হেফাজতে মৃত্যু : দায় এড়াতে তৎপর পুলিশ

নিজস্ব প্রতিবেদক

রাজধানী ঢাকার হাতিরঝিল থানা হেফাজতে যুবক সুমন শেখের মৃত্যুর ঘটনার দায় এড়াতে পুলিশ নিজেই সিসি ক্যামেরার ফুটেজ সাংবাদিকদের মধ্যে বিলি করছে। তারা এটাকে আত্মহত্যা বলে চালিয়ে দিতে চাইছে।

কিন্তু দেশের প্রচলিত আইনে হেফাজতে যেকোনো ধরনের মৃত্যু এবং নির্যাতনই অপরাধ। এরজন্য প্রথমেই মামলা নিতে হবে। মামলা না নেওয়াও একটি অপরাধ বলে জানান আইন বিশ্লেষকেরা।

সুমনের পরিবারের সদস্যদের অভিযোগ, সুমনকে নির্যাতন চালিয়ে হত্যা করা হয়েছে। সুমন রামপুরার যে প্রতিষ্ঠানের শোরুমে ভ্যান চালকের কাজ করতেন সেই প্রতিষ্ঠানের চুরি যাওয়া ৫৩ লাখ টাকায় দায় এড়াতে ওই শোরুমের ম্যানেজার পুলিশকে দিয়ে সুমনকে হত্যা করিয়েছে বলে তার পরিবারের অভিযোগ।

চুরির মামলাটি হয় ১৫ আগস্ট। মামলার এজাহারে সুমনের নাম নেই। মামলার পর শোরুমের ক্যাশিয়ারসহ তিনজনকে আটক করে হাতিরঝিল থানা পুলিশ। থানার ওসি আবদুর রশিদ দাবি করেন, তাদের দেয়া তথ্যের ভিত্তিতে ১৯ আগস্ট সুমনকে আটক করা হয়। রাতে তাকে নিয়ে অভিযান চালিয়ে চালিয়ে তার বাসা থেকে তিন লাখ টাকাও উদ্ধার করা হয়। দিবাগত রাত তিনটার দিকে তিনি থানা হাজতে নিজের ট্রাউজার খুলে গলায় ফাঁস লাগিয়ে আত্মহত্যা করেন। পুলিশ রবিবার এ সংক্রান্ত সিসি ক্যামেরার ফুটেজ সাংবাদিকদের দিয়েছে আত্মহত্যা প্রমাণের জন্য।

কিন্তু সুমনের শ্যালক মোশাররফ হোসেন জানান, ওই ফুটেজ আমাদেরও ডেকে নিয়ে দেখানো হয়েছে। কিন্তু তাতে সুমন যে আত্মহত্যা করেছে তা প্রমাণিত হয় না। কারণ ফুটেজে দেখানো হয়েছে সুমন লকআপের গেট বেয়ে উপরে উঠছে। সে আত্মহত্যা করেছে তার কোনো ফুটেজ নেই। তার কথা, সুমনকে আটকের পর আমাদের সাথে কোনো যোগাযোগ করতে দেয়া হয়নি। আমাদের থানায়ই ঢুকতে দেওয়া হয়নি। মৃত্যুর পর আমরা হাসপাতাল মর্গ থেকে লাশ নিতে গেলে আমাদের শর্ত দেয়া হয় লাশ ঢাকায় নয়, গ্রামের বাড়িতে নিয়ে দাফন করতে হবে। এখন আমরা সিদ্ধান্ত নিয়েছি মামলা ও বিচার ছাড়া আমরা লাশ নেবো না। তাকে নির্যাতন চালিয়ে হত্যা করা হয়েছে। সে চুরি করেনি। এটা একটা ষড়যন্ত্র। তাকে ষড়যন্ত্রমূলকভাবে হত্যা করা হয়েছে।

তিনি বলেন, থানা আমাদের মামলা না নেয়ায় রোববার আমরা আদালতে গিয়েছিলাম মামলা করতে। কিন্তু কোনো আইনজীবীর সহায়তা পাইনি। আজ (সোমবার) সকাল থেকে আমরা সিএমএম কোর্টে বসে আছি মামলা করার আশায়। কী হবে জানি না।

অবশ্য সোমবার হাতিরঝিল থানার ইন্সপেক্টর (অপারেশন) আব্দুল কুদ্দুস জানান বিকেলে হাসপাতাল মর্গ থেকে লাশ তাদের পরিবারের কাছে হস্তান্তর করা হয়েছে।

আইনজীবীরা যা বলছেন:

সুপ্রিম কোর্টের আইনজীবী ইশরাত হাসান বলেন, এই ঘটনায় মামলা না নেয়াও একটা অপরাধ। ২০১৩ সালের হেফাজতে নির্যাতন এবং মৃত্যু নিবারণ আইন অনুযায়ী অবশ্যই মামলা নিতে হবে। এই মামলা থানা না নিলে এসপিকে নিতে হবে অথবা আদালত নেবেন।

তার কথা, মৃত্যু কীভাবে হয়েছে সেটা তদন্তের বিষয়। আগে মামলা নিয়ে তারপর তদন্ত করে দেখতে হবে। যদি আত্মহত্যা হয় তাহলে কারুর প্ররোচণা ছিলো কী না, আত্মহত্যার মতো অবস্থা তৈরি করা হয়েছিলো কী না এসব তদন্তের বিষয়। এমনকি হেফাজতে মানসিক নির্যাতনও অপরাধ। এই আইন শুধু পুলিশ হেফাজত নয়, যেকোনো সরকারি কর্মকর্তার হেফাজতের বেলায়ও প্রযোজ্য।

সুপ্রিম কোর্টের আরেকজন আইনজীবী আজিজুর রহমান দুলু বলেন, পুলিশ হেফাজতে যখন কেউ থাকেন তখন তার সব ধরনের নিরাপত্তার দায়িত্ব পুলিশের। থানা হাজতে আসামি থাকলে ২৪ ঘণ্টা কমপক্ষে দুইজন পুলিশ সদস্যকে পাহারায় থাকতে হবে। আর ওই থানায় সিসি ক্যামেরাও আছে। সেটাও তো মনিটরিং হয়। তাহলে সুমন কীভাবে আত্মহত্যা করল। যদি সে আত্মহত্যা করেও থাকে তাহলে পুলিশের অবহেলার কারণেই সে আত্মহত্যা করেছে। এর দায় পুলিশকেই নিতে হবে।

তার কথা, হত্যা না আত্মহত্যা সেটাতো তদন্তের বিষয়। তার আগে তো মামলা হতে হবে। আর আইন অনুযায়ী একজন ম্যাজিস্ট্রেটের তত্ত্বাবধানে তদন্ত হতে হবে। সেটা না করে আত্মহত্যার প্রচারণা উদ্দেশ্যমূলক।

তবে ডিএমপির তেজগাঁও জোনের ডেপুটি পুলিশ কমিশনার আজিমুল হক বলেন, আমরা অপমৃত্যুর মামলা করেছি। সেটার তদন্ত হবে। দায়িত্বে অবহেলার জন্য দুই পুলিশ সদস্যকে সাসপেন্ড করেছি। একটি তদন্ত কমিটিও গঠন করা হয়েছে যারা সাত দিনের মধ্যে প্রতিবেদন দেবে।

তিনি বলেন, ম্যাজিস্ট্রেটের উপস্থিতিতেই লাশের সুরতহাল করা হয়েছে। আমাদের কাছে সিসি ক্যামেরার ফুটেজ আছে। এটা স্পষ্ট আত্মহত্যা। তার শরীরে কোনো আঘাতের চিহ্ন নাই। কোনো নির্যাতনের ঘটনা ঘটেনি। আর ওই যুবক চুরির সঙ্গে জড়িত বলেও আমরা প্রমাণ পেয়েছি।

বাড়ছে হেফাজতে মৃত্যু:

মার্কিন নিষেধাজ্ঞার পর বাংলাদেশে ক্রসফায়ার কমলেও পুলিশ হেফাজতে মৃত্যু বাড়ছে। চলতি বছরের প্রথম সাত মাসে দুইটি ক্রসফায়ারের ঘটনা ঘটেছে। কিন্তু হেফাজাতে মৃত্যুর ঘটনা ঘটেছে ১১টি। আইন ও সালিশ কেন্দ্রের (আসক) হিসেবে গত বছর ২০২১ সালে ৫১ টি ক্রসফায়ার ও ২৯টি হেফাজতে মৃত্যুর ঘটনা ঘটেছে। ক্রসফায়ার বাদ দিয়ে ২০২০ সালে হেফাজতে মৃত্যু ২৪টি, ২০১৯ সালে হেফাজতে মৃত্যু ৩২টি, ২০১৮ সালে ৫৪টি এবং ২০১৭ সালে ৩৫টি। কিন্তু ২০১৩ সালে হেফাজতে নির্যাতন এবং মৃত্যু নিবারণ আইন হওয়ার পর এখন পর্যন্ত মামলা হয়েছে মাত্র মাত্র ১৯টি। একটি মামলায় আসামিদের শাস্তি হয়েছে। ১৪টি মামলায় মামলা ত্রুটিপূর্ণ বলে চূড়ান্ত প্রতিবেদন দেয়া হয়েছে।

আইনজীবী ইশরাত হাসান বলেন, মানুষ এই আইনটি সম্পর্কে সচেতন নয়। আবার যারা মামলা করতে চান তারা নানা অসহযোগিতার কারণে মামলা করতে পারেন না।

আইনজীবী আজিজুর রহমান দুলু বলেন, মামলা হলেও তার নিরপেক্ষ তদন্ত হওয়া কঠিন। কারণ পুলিশ হেফাজতে নির্যাতন ও মৃত্যুর ঘটনায় পুলিশ ছাড়া সাধারণত আর কেউ থাকেনা। ফলে প্রমাণ করা কঠিন। আর পুলিশ চায় তাদের জড়িত সহকর্মীদের রক্ষা করতে।

এই দুইজন আইনজীবী বলেন, আইনের বিধান হলো মামলার বাদী, তার পরিবার ও সাক্ষীদের নিরাপত্তার ব্যবস্থা করা। সেটাও করা হয় না।

শেয়ার করুন