সরকারের সর্বশেষ ভাষ্য অনুযায়ী, বাংলাদেশে ক্ষুদ্র নৃগোষ্ঠীর সংখ্যা ১৬ লাখ ৫০ হাজার ১৫৯ জন। এর মধ্যে চট্টগ্রাম বিভাগে সর্বোচ্চ ৯ লাখ ৯০ হাজারের বেশি নৃগোষ্ঠীর বসবাস। এবং সর্বনিম্ন বরিশাল বিভাগে। ২৭ জুলাই রাজধানীর বঙ্গবন্ধু আন্তর্জাতিক সম্মেলন কেন্দ্রে (বিআইসিসি) এক অনুষ্ঠানে বাংলাদেশ পরিসংখ্যান বু্যরোর (বিবিএস) প্রথম ডিজিটাল ‘জনশুমারি ও গৃহগণনা ২০২২’-এর প্রাথমিক প্রতিবেদন প্রকাশ অনুষ্ঠানে এ তথ্য তুলে ধরা হয়। চট্টগ্রাম বিভাগের মোট জনসংখ্যার ২ দশমিক ১১ শতাংশ ক্ষুদ্র নৃগোষ্ঠী, যা সকল বিভাগের মধ্যে সর্বোচ্চ এবং এ হার বরিশাল বিভাগে সর্বনিম্ন। ক্ষুদ্র নৃগোষ্ঠী প্রসঙ্গে আরেকটি তাত্পর্যপূর্ণ তথ্য হলো, ‘আদিবাসী’ শব্দটি ব্যবহার না করতে সরকারের পক্ষ থেকে প্রজ্ঞাপন জারি করা হয়েছে। এতে বলা হয়েছে, বাংলাদেশের সংবিধানের পঞ্চদশ সংশোধনীতে বাংলাদেশে বসবাসরত বিভিন্ন ছোট ছোট সম্প্রদায়-গোষ্ঠীকে উপজাতি, ক্ষুদ্র জাতিসত্তা ও নৃগোষ্ঠী বলে আখ্যায়িত করা হয়েছে।
প্রসঙ্গত, ৯ আগস্ট ২০২২ তারিখ আন্তর্জাতিক আদিবাসী দিবস উপলক্ষ্যে আয়োজিত টকশোতে অংশগ্রহণকারী বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষক, বিশেষজ্ঞ এবং সংবাদপত্রের সম্পাদকসহ সুশীল সমাজের অন্যান্য ব্যক্তিবর্গকে বাংলাদেশের ক্ষেত্রে ‘আদিবাসী’ শব্দটি ব্যবহার না করার বিষয়ে সাংবিধানিক বাধ্যবাধকতা সম্পর্কে প্রচারের জন্য নির্দেশক্রমে অনুরোধ করা হয়েছে। বাংলাদেশে পার্বত্য চট্টগ্রাম এবং সমতলের বিভিন্ন জায়গায় যেসব ক্ষুদ্র নৃগোষ্ঠী বসবাস করেন তারা ‘আদিবাসী’ কি না তা নিয়ে কিছু তর্ক-বিতর্ক প্রায়ই সামনে আসে। বিশেষত, প্রতি বছর বিশ্ব আদিবাসী দিবসের প্রাক্কালে সে বিতর্ক মাথাচাড়া দিয়ে ওঠে। যদিও বাংলাদেশে সরকারিভাবে ‘আদিবাসী’ শব্দটির অস্তিত্বই স্বীকৃত নয়। কিন্তু বাংলাদেশে বিভিন্ন ক্ষুদ্র জাতিসত্তার জনগোষ্ঠী নিজেদের ‘আদিবাসী’ হিসেবে পরিচয় দিতে চেষ্টা করেন। তারা মনে করেন, বাংলাদেশের ভূখণ্ডে, বিশেষ করে পার্বত্য চট্টগ্রাম এলাকায়, তারাই ‘আদিবাসী’। কিন্তু পার্বত্য চট্টগ্রাম অঞ্চলে এবং বাংলাদেশের অন্যত্র যেসব ক্ষুদ্র নৃগোষ্ঠী বসবাস করছে তারা আসলেই সেখানকার আদিবাসী কিনা এ নিয়ে ঐতিহাসিক ও রাজনৈতিক মতভেদ যেমন আছে তেমনি নৃবিজ্ঞানীদের মাঝেও আছে বিভক্তি। বাংলাদেশে অধিকাংশ গবেষক মনে করেন, ক্ষুদ্র নৃগোষ্ঠী মানেই আদিবাসী নয়। নৃগোষ্ঠী হলেই আদিবাসী হিসেবে চিহ্নিত হওয়ায় কারণ নেই। কেননা বর্তমান বাংলাদেশ ভূখণ্ডে বাঙালিরাও ছিল এবং বিভিন্ন জনগোষ্ঠীও এ অঞ্চলে কালক্রমে ও পর্যায়ক্রমে এসেছে। এই আগমন বা অভিবাসন হলো সামাজিক গতিশীলতা, অর্থনৈতিক তত্পরতা, রাজনৈতিক কার্যকারণের ফলাফল। ফলে কোনো একটি নির্দিষ্ট এলাকায় কোন অধিবাসী আগে বা পরে এসেছে, সেটার ভিত্তিতে বাংলাদেশের জনগণকে বিভক্তকারী শব্দ যেমন, কাউকে ‘আদিবাসী’ কিংবা কাউকে ‘বহিরাগত’ আখ্যায়িত করা অত্যন্ত আপত্তিকর ও বিপজ্জনক এবং তা জাতীয় ঐক্য ও সংহতির নিরিখে আদৌ যুক্তিযুক্ত নয়।
বাংলাদেশে ক্ষুদ্র জাতিসত্তার ব্যক্তিদের নিয়ে একটি সংগঠন আছে, যার নাম ‘বাংলাদেশ আদিবাসী ফোরাম’। এই সংগঠনটির প্রতি বাংলাদেশের বিভিন্ন অপ্রধান রাজনৈতিক দল ও সংগঠনের প্রত্যক্ষ সমর্থন রয়েছে। এই সংগঠনের সঙ্গে সরাসরি যুক্ত আছে সন্তু লারমার নেতৃত্বাধীন আঞ্চলিক রাজনৈতিক দল পার্বত্য চট্টগ্রাম জনসংহতি সমিতি, যারা সরকারের সঙ্গে ১৯৯৭ সালে পার্বত্য চট্টগ্রাম শান্তিচুক্তি সম্পন্ন করেন। যে চুক্তির সর্বত্র ‘ট্রাইবাল’ বা ‘উপজাতি’ রয়েছে, কোথাও ‘আদিবাসী’ নেই। এমনকি, ব্রিটিশ ও পাকিস্তান আমলে পার্বত্য চট্টগ্রামবিষয়ক আইন, বিধি ও যাবতীয় সরকারি দলিলপত্রে ‘ট্রাইবাল’ বা ‘উপজাতি’ রয়েছে, ‘আদিবাসী’ নামক শব্দের কোনো অস্তিত্বই নেই। এমনকি, যুগে যুগে উপজাতি, ক্ষুদ্র নৃগোষ্ঠী, সংখ্যালঘু জাতিসত্তা ইত্যাদি বিভিন্ন নামে অভিহিত হলেও, ইতিহাসের কোনো সময়েই, কোনো ব্যক্তি বা প্রতিষ্ঠানই এদেরকে কখনোই ‘আদিবাসী’ (Indigenous) বা ‘আদিম অদিবাসী’ (Aborigines) বা ‘ভূমিপুত্র’ (Son of Soil) হিসেবে দাবি করেননি।
লক্ষণীয় বিষয় হলো, পার্বত্য চট্টগ্রাম তথা বাংলাদেশের পটভূমিতে ‘আদিবাসী’ নামক শব্দের উদ্ভব ও ব্যবহার অতি সাম্প্রতিক এবং তা উপজাতি তথা ক্ষুদ্র নৃগোষ্ঠীর একটি বিচ্ছিন্ন রাজনৈতিক অবস্থানের পরিচায়ক। অতীতে তারা তাদের রাজনৈতিক আন্দোলনে যেমনভাবে ‘জুম্ম জাতীয়তাবাদ’ নামক ধারণাটি ব্যবহার করেছিলেন, বর্তমানেও ‘আদিবাসী’ শব্দটি ব্যবহারের চেষ্টা করছেন। ঐতিহাসিক, সামাজিক, নৃতাত্ত্বিক বাস্তবতা না থাকলেও ‘আদিবাসী’ শব্দের মধ্যে চমক রয়েছে, যা ক্ষুদ্র নৃগোষ্ঠীর মানুষের মধ্যে রাজনৈতিক স্পর্শকাতর সৃষ্টির লক্ষ্যে সাম্প্রতিক সময়ে ব্যবহার করার চেষ্টা চালানো হচ্ছে। তদুপরি এতে জাতিগত বিভেদ-বিভক্তি, সাম্প্রদায়িক বিদ্বেষ, উসকানি ও উত্তেজনা সৃষ্টিকারী উপাদান রয়েছে। কারণ, ‘আদিবাসী’ শব্দটিকে রাজনৈতিকভাবে বেশ স্পর্শকাতর। সরকারের ভেতর অনেকেই মনে করেন। দেশের কোনো একটি অংশের কিছু নাগরিককে ‘আদিবাসী’ হিসেবে স্বীকৃতি দিলে বৃহত্তর জনগোষ্ঠী বিশেষ করে বাঙালিদের মধ্যে বিরূপ প্রতিক্রিয়া তৈরি হওয়া খুবই স্বাভাবিক।
বস্তুত ২০০৭ সালের ১৩ সেপ্টেম্বর ‘আদিবাসী জনগণের অধিকার বিষয়ে জাতিসংঘের ঘোষণাপত্র ২০০৭’ গৃহীত হওয়ার পরপরই উপজাতি গোষ্ঠীর একাংশ আন্দোলনের নতুন করে প্রাণপ্রবাহ সৃষ্টি করে। যুগ যুগ ধরে উপজাতি হিসেবে পরিচিত ক্ষুদ্র জাতিগোষ্ঠীগুলোকে হঠাত্ আদিবাসী অভিধা দেওয়ার জন্য বিভিন্ন মহলে প্রচার-প্রচারণা ও চেষ্টা চালাতে থাকে। কিছু কিছু ব্যক্তি ও সংগঠনের পাশাপাশি দুর্নীতিবিরোধী সংগঠন টিআইবি (ট্রান্সপারেন্সি ইন্টারন্যাশনাল বাংলাদেশ) উপজাতিদের ‘আদিবাসী’ স্বীকৃতির দাবি জানিয়েছে।
বাংলাদেশে ক্ষুদ্র জাতিগোষ্ঠীদের ‘আদিবাসী’ রূপে দাবির যৌক্তিকতা অনুধাবনের জন্য ‘আদিবাসী’ শব্দের ব্যবহার বাংলাদেশের জন্য কতটা প্রাসঙ্গিক তা জানা অত্যন্ত জরুরি। প্রথমত, এক্ষেত্রে সাধারণত জাতিসংঘের আদিবাসীবিষয়ক ঘোষণাপত্র এবং আইএলও কনভেনশনের দোহাই দেওয়া হয়ে থাকে; কিন্তু জেনে রাখা ভালো যে, এসব দলিলে ‘আদিবাসী’র সংজ্ঞা স্পষ্ট নয় এবং এই ঘোষণাপত্র এবং কনভেনশনের কোনোটির সঙ্গেই বাংলাদেশ নেই। জাতিসংঘের ফ্যাক্টশিটে বলা হয়েছে, আদিবাসীদের বৈচিত্রে্যর কথা বিবেচনা করে, জাতিসংঘের কোনো সংস্থাই এই শব্দটির কোনো আনুষ্ঠানিক সংজ্ঞা প্রণয়ন করেনি। সংজ্ঞা স্পষ্ট না করেই আদিবাসীদের বিভিন্ন ধরনের অধিকার এবং সুবিধাদির কথা বিবৃত হয়েছে। এ কারণে ‘আদিবাসী’ শব্দটিকে সুযোগসন্ধানী চক্র তাদের স্বার্থ আদায়ের হাতিয়ার হিসেবে ব্যবহার করতে পারে।
পৃথিবীতে মানবাধিকার, গণতন্ত্র, বাক-স্বাধীনতা ও সামাজিক ন্যায় বিচার প্রতিষ্ঠায় যেসব দেশ জোরালো ভূমিকা পালন করছে সেসব দেশও আইএলও কনভেনশন-১৬৯ এবং জাতিসংঘ আদিবাসীবিষয়ক ঘোষণাপত্র-২০০৭ গ্রহণ করেনি। তারা সংবিধানের সঙ্গে সাংঘর্ষিক এবং সমাজে বিভক্তি সৃষ্টি করে এমন কোনো কিছু করতে নারাজ। এসব দেশের মধ্যে বাংলাদেশও রয়েছে। এরূপ সিদ্ধান্ত বাংলাদেশ সরকারের দূরদর্শিতার পরিচায়ক তা বলাই যায়। কেননা, ‘আদিবাসী’ শব্দটি রাজনৈতিকভাবে বেশ স্পর্শকাতর। সরকারের ভেতর অনেকেই মনে করেন দেশের কোনো একটি অংশকে ‘আদিবাসী’ হিসেবে সংবিধানে স্বীকৃতি দিলে বৃহত্তর জনগোষ্ঠী বিশেষ করে বাঙালিদের মধ্যে বিরূপ প্রতিক্রিয়া তৈরি হতে পারে। সরকারের যুক্তি হচ্ছে, বাংলাদেশের ভূখণ্ডে বসবাসরত সবাই আইনের চোখে বাংলাদেশের নাগরিক। রাষ্ট্র সবাইকে সমান চোখে দেখবে। তদুপরি, অনগ্রসর অংশ হিসেবে ক্ষুদ্র জাতিসত্তার মানুষজনকে চাকরি ও উচ্চশিক্ষা এবং বিভিন্ন ক্ষেত্রে সরকার বাড়তি সুবিধাও দিচ্ছে। ফলে বাংলাদেশের নীতিনির্ধারক ও রাজনীতিবিদগণ স্পষ্টত মনে করেন, বাংলাদেশে একশ্রেণির মানুষ ক্ষুদ্র নৃগোষ্ঠীর সদস্যদের সঙ্গে ‘আদিবাসী’ শব্দটি জুড়ে দেওয়ার মাধ্যমে বিতর্ক উসকে দিয়ে জাতিবিরোধী হীনস্বার্থ চরিতার্থ করতে চায়।
এমতাবস্থায়, ঐতিহাসিক বাস্তবতায় এবং সংবিধানের পঞ্চদশ সংশোধনীতে আদিবাসী শব্দটি না থাকায় বিভিন্ন জেলা প্রশাসকের কাছে স্থানীয় সরকার, পল্লি উন্নয়ন ও সমবায় মন্ত্রণালয় থেকে পাঠানো চিঠিতে ‘বিশ্ব আদিবাসী দিবস’ উদ্যাপনে সরকারের কোনো পর্যায়ের কর্মকর্তাদের সম্পৃক্ত না হওয়ার নির্দেশনা দেওয়া হয়। যদিও ‘আদিবাসী জাতিগোষ্ঠীর অধিকারবিষয়ক জাতিসংঘ ঘোষণাপত্র ২০০৭’ অনুসারে তাদের ৪৬টি অধিকারের কথা লিপিবদ্ধ হয়েছে। এই ঘোষণাপত্রে আদিবাসী জাতিগোষ্ঠীর সংজ্ঞা নির্ধারিত হয়নি বা সুস্পষ্টভাবে সংজ্ঞায়িত হয়নি। এমতাবস্থায়, শান্তি, সম্প্রীতি ও উন্নয়ন ক্ষতিগ্রস্ত করে এবং দেশের জাতিগত সংহতি বিনষ্ট হয়, এমন কোনো পদক্ষেপ কোনো পক্ষের দিক থেকে গ্রহণ করা মোটেও সমীচীন হবে না। বিশেষত, পার্বত্য চট্টগ্রামে দীর্ঘ দুই যুগের সশস্ত্র সংঘাত ও ভ্রাতৃঘাতী রক্তপাতের অন্ধকার অধ্যায় পেরিয়ে শান্তি, সম্প্রীতি ও উন্নয়নের যে ধারা অব্যাহত রয়েছে, তাকে অটুট রাখা কেবল সরকারই নয়, পাহাড়ের সকল শান্তিকামী-বিবেকবান নাগরিকের পবিত্র দায়িত্ব। ফলে পার্বত্য চট্টগ্রাম তথা দেশের ক্ষুদ্র নৃজনগোষ্ঠীকে ‘আদিবাসী’ করার অগ্রহণযোগ্য ও অনৈতিহাসিক দাবির মাধ্যমে হিংসা, উত্তেজনা, বিদ্বেষ, বিভক্তি প্রচার ও প্রসারের পরিবর্তে পার্বত্যাঞ্চলে শান্তি, সম্প্রীতি ও উন্নয়নের ধারাকে আরো বেগবান ও সুদৃঢ় করে দেশ ও মানুষের প্রকৃত কল্যাণ সাধনে ব্রতী হওয়াই সবার জন্য কল্যাণকর।
লেখক : প্রফেসর, রাজনীতি বিজ্ঞান বিভাগ, চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়