বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান ও মুক্তিযোদ্ধারা যে ভাবধারার রাষ্ট্র চেয়েছিলেন, সেখান থেকে বাংলাদেশ পথভ্রষ্ট হয়েছে। গত একযুগে ধর্ম অবমাননার অভিযোগ তুলে হিন্দুসহ অন্যান্য সম্প্রদায়ের ওপর যেভাবে হামলা হয়েছে, সেটিই এর প্রমাণ। ‘বঙ্গবন্ধু ও অসাম্প্রদায়িক বাংলাদেশ’ শীর্ষক এক সভায় অংশ নিয়ে বক্তারা এ অভিমত জানান।
আজ শনিবার রাজধানীর জাতীয় প্রেসক্লাবে সেক্টর কমান্ডারস ফোরাম-মুক্তিযুদ্ধ ৭১ এই সেমিনারের আয়োজন করে। বক্তারা বলেন, একযুগ ধরে বঙ্গবন্ধুর দল আওয়ামী লীগ ক্ষমতায় থাকলেও অপশক্তি সুকৌশলে রাষ্ট্রযন্ত্রের ভেতর ঢুকে পড়েছে। কিছু দিন পরপর পরিকল্পিতভাবে দেশের বিভিন্ন জেলায় সাম্প্রদায়িক হামলা চালানো হচ্ছে। এটা বাংলাদেশের জন্য অশনিসংকেত।
মুক্তিযুদ্ধ জাদুঘরের ট্রাস্টি ডা. সারওয়ার আলী বলেন, ১৯৭২ সালের নভেম্বর মাসে বঙ্গবন্ধু যখন জাতীয় পরিষদে সংবিধান পেশ করেন, তখন স্পষ্টভাবে ধর্মনিরপেক্ষতার সংজ্ঞা দিয়েছিলেন। তিনি বলেছিলেন, হিন্দুরা সনাতন ধর্ম পালন করতে পারবেন, খ্রিষ্টানরা খ্রিষ্টধর্ম পালন করবেন। মুসলমানরা ইসলাম ধর্ম পালন করবেন। কিন্তু ধর্ম নিয়ে কোনো রাজনীতি করতে পারবেন না। এখন ৫০ বছর পর দাঁড়িয়ে কী বলবেন, সেই কথা কি রাখা গেছে?
দুর্গাপূজা ঘিরে দেশের বিভিন্ন স্থানে হওয়া সাম্প্রদায়িক হামলার কথা উল্লেখ করেন সারওয়ার আলী। তিনি বলেন, গত ১২ বছর ধরে একই চিত্রনাট্যের নাটক দেখছি। রামু থেকে শুরু হয়েছে। একজন অর্ধশিক্ষিত অশিক্ষিত ছেলের ফেসবুক আইডি হ্যাক করে স্ট্যাটাস দেওয়া হচ্ছে এবং তারপর কিছু মানুষ স্ট্যাটাস দেখেনি, কিন্তু ধর্মানুভূতিতে আঘাত হয়েছে। তারপরে সর্বদলীয় একটা লুণ্ঠন হয়। রামু থেকে নাসিরনগর, সর্বশেষ নড়াইল। বঙ্গবন্ধুর আদর্শের জায়গার বাংলাদেশ কি রইল?
সারওয়ার আলী বলেন, গত ১২ বছর ধরে অন্তত যে ঘটনাগুলো ঘটছে, তাতে বাংলাদেশ বঙ্গবন্ধুর যে ভাবাদর্শের রাষ্ট্র, আমরা যাঁরা মুক্তিযুদ্ধে অংশগ্রহণ করি, তাঁরা যে ভাবধারার রাষ্ট্র গঠন করতে চেয়েছি, সেখান থেকে রাষ্ট্রটি পথভ্রষ্ট হয়েছে।
মুক্তিযুদ্ধ জাদুঘরের ট্রাস্টি মফিদুল হক বলেন, অসাম্প্রদায়িক বাংলাদেশের জন্য বঙ্গবন্ধু যেটা বলেছিলেন, যেটার মূলভিত্তি হবে রাজনীতি এবং ধর্মের মধ্যে কোনো রকম সংযোগ রাখা যাবে না। ধর্মভিত্তিক রাজনৈতিক দল নিষিদ্ধ হবে। বাংলাদেশ সেভাবেই যাত্রা শুরু করেছিল। সেখানে আজকে আবার নানাভাবে ধর্মকে টেনে এনে সমাজে পশ্চাৎপদতা, সংঘাত সেইগুলোকে পরিকল্পিতভাবে ঘটানো হচ্ছে।
মফিদুল হক বলেন, বিগত এক যুগ ধরে রামু থেকে নাসিরনগর, সুনামগঞ্জ হয়ে নড়াইল, প্রতিটা ঘটনার পেছনে আছে একটা মিথ্যাচার। প্রতিটা ঘটনার পেছনে আছে একটা সুপরিকল্পিত উদ্দেশ্য। তার মোকাবিলা করার জন্য যে শক্তি, তা আমরা বঙ্গবন্ধুর কাছ থেকে আহরণ করতে পারি। সেই শক্তির অসাধারণ প্রকাশ তিনি তাঁর জীবন দিয়ে দেখিয়ে গেছেন।
সামাজিক যোগাযোগমাধ্যম সব ধরনের ঘৃণা–বিদ্বেষ ছড়ানোর একটি বড় ক্ষেত্র হয়ে উঠেছে বলে মনে করেন মফিদুল হক। তিনি বলেন, সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে ধর্মকে অত্যন্ত বিকৃতভাবে ব্যবহার করা হচ্ছে। আন্তর্জাতিক আইনে আছে এবং আমাদের সংবিধানেও আছে সমাজে সংঘাত সৃষ্টি করা যাবে না। অপরের আদর্শ বা ধর্মকে চিহ্নিত করে কোনো রকম সামাজিক অশান্তি তৈরি করা যাবে না। মানুষকে সহিংসতার দিকে প্ররোচিত করা যাবে না। কিন্তু এই ঘটনাগুলো ঘটছে। আজ মিথ্যাচারের একটা ভিত্তি হয়ে গেছে সোশ্যাল মিডিয়া।
সামাজিক যোগাযোগমাধ্যম ব্যবহার করে কেউ যেন কোনো ধরনের ধর্মীয় উসকানি দিতে না পারে, সে জন্য আইন করা প্রয়োজন বলে মন্তব্য করেন প্রাবন্ধিক মফিদুল হক।
সেক্টর কমান্ডারস ফোরামের মহাসচিব বীর মুক্তিযোদ্ধা হারুন হাবীব মনে করেন, বর্তমানে অসাম্প্রদায়িক বাংলাদেশের বিরুদ্ধে একটি পরিকল্পিত আগ্রাসন চলছে। তিনি বলেন, একটি ভয়াবহ অশনিসংকেত আমরা দেখতে পাচ্ছি। এর জন্য পরিকল্পিত প্রতিরোধ জরুরি। ধর্মের সামাজিক ও রাজনৈতিক অপব্যবহার রোধ করতে কঠোর আইনি পদক্ষেপ নেওয়ার দাবি করেন হারুন হাবীব।
সেমিনারে প্রবন্ধ উপস্থাপন করেন সেক্টর কমান্ডারস ফোরামের সাংগঠনিক সম্পাদক বীর মুক্তিযোদ্ধা মেজর জেনারেল (অব.) মোহাম্মদ আলী সিকদার। অন্যদের মধ্যে বক্তব্য রাখেন সেক্টর কমান্ডারস ফোরামের নির্বাহী সভাপতি বীর মুক্তিযোদ্ধা মো. নুরুল আলম, জ্যেষ্ঠ সাংবাদিক অজয় দাশগুপ্ত, যুগ্ম মহাসচিব বীর মুক্তিযোদ্ধা আবুল কালাম আজাদ পাটোয়ারী প্রমুখ।