতা চেয়ারম্যান প্রয়াত লতিফুর রহমান নব্বইয়ের দশকে দেউলিয়ায় পরিণত হন। আর্থিক অনটনে ওই সময় তাঁর পৈত্রিক সম্পত্তি চাঁদপুরের ‘ডব্লিউ রহমান জুট মিল’ বন্ধ করতে বাধ্য হন।

বেতন-ভাতা না দিয়েই প্রতিষ্ঠানের সহস্রাধিক শ্রমিককে চাকরিচ্যুত করেন। এ ঘটনায় তাঁর বিরুদ্ধে চাঁদপুরের আদালতে একাধিক মামলা হয়। ডব্লিউ রহমান জুট মিল বাংলাদেশ ব্যাংকের শীর্ষ ঋণখেলাপির তালিকায় স্থান পায়। এমন সংকটাপন্ন অবস্থায় স্ত্রীর ভাই উলফা নেতা অনুপ চেটিয়া তাঁর প্রতিষ্ঠানে বিনিয়োগ শুরু করেন। অবশ্য এ বিষয়ে আগেই দুজনের সাথে আলোচনা অনেকদূর এগিয়েছিল। অল্পসময়ের মধ্যে লতিফুর রহমানকে কয়েক মিলিয়ন ডলার দেন অনুপ। অর্থ পেয়ে লতিফুর গড়ে তোলেন ট্রান্সকম।

নব্বইয়ের দশকে প্রখ্যাত সাংবাদিক এসএম আলী একটি ইংরেজি দৈনিক প্রকাশের উদ্যোগ নেন। সিদ্ধান্ত হয়, ডেইলি স্টার প্রকাশের। সম্পাদকের দায়িত্ব পান তিনি। উলফার নির্দেশ অনুযায়ী, লতিফুর রহমান ওই পত্রিকার শেয়ার নেন। ভারতের উত্তর-পূর্ব রাজ্য আসামকে আলাদা করার জন্য পার্শ্ববতী দেশের মিডিয়াকে কাজে লাগাতে চায় উলফা।

এসএম আলী অল্প সময়ের মধ্যে ডেইলি স্টারকে জনপ্রিয় ইংরেজি পত্রিকায় পরিণত করেন। তাঁর আকস্মিক মৃত্যুতে পত্রিকায় নিজের শতভাগ নিয়ন্ত্রণ প্রতিষ্ঠার সুযোগ পান লতিফুর। এই সুযোগে তিনি সম্পাদক হিসেবে মাহফুজ আনামকে নিয়োগ দেন। যিনি এসএম আলীর শেয়ার তাঁর উত্তরাধিকারদের কাছ থেকে সুকৌশলে নিজের করে নেন। মাহফুজের নেতৃত্বে ডেইলি স্টার বেপরোয়া সাংবাদিকতায় শুরু করে।

অনুপ চেটিয়া বাংলাদেশে গ্রেপ্তার হওয়ার পর লতিফুর রহমানের সাথে উলফার সম্পর্ক খারাপ হতে থাকে। তিনি তাঁর প্রতিষ্ঠানে উলফার গোপন শেয়ারের কথা অস্বীকার করেন। এই বিরোধের জেরে তাঁর মেয়ে শাজনীন রহমান ঢাকার গুলশানে নিজবাড়িতে হত্যাকাণ্ডের শিকার হন বলে বিভিন্ন সূত্রে জানা যায়।

দেশের মিডিয়ার একচ্ছত্র নিয়ন্ত্রণকে অন্যান্য ব্যবসার কাজে ব্যবহার করেন লতিফুর। তাঁর বেশকিছু ব্যবসা আমদানিনির্ভর। এ সুযোগকে কাজে লাগিয়ে তিনি বিপুল অংকের রাজস্ব ফাঁকি দিয়েছেন। রাজস্ব ফাঁকি দিয়ে আনা বেশ কয়েকটি পণ্য শুল্ক কর্তৃপক্ষ বিভিন্ন সময় আটকও করেছিল। কিন্তু মিডিয়ার আধিপত্য কাজে লাগিয়ে লতিফুর পার পান।

২০০৭ সালে দেশের রাজনৈতিক পটপরিবর্তন ও ওয়ান ইলেভেন সৃষ্টিতে লতিফুর রহমান, মতিউর রহমান ও মাহফুজ আনামের ভূমিকা রয়েছে। ওয়ান ইলেভেন পরবর্তী তত্ত্বাবধায়ক সরকারের প্রধান উপদেষ্টার প্রেস সেক্রেটারি হিসেবে নিয়োগ পান ডেইলি স্টারের ব্যবস্থাপনা সম্পাদক সৈয়দ ফাহিম মোনায়েম। ওই সময় দুর্নীতি দমন কমিশন (দুদক) লতিফুর রহমানকে তাঁর সম্পদের বিবরণী চেয়ে নোটিস ইস্যু করে। কিন্তু দ্রুত সময়ের মধ্যে বিষয়টি ধামাচাপা দেওয়া হয়। তখন সম্পদের বিবরণীতে তথ্য গোপনসহ নানা ঠুনকো অজুহাতে দেশের বহু ব্যবসায়ীকে হেনস্তা হতে হয়। কিন্তু লতিফুর ছিলেন স্পর্শের বাইরে।

উলফার কাছ থেকে ফান্ড পেয়ে লতিফুর রহমান বিভিন্ন দেশে ব্যাংক হিসাব খোলেন। কেএফসি ও পিৎজা হাটের ব্যবসার আড়ালে তিনি বিদেশে অর্থ পাঁচার করেন। যদিও এ সংক্রান্ত কাগজপত্রে দেখানো হয়, বিদেশি প্রতিষ্ঠান কেএফসি ও পিজা হাটকে তাদের শাখা পরিচালনা বাবদ অর্থ দেওয়া হচ্ছে। অনুসন্ধানে জানা যায়, কেএফসি ও পিজা হাটের মূল প্রতিষ্ঠানকে তাদের প্রাপ্যের অতিরিক্ত অর্থ পাঠানো হয়। যা পরবর্তীতে ট্রান্সকমের বিদেশি ব্যাংক হিসাবে জমা হয়।

শেয়ার করুন