সাধারণ মানুষের জন্য জেলা প্রশাসকের কার্যালয়ের (ডিসি অফিস) দরজা-জানালা উন্মুক্ত রাখতে বলেছেন হাইকোর্ট। একইসঙ্গে আদালত কুষ্টিয়া জেলা প্রশাসককে সতর্ক করে তার অফিসের দরজা-জানালার পর্দা সরিয়ে ফেলতে বলেছেন উচ্চ আদালত।
আদালত অবমাননা সংক্রান্ত এক মামলায় কুষ্টিয়া জেলা প্রশাসক, ডিসি, পুলিশ সুপারসহ (এসপি) ৫ জনের বিষয়ে শুনানিতে সোমবার (২২ আগস্ট) ডিসিকে উদ্দেশ করে এমন মন্তব্য করেন হাইকোর্ট।
তবে ব্যক্তিগত হাজিরা থেকে কুষ্টিয়া জেলা প্রশাসককে অব্যাহতি দিলেও বাকিদের আগামী ২৪ অক্টোবর হাজির থাকতে হবে। একই সঙ্গে ওইদিন শুনানির জন্য পরবর্তী দিন রেখেছেন আদালত। এ সময় কুষ্টিয়ার পুলিশ সুপার, ব্র্যাক ব্যাংকের এমডি ও নিলামকৃত সম্পত্তি গ্রহণকারী ব্যবসায়ীও উপস্থিত ছিলেন।
১৩৩ কোটি টাকার সম্পত্তি ১৫ কোটিতে নিলামে তোলার ঘটনায় আদালত অবমাননা সংক্রান্ত মামলায় কুষ্টিয়ার ডিসি-এসপিসহ ৪ জন হাজির হলে বিচারপতি আবু তাহের মো. সাইফুর রহমান ও বিচারপতি এ কে এম রবিউল হাসানের সমন্বয়ে গঠিত বেঞ্চ এমন মন্তব্য করে ডিসিকে সতর্ক করেন।
আদালতে এদিন ডিসি ও এসপির পক্ষে শুনানিতে ছিলেন অ্যাডভোকেট মুন্সী মনিরুজ্জামান ও অ্যাডভোকেট ইউসুফ খান। ব্র্যাক ব্যাংকের এমডির পক্ষে ছিলেন অ্যাডভোকেট সৈয়দ মিনহাজুল হক এবং নিলামক্রেতা আব্দুর রশিদের পক্ষে ছিলেন আইনজীবী অ্যাডভোকেট নুরুল আমিন। ব্যবসায়ী শফিকুলের পক্ষে ছিলেন ব্যারিস্টার রাগীব রউফ চৌধুরী।
আদলতে ব্যারিস্টার রাগিব রউফ চৌধুরী বলেন, একটি সম্পদের নিলামের প্রক্রিয়া চ্যালেঞ্জ করে আমরা হাইকোর্টের রিট দায়ের করি। ওই রিটের শুনানি নিয়ে হাইকোর্ট নিলাম প্রক্রিয়া স্থগিত করেন। হাইকোর্টের এ আদেশের পরও নিলামক্রেতা লোকজন নিয়ে নিলামকৃত সম্পত্তি দখল করেন। আদালতের আদেশ অমান্য করার বিষয়টি আমরা আদালতের নজরে আনি। তখন আদালত ডিসি-এসপিসহ সংশ্লিষ্ট সবাইকে হাজির হতে নির্দেশ দেন। আদালতের নির্দেশ অনুযায়ী কুষ্টিয়ার ডিসি-এসপিসহ সংশ্লিষ্টরা আদালতে হাজির হন। এ মামলায় পরবর্তী শুনানির জন্য ২৪ অক্টোবর দিন ঠিক করে দিয়েছেন আদালত। ডিসি ছাড়া বাকিদের ওই দিন হাজির থাকতে বলেছেন আদালত।
ডিসি ছাড়া অন্যরা হলেন পুলিশ সুপার, ব্র্যাক ব্যাংকের এমডি, সদর থানার ওসি, নিলামক্রেতা আব্দুর রশিদ। তবে কোভিডে আক্রান্ত থাকায় ওসি হাজির হতে পারেননি।
আদালত ডিসিকে উদ্দেশ করে বলেন, শুনানির সময় আদেশ শেষে কুষ্টিয়ার জেলা প্রশাসককে আদালত ডায়াসের কাছে ডেকে নেন। এ সময় আদালত বলেন, আপনাকে আদালতে আসতে হবে না। তবে আপনাকে সতর্ক করছি, সতর্ক করছি। সাধারণ জনগণের জন্য আপনাদের দরজা উন্মুক্ত রাখবেন। দরজা-জানালায় কোনো পর্দা থাকবে না। মানুষ যাতে আপনাকে দেখতে পারে, আপনি কী করছেন। আপনি বসে আছেন এটা যেন সাধারণ মানুষ দেখতে পারে। সাধারণ মানুষ যেন সহজেই আপনার কাছে যেতে পারে।
‘আমাদের অভিজ্ঞতা আছে, ডিসি অফিসে সাধারণ মানুষ যেতে পারে না। দরজা-জানালায় ভারি পর্দা দেওয়া থাকে। যেকোনো মানুষ যাতে আপনার কাছে যেতে পারে সেজন্য কোনো ভারি পর্দা থাকবে না।’
এ সময় ডিসিকে উদ্দেশ করে বিচারক বলেন, আপনারা লাক্সারিয়াস জীবনযাপন করেন। সাধারণ মানুষের সঙ্গে আপনাদের তেমন যোগাযোগ থাকে না। সব শ্রেণির মানুষ যাতে আপনাকে দেখতে পারে আপনি বসে কাজ করছেন। লুঙ্গি পরেও যেন একজন মানুষ আপনার কাছে যেতে পারে।
‘ভালো কাজ করুন। চুরি, ডাকাতি গুন্ডামি, দখলবাজি যদি চলে আর এটা যদি আপনার নজরে আসে সঙ্গে সঙ্গে আপনি দেখবেন।’
আদালত বলেন, অভিযোগ শুনেই আপনাকে ব্যবস্থা নিতে হবে। একজন জেলা প্রশাসক (ডিসি) সরকারের হার্ট। আপনাদের দায়িত্ব অনেক। আপনাদের কাজের ওপরে সরকারের ভাবমূর্তি নির্ভর কর। সরকারের সব কাজ আপনাদের দিয়েই বাস্তবায়ন হয়। জানি আপনারা অনেক কাজ করেন, কিন্তু তারপরও সাধারণ মানুষের জন্য আপনাদের দরজা খোলা রাখুন।
আদালত আরও বলেন, সেই দিন এ মামলায় অভিযোগকারী আপনার কাছে অভিযোগ নিয়ে গিয়েছিলেন। কিন্তু আপনার কাছ পর্যন্ত যেতে পারেননি। আপনার অফিসের লোকজন অভিযোগ গ্রহণ করেননি। সেদিন যদি আপনি অভিযোগটি শুনতে পেতেন তাহলে হয়তো এতদূর আসতে হতো না। এজন্য আপনাদের দরজা,-জানালায় কোনো পর্দা থাকবে না। আমরা এটা দেখবো।
মামলা সূত্রে জানা যায়, ব্যবসায়ী শফিকুল ইসলামের মালিকানাধীন বিশ্বাস ট্রেডার্স, ভিআইপি রাইস মিল ও ভিআইপি ফ্লাওয়ার মিলসহ বসতভিটা আট একর জমির ওপর অবস্থিত। ব্র্যাক থেকে ৪২ কোটি টাকা ঋণ নিয়ে তিনি ব্যবসাপ্রতিষ্ঠান গড়ে তোলেন। পরে ৯০ কোটি টাকা পরিশোধ করেন। ঋণ পরিশোধে ব্যর্থ হলে তার সম্পত্তির ওপর নিলাম ডাকা হয়। শফিকুলের সম্পত্তির মোট মূল্য ১৩৩ কোটি টাকা। যা নিলামে ১৫ কোটি টাকায় বিক্রি করে দেওয়া হয়। নিলামের প্রেক্ষিতে গত ৪ আগস্টের মধ্যে সম্পত্তি বুঝিয়ে দিতে বলা হয়। পরে ওই সিদ্ধান্ত চ্যালেঞ্জ করে হাইকোর্টে রিট করা হয়। ওই রিটের শুনানি নিয়ে গত ২ আগস্ট হাইকোর্ট নিলাম পরবর্তী সব কার্যক্রম স্থগিত করেন।