যুক্তরাষ্ট্রের নাগরিক আলবার্ট উডফক্স। দেশটিতে কয়েদি হিসেবে তাঁর বিশেষ পরিচিতি রয়েছে। যুক্তরাষ্ট্রের ইতিহাসে সবচেয়ে বেশি সময় ধরে কারাবন্দি ছিলেন উডফক্স। ৯ ফুট দৈর্ঘ্য ও ৬ ফুট প্রস্থের একটি কারাকক্ষে টানা ৪৩ বছর বন্দি জীবন কাটিয়েছেন তিনি। সম্প্রতি ৭৫ বছর বয়সে মারা গেছেন উডফক্স। করোনা পরবর্তী শারীরিক জটিলতায় ভুগে তাঁর মৃত্যু হয়েছে।
উডফক্সের মৃত্যুর ঘটনায় গত বৃহস্পতিবার একটি প্রতিবেদন প্রকাশ করেছে যুক্তরাজ্যের সংবাদমাধ্যম দ্য গার্ডিয়ান। এতে বলা হয়েছে, উডফক্সের মৃত্যুর তারিখ জানানো হয়নি। তবে দীর্ঘদিন উডফক্সের আইনজীবী হিসেবে কাজ করা জর্জ কেনডাল ও ক্যারিন উইলিয়ামস এবং তাঁর ভাই মাইকেল ম্যাবল বৃহস্পতিবার তাঁর মৃত্যুর বিষয়টি সংবাদমাধ্যমকে নিশ্চিত করেছেন।
কারাবন্দিদের গ্রুপ ‘অ্যাঙ্গোলা থ্রি’-এর সদস্য ছিলেন উডফক্স। ১৯৭২ সালে লুইজিয়ানা অঙ্গরাজ্যের একটি কারাগারে কারারক্ষী ব্রেন্ট মিলারকে হত্যার দায়ে দোষী সাব্যস্ত হন এই গ্রুপের সদস্যরা। কারাগারটি এক সময়ের ক্রীতদাসদের তৈরি বাগানের জায়গায় নির্মাণ করা হয়েছিল। ওই বাগান তৈরির কাজে যুক্ত ক্রীতদাসদের বেশির ভাগকে আফ্রিকার দেশ অ্যাঙ্গোলা থেকে আনা হয়েছিল।
ওই হত্যাকাণ্ডের আগে উডফক্স ও তাঁর সহযোগী অ্যাঙ্গোলা থ্রি–এর সদস্য হারমান ওয়ালেস কারাগারের ভেতরে প্রতিবাদ করেছিলেন। তাঁরা কারাগারে বন্দিদের বিচ্ছিন্ন করে রাখা ও তাঁদের দিয়ে বিনাবেতনে তুলা বাছাইয়ের কাজ করানোর বিরুদ্ধে ছিলেন। এসব কারণে উডফক্সসহ কৃষ্ণাঙ্গ বন্দিরা নানা নির্যাতনের শিকার হচ্ছিলেন।
তবে উডফক্স তাঁর বিরুদ্ধে আনা অভিযোগ স্বীকার করেননি। সব সময় জোর দিয়ে বলেছেন, কৃষ্ণাঙ্গ হওয়ায় তাঁকে মিথ্যা অভিযোগে ফাঁসানো হয়েছে। মিলারের মৃত্যুতে দোষী সাব্যস্ত হওয়ার পর থেকে দশকের পর দশক ধরে উডফক্স ও ওয়ালেসকে নির্জন কারাগারে রাখা হয়।
আইনি লড়াইয়ের মাধ্যমে ২০১৩ সালে ওয়ালেস মুক্তি পান। মুক্তির পরও কর্তৃপক্ষ তাঁকে কারাগারে ফিরিয়ে আনার চেষ্টা চালায়। তবে মুক্তির পরপরই ওয়ালেস ক্যানসারে আক্রান্ত হয়ে মারা যান। তখনও উডফক্সের বন্দীদশা কাটেনি।
উডফক্স ২০১৬ সালে তাঁর ৬৯তম জন্মদিনে মুক্তি পান। মুক্ত হওয়ার পর কয়েক দিন পর উডফক্স গার্ডিয়ানকে বলেন, ক্লাস্ট্রোফোবিয়ার সঙ্গে ভয়ঙ্কর লড়াই সত্ত্বেও শুধু মনের জোরে তিনি কয়েক দশকের একাকিত্ব সহ্য করতে পেরেছিলেন।
পরবর্তীতে উডফক্স নিজের অভিজ্ঞতা জানিয়ে একটি বই লেখেন। ‘সলিটারি’ নামের বইটি ২০১৯ সালে পুলিৎজার পুরষ্কারের জন্য মনোনীত হয়। এই বইয়ে ও গার্ডিয়ানকে দেওয়া সাক্ষাতকারে তিনি নিজের ও ওয়ালেসের শক্তিমত্তার বিষয়ে বিস্তারিত তুলে ধরেন। উডফক্স তাঁর বন্ধু ওয়ালেসকে ‘আমার হৃদয়ের অন্য অংশ’ বলে বর্ণনা করেন। তিনি বলেন, ‘চার দশকের কথা বাদ দিন, আমরা যে পরিস্থিতি সহ্য করেছি, তা এক সপ্তাহের মধ্যে যে কারও মানসিক শক্তি ভেঙে দিতে যথেষ্ট।’
কারাগারে বন্দি জীবনে পড়াশোনায় নিজেকে ডুবিয়ে রেখেছিলেন উডফক্স। তিনি ফ্রানৎস ফ্যানন, ম্যালকম এক্স ও মার্কাস গার্ভের বই পড়েছেন। এমনকি তরুণ বন্দিদের পড়ার অভ্যাস তৈরিতে সহায়তা করতে পেরে গর্ববোধ করতেন উডফক্স।
সাক্ষাৎকারে উডফক্স বলেন, ‘কারাগারে আমাদের সেলগুলোকে ডেথ চেম্বার হিসেবে দেখা হতো। তবে আমরা সেগুলোকে বিদ্যায়তন, বিতর্ক হলে পরিণত করেছিলাম। ওই সময় আমরা প্রতিশোধের তৃষ্ণায় নিজেকে হারাতে দেইনি। বরং আমরা সময়কে সঠিকভাবে ব্যবহার করেছি। সমাজ ও মানবতার অংশ হতে প্রয়োজনীয় উপাদানগুলো কাজে লাগিয়েছি।’
কারাগার থেকে বেরিয়ে এসে উডফক্স যুক্তরাষ্ট্রে ও দেশটির বাইরে মার্কিন ফৌজদারি বিচার ব্যবস্থার নৃশংসতা সম্পর্কে জনসাধারণকে জানাতে নিজেকে উৎসর্গ করেছিলেন। এ জন্য তিনি দেশ ও দেশের বাইরে ঘুরে বেড়িয়েছেন, বক্তৃতা দিয়েছেন। স্কুলের শিক্ষার্থী থেকে শুরু করে বিচারকেরা তাঁর বক্তব্য শুনেছেন।
বাড়ি ফেরার পর পরিবারের সঙ্গে সময় কাটাতে পছন্দ করতেন উডফক্স। বন্দী থাকাকালে উডফক্সের মা রুবি ম্যাবল মারা যান। বাড়ি ফিরে উডফক্স মায়ের কবর দেখতে যান। স্ত্রী লেসলি জর্জ, মেয়ে ব্রেন্ডা পুল এবং নাতি-নাতনির সঙ্গে কাটানো সময় ভীষণ উপভোগ করেছিলেন উডফক্স।
দশকের পর দশক ধরে তাঁর সঙ্গে ঘটে যাওয়া প্রাতিষ্ঠানিক নিষ্ঠুরতা সত্ত্বেও জীবনের শেষপর্যন্ত অত্যন্ত আশাবাদী একজন মানুষ ছিলেন উডফক্স। তিনি তাঁর বইয়ে লিখেছেন, ‘মানবজাতিকে নিয়ে আমি আশাবাদী। আমার প্রত্যাশা, এক সময় পৃথিবী থেকে অপ্রয়োজনীয় যন্ত্রণা, কষ্ট, দারিদ্র্য, শোষণ, বর্ণবিদ্বেষ ও অবিচার দূর হয়ে যাবে।’
