দৈনিক প্রথম আলো পত্রিকায় এবং এর অনলাইনে গত ২৭ জুলাই ‘রাজউকের প্লট বরাদ্দ: ক্ষমতাবান স্বামী–স্ত্রীদের প্লট দিতে পাল্টে যাচ্ছে রাজউকের বিধি’ শিরোনামে একটি প্রতিবেদন এবং ২৯ জুলাই ‘রাজউকের স্বেচ্ছাচার: ক্ষমতাবানদের সুবিধা দিতে বিধি সংশোধন নয়’ শিরোনামে প্রকাশিত সম্পাদকীয়টি ন্যক্কারজনক ও সম্পূর্ণ রাজনৈতিক উদ্দেশ্যপ্রণোদিত অভিহিত করে এর তীব্র নিন্দা ও প্রতিবাদ জানিয়েছেন বেসামরিক বিমান পরিবহন ও পর্যটন মন্ত্রণালয় সম্পর্কিত সংসদীয় স্থায়ী কমিটির চেয়ারম্যান যুদ্ধাহত বীর মুক্তিযোদ্ধা র আ ম উবায়দুল মোকতাদির চৌধুরী এমপি।
প্রতিবাদলিপিতে মোকতাদির চৌধুরী বলেন, উক্ত প্রতিবেদনে কোনোকিছু সঠিকভাবে যাচাই না করেই আমার নাম এবং ছবি ব্যবহার করার মাধ্যমে সম্পূর্ণ উদ্দেশ্যমূলকভাবে কারও ইন্ধনে আমাকে লক্ষ্যবস্তু বানানো হয়েছে। স্পষ্টতই কোনো মহলের দ্বারা ভিন্নভাবে প্রভাবিত হয়ে অথবা কোনো মহলের স্বার্থ সুরক্ষায় শুধু একজনকেই লক্ষ্যবস্তুতে পরিণত করা হয়েছে। কোনো একটি মহলের দ্বারা লাভবান হয়ে প্রতিবেদক ও সম্পাদক উভয়ই কাজ করছেন, এটি বিশ্বাস করার যথেষ্ট কারণ রয়েছে।
তিনি বলেন, রাজধানী উন্নয়ন কর্তৃপক্ষ (রাজউক) একটি সরকারি প্রতিষ্ঠান। এর নিজস্ব বিধিমালা রয়েছে এবং এতদসংক্রান্ত বিধি প্রণয়ন, সংশোধন বা পরিমার্জনের পুরো বিষয়টি গৃহায়ণ ও গণপূর্ত মন্ত্রণালয়ের এখতিয়ারভুক্ত। অথচ, আমার এবং আমার স্ত্রীর প্লট দেওয়ার পরিপ্রেক্ষিতে রাজউকের বিধি সংশোধনের উদ্যোগ নেওয়া হয়েছে বলে এই প্রতিবেদনে যে দাবি করা হচ্ছে, তার সঙ্গে আমার এবং আমার স্ত্রীর ন্যূনতম সংশ্লিষ্টতা নেই। রাজউকের বিজ্ঞপ্তির পরিপ্রেক্ষিতেই আমি এবং আমার স্ত্রী আলাদাভাবে প্লটের আবেদন করি। রাজউক কতৃক তা গৃহীত হয়। এই আবেদন গ্রহণ কিংবা বাতিলের এখতিয়ার বিধি অনুযায়ী শুধুই রাজউকের। উল্লেখ করা যেতে পারে যে, পূর্বাচলের প্লট বরাদ্দ বিষয়ে এ পর্যন্ত ৩টি পরস্পর বিরোধী বিজ্ঞপ্তি জারি হয়েছে। তার মধ্যে ২য় বিজ্ঞপ্তিটিতে এই ধরণের কোনো শর্ত ছিল না যে, ভিন্ন ভিন্ন আয়কর প্রদানকারী হলেও এবং প্রত্যেকের নিজস্ব সম্পদ থাকলেও স্বামী পেলে স্ত্রী, কিংবা স্ত্রী পেলে স্বামী প্লট পাবেন না। যার কারণে অনেকেই এই সুযোগ নিয়েছেন। অনুসন্ধানী প্রতিবেদন যাঁরা করেন, তাঁরা আমার বক্তব্যের সত্যতা যাচাই করতে পারেন।
মোকতাদির চৌধুরী আরও বলেন, বর্তমানে চলমান যে বিধির আওতায় প্লট বরাদ্দ হয়, সেখানেও অনেক স্বামী-স্ত্রীই ভিন্ন ভিন্ন প্লটের অধিকারী, যাঁদের মধ্যে সংসদ সদস্য, আমলা, প্রাক্তন আমলা, (তথাকথিত) বিশিষ্টজনও রয়েছেন, যাদের কথা বোধগম্য কারণেই প্রতিবেদনটিতে স্থান পায়নি। কেননা, মহল বিশেষের টার্গেট তো আমি। প্রথম আলোর প্রতিবেদক ও সম্পাদক তাদের হয়েই কাজ করছেন। এমনটি ১/১১ এর সময়েও পত্রিকাটি করেছে। তারা আমার ৮ একর জমিকে ৮০ একর বানিয়ে দিয়েছিলো। ২০০৯ সালে আমার বাড়ি থেকে কয়েক কিলোমিটার দূরের একটি তোরণকে আমার বাড়ির গেটে আমার নামের তোরণ বলে সংবাদ পরিবেশন করেছিলেন। এ ধরনের অসত্যতা পত্রিকাটির চারিত্রিক বৈশিষ্টে পরিনত হয়েছে। ইতোমধ্যে অনেকের প্লটই রেজিষ্ট্রি করে দিয়েছে রাজউক (অনুসন্ধানী প্রতিবেদন কি বলে?)। তাঁদের কি হবে? স্বামীর কারণে বা স্ত্রীর কারণে যদি অন্যজন বঞ্চিত হয়, তাঁদের বৈবাহিক সম্পর্কের অবসান হলে অবস্থাটা কি দাঁড়াবে?
তিনি বলেন, আমি একজন সশস্ত্র ও যুদ্ধাহত মুক্তিযোদ্ধা। ছাত্র রাজনীতিতেও বাংলাদেশের সপক্ষে সক্রিয় ভূমিকা ছিল আমার। পরবর্তীতে সরকারের প্রশাসনে কর্মকর্তা হিসেবে নিযুক্ত ছিলাম। এর পরে এখন পর্যন্ত ব্রাহ্মণবাড়িয়া-৩ (সদর ও বিজয়নগর) আসন থেকে তিনবার নির্বাচিত সংসদ সদস্য। বর্তমানে বেসামরিক বিমান পরিবহণ ও পর্যটন মন্ত্রণালয় সম্পর্কিত সংসদীয় স্থায়ী কমিটির সভাপতি হিসেবে দায়িত্ব পালন করছি। জীবনের শুরু থেকে অদ্যাবধি আমি দেশের মানুষের জন্য কাজ করে আসছি। রাজউকের পূর্বাচল প্রকল্পে একজন যুদ্ধাহত মুক্তিযোদ্ধা ও সংসদ সদস্য হিসেবে বিধি মোতাবেকই আমাকে প্লট বরাদ্দ দেওয়া হয়েছে। প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, ‘আমি কেন প্লট আবেদনে নিজের মুক্তিযোদ্ধা পরিচয় উল্লেখ করিনি।’ আসলে কোথাও লিখিতভাবে উল্লেখ থাকুক বা নাই থাকুক, একজন বীর মুক্তিযোদ্ধা সব সময়ই বীর মুক্তিযোদ্ধা। নিজের মুক্তিযোদ্ধা পরিচয় সম্পর্কে লিখতে বাধ্য করলেন আপনারা। এতে আমি বিব্রত।
মোকতাদির চৌধুরী বলেন, এ ছাড়া আমার স্ত্রী ফাহিমা খাতুন ১৯৮৩ সাল হতে প্রভাষক থেকে শুরু করে অধ্যাপক হন। ঢাকা শিক্ষা বোর্ডের চেয়ারম্যান এবং মাধ্যমিক ও উচ্চশিক্ষা অধিদপ্তরের মহাপরিচালক (গ্রেড-১ কর্মকর্তা) হিসেবে দীর্ঘদিন নিষ্ঠার সঙ্গে দায়িত্ব পালন করেছেন। তাঁর ব্যক্তিগত সম্পদের (যা তাঁর নিজের অর্জন) নিজস্ব ব্যবস্থাপনা এবং নিজস্ব আয়কর প্রদান করে থাকেন। নিজ যোগ্যতার ভিত্তিতে ২০০৯ সালে তিনি রাজধানীর উত্তরায় প্লট বরাদ্দ পেয়েছেন।
তিনি বলেন, রাজউকের দ্বিতীয় প্রকল্পের নোটিশে স্বামী-স্ত্রী, স্বজন বা নিকটাত্মীয় একইসঙ্গে প্লট বরাদ্দ পেয়েছেন এমন নজির রয়েছে। রাজউকের ঝিলমিল আবাসিক প্রকল্পের প্লট প্রসপেক্টাস-২০১১-এর ২ অনুচ্ছেদের (খ) উপ-অনুচ্ছেদে বলা হয়, “স্বামীর ওপর নির্ভরশীল নন এমন মহিলা কর্তৃক টি.আই.এন এবং নিজস্ব উপার্জিত আয় প্রদর্শনের মাধ্যমে বরাদ্দের জন্য আবেদন করিতে পারিবেন। তিনি পূর্বোক্ত ‘ক’ উপ-অনুচ্ছেদ দ্বারা অর্থাৎ স্বামীর নামে জমি, বাড়ী, ফ্ল্যাট থাকার কারণে আবেদনের অযোগ্য হইবেন না।” পূর্বাচল এবং ঝিলমিল ২টিই রাজউকের প্রকল্প। তাহলে একই রাজউকের ২ ধরনের বিধি থাকবে কেন?
প্রাজ্ঞ এই রাজনীতিবিদ বলেন, প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, আমার এবং আমার স্ত্রীর প্লট দেওয়ার পরিপ্রেক্ষিতে রাজউকের বিধি সংশোধনের উদ্যোগ নেওয়া হয়েছে। অথচ পূর্বাচল প্রকল্প নিয়ে রাজউক এ পর্যন্ত তিনটি নোটিশ দিয়েছে। তৃতীয় নোটিসের প্রেক্ষিতে আবেদন করে ইতিমধ্যে পূর্বাচলে স্বামী-স্ত্রী, স্বজন নিকটাত্মীয় অনেকেই প্লট পেয়েছেন এবং তাদের রেজিস্ট্রিও সম্পন্ন হয়েছে। এমনকি স্বামী ও স্ত্রী উভয়ই সরকারি প্লট পেয়ে বাড়িও করেছেন। এমন ব্যক্তিবর্গের সংখ্যা কম নয়। তাদের মধ্যে সংসদ সদস্য, সাবেক আমলা, ব্যবসায়ী, শিল্পপতি ও তথাকথিত বিশিষ্টজনরাও রয়েছেন। তাদের ক্ষেত্রে কি একই অবস্থা নেই? থাকলে তারা কারা? কেন তাদের নাম নেই এই প্রতিবেদনে?
তিনি বলেন, প্রতিবেদনে আমার প্লট দেওয়ার ক্ষেত্রে কিস্তি পরিশোধে বিলম্বজনিত জরিমানা মওকুফ এবং তুলনামূলক ছোট প্লট পাল্টে বড় প্লট নেওয়ার সুবিধা দেওয়ার অভিযোগ করা হয়েছে রাজউকের বিরুদ্ধে। অথচ রাজউক এটি তার বিধিমালার আওতায়ই করেছে। এখানে বিশেষ সুবিধা দেওয়ার কিছু হয়নি। এমন সুবিধা শুধু আমি নই। শয়ে শয়ে ব্যক্তি এ সুবিধা নিয়েছেন এবং নিচ্ছেন।
মোকতাদির চৌধুরী বলেন, রাজউক সূত্রের বরাত দিয়ে প্রতিবেদনে আরও বলা হয়, স্বামী-স্ত্রীর নামে পৃথক দুটি প্লট বরাদ্দ দেওয়ার সুযোগ রেখে রাজউকের বিধিমালার নতুন খসড়াটি অনুমোদন পেলে আমি ও আমার স্ত্রী ফাহিমা খাতুনের পাশাপাশি অন্য প্রভাবশালী দম্পতিরাও এই সুবিধা নিতে পারবেন। প্রতিবেদক নিশ্চয় এই অন্যদের নামপরিচয় জানেন, কিন্ত উল্লেখ করেননি। এদের মধ্যে সংসদ সদস্য, শিক্ষাবিদ ও সাবেক আমলাসহ অন্যরা রয়েছেন। কেন তাদের নাম উল্লেখ করা হলো না? তার মানে কি তারা প্রথম আলোর সম্পাদক বা সংশ্লিষ্টদের ঘনিষ্টজন? এ থেকেই ধারণা করার সুযোগ থেকে যায়, রাজনৈতিক উদ্দেশ্যপ্রণোদিত হয়েই শুধু আমার নাম জড়িয়ে প্রতিবেদনটি করা হয়েছে। শুধু আমাকে লক্ষ্য বানিয়ে এমন ন্যক্কারজনক প্রতিবেদন করার তীব্র নিন্দা জানাই।
উল্লেখ্য, দৈনিক ভোরের কাগজে ৩১ জুলাই এক উপসম্পাদকীয়তে বেগম বদরুন্নেসা সরকারি কলেজ, ঢাকার প্রাক্তন অধ্যক্ষ খুরশীদ জাহান লিখেছেন, ‘মোকতাদির সাহেব এবং তাঁর স্ত্রী ফাহিমা খাতুনের আয়ের উৎস ছিল আলাদা। উভয়ে সরকারকে সম্পদের পৃথক হিসাব দিতেন এবং পৃথক আয়কর দিতেন। সবকিছু পৃথক থাকা সত্ত্বেও পৃথক প্লট পেতে আপত্তি কোথায়? বিবাহিত হওয়া সত্ত্বেও স্বামী-স্ত্রী দুজন আলাদা সত্তা। তারা জায়া ও পতি অর্থাৎ দম্পতি। পৃথক সত্তা হওয়ার কারণে অনেক সময় স্বামী-স্ত্রীর মধ্যে বিবাহ বিচ্ছেদের সুযোগ থাকে। বিবাহ বিচ্ছেদের ফলে তারা পরস্পর থেকে বিচ্ছিন্ন হয়ে পড়েন। কোনো প্লটের মালিক যদি একজন হয় তাহলে অপরজন তা থেকে বঞ্চিত হয়। বিবাহ বিচ্ছেদের ফলে যিনি সম্পত্তি থেকে বঞ্চিত হন তাঁকে নতুন করে প্লট বরাদ্দ করার কোনো আইন বা ব্যবস্থা রাজউকের আছে বলে আমার জানা নেই।’
খুরশীদ জাহান প্রথম আলোর প্রতিবেদনের প্রতি ইঙ্গিত করে লেখেন, ‘উক্ত রিপোটে রাজউকের ১৯৬৯ সালের রূলসের কথা উল্লেখ করা হয়েছে। ১৯৬৯ সালে বাংলাদেশ ছিল একটি উপনিবেশিক রাষ্ট্র। স্বাধীন বাংলাদেশে জনস্বার্থবিরোধী উপনিবেশিক আইন অনুসৃত হতে পারে না।’