বাংলাদেশে পাঁচ ধরনের প্রাকৃতিক দুর্যোগ নিয়মিত হয় বলে মনে করে জাপান সরকারের উন্নয়ন সংস্থা ‘জাইকা’। বন্যা, শহরের পানি বেড়ে সৃষ্ট বন্যা, ঘূর্ণিঝড়, নদীভাঙন ও ভূমিকম্পসহ কয়েকটি প্রাকৃতিক দুর্যোগ এ দেশের নিত্যসঙ্গী। জলবায়ু পরিবর্তনের ফলে এসব প্রাকৃতিক দুর্যোগ বাড়ছে। এতে দেশের সামাজিক পরিবর্তন হচ্ছে। একইসঙ্গে ভবিষ্যতে অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধিতেও এ পাঁচ দুর্যোগ বাধা হয়ে দাঁড়াতে পারে।
রোববার (২৮ আগস্ট) বঙ্গবন্ধু আন্তর্জাতিক সম্মেলন কেন্দ্রে এক সেমিনারে এসব তথ্য প্রকাশ করে জাইকা। এসময় উপস্থিত ছিলেন পরিকল্পনামন্ত্রী এম এ মান্নান, পরিকল্পনা প্রতিমন্ত্রী ড. শামসুল আলম, জাইকা প্রেসিডেন্ট আকিহিকো তানাকার, জাইকার আবাসিক প্রতিনিধি ইয়ো হায়াকাওয়া প্রমুখ।
জাইকা বলছে, বাংলাদেশ বেশ কয়েকটি প্রাকৃতিক বিপর্যয়ে ঝুঁকি মোকাবিলা করছে। নদীর পানি বেড়ে বন্যা, ঘূর্ণিঝড় ও ভূমিকম্পের কারণে জনসংখ্যার বিশাল অংশ ক্ষতিগ্রস্ত হয়। দেশের প্রবৃদ্ধিতে নেতিবাচক প্রভাব পড়ে। শিল্প ধ্বংসের মুখে পড়ে। এছাড়া অস্বাভাবিক বন্যার কারণে গুরুত্বপূর্ণ সড়ক, বন্দর, পাওয়ার প্ল্যান্টস ক্ষতির মুখে পড়ে।
নদীভাঙন বাংলাদেশের নিয়মিত প্রাকৃতিক বিপর্যয়গুলোর একটি। এর ফলে ওই এলাকার মানুষ ভূমিহীন হয়ে পড়েন। বিশাল জনগোষ্ঠী ক্ষতিগ্রস্ত হয়। নদীর তীরে তৈরি হওয়া অবকাঠামোগুলো ভেঙে পড়ে। এতে অর্থনৈতিক ক্ষতি হয়। একই ঘটনা ঘটে শহর এলাকায় বন্যা হলেও।
এসব দুর্যোগ মোকাবিলায় ভবিষ্যতের জন্য পরিকল্পনা প্রণয়নের পরামর্শ দিয়েছে জাইকা। তারা বলছে, প্রাকৃতিক বিপর্যয়ের ঝুঁকি বিশ্লেষণ করা, ঝুঁকিপূর্ণ এলাকা নির্ণয় করা দরকার। প্রয়োজনে জাইকার করা প্রকল্পগুলো বিশ্লেষণ করে সিদ্ধান্ত নেওয়ার কথাও বলছেন তারা।
জাইকা এক্ষেত্রে ২১০০ সালের যে ডেল্টা প্ল্যান দিয়েছে, তার প্রাসঙ্গিকতা বিবেচনায় কাজ করতে ইচ্ছুক। এর আগের করা এ ধরনের প্রকল্পগুলোর সঙ্গে সমন্বয় করে কাজ করতে চায় তারা। পাশাপাশি তারা বাস্তবায়নকারী সংস্থার সক্ষমতা বিবেচনা করা, পরিবেশ ও সামাজিক বিভিন্ন শর্তগুলো ভেবে দেখার কথাও বলছে।
জাইকার জরিপে দেখা গেছে, নদীর কাছাকাছি থাকা জেলা বা শহরের মধ্যে সবচেয়ে বেশি ঝুঁকি রয়েছে সিলেট শহর, যা সুরমা নদীর তীরে। চট্টগ্রাম শহর ও এর আশপাশের এলাকা যা কর্ণফুলী ও সাঙ্গু নদীর কারণে বন্যার ঝুঁকিতে আছে। এছাড়া অত্যন্ত ঝুঁকিতে থাকা আরও দুটি শহর হলো কক্সবাজার ও মহেশখালী এলাকা। এ শহরগুলো মাতামুহুরি ও বাঁকখালী নদীর তীরে অবস্থিত।
অন্যদিকে ঘূর্ণিঝড়ের ঝুঁকিতে উপকূলীয় কয়েকটি এলাকা অর্থনৈতিকভাবে খুব গুরুত্বপূর্ণ। বেশ কয়েকটি এলাকায় অর্থনৈতিক অঞ্চলও গড়ে তোলা হচ্ছে। মাতারবাড়ি ও মহেশখালী ডেভেলপমেন্ট এরিয়া ঘূর্ণিঝড়ের ঝুঁকিতে থাকলেও এসব এলাকায় পাওয়ার প্ল্যান্টস, ইন্ডাস্ট্রিয়াল পার্ক ও উন্নয়নকাজ চলছে।
উপকূলীয় এলাকাগুলোর মধ্যে উচ্চঝুঁকিতে থাকা চট্টগ্রাম ও মিরসরাই এলাকায় বেশ কয়েকটি শিল্পপার্ক ও অর্থনৈতিক অঞ্চল গড়ে উঠেছে। এছাড়া এসব এলাকায় সেবা খাতের কয়েকটি প্রতিষ্ঠানও গড়ে উঠেছে।
তবে নোয়াখালীর দক্ষিণাঞ্চলে জনসংখ্যা বাড়তে থাকায় তাদেরও একটি বড় সম্ভাবনা রয়েছে। দুর্যোগপূর্ণ আঞ্চলিক হাব হিসেবে বরিশাল ও ভোলা এলাকায় আলাদা করে অর্থনৈতিক গুরুত্ব তৈরি হচ্ছে। এটি ওই অঞ্চলের অর্থনৈতিক কেন্দ্রবিন্দু হয়ে উঠেছে।
উপকূলীয় এলাকাগুলোতে জাইকার অর্থায়নে কয়েকটি প্রকল্প চলমান আছে বলে জরিপে উল্লেখ করা হয়। এরমধ্যে রয়েছে চট্টগ্রাম সিটি আউটার রিং রোড প্রজেক্ট, ডিজাস্টার রিস্ক ম্যানেজম্যান্ট প্রজেক্ট, ঢাকা ও রংপুরে রাডার সিস্টেম উন্নয়নে প্রকল্প ইত্যাদি। এ প্রকল্পগুলো ২০১৫ সাল থেকে ২০২৫ সাল পর্যন্ত চলছে।
প্রতিষ্ঠানটি বলছে, উপকূলীয় উন্নয়ন এলাকাগুলোতে দুর্যোগ পূর্ববর্তী বিনিয়োগ বাড়াতে হবে, যাতে দুর্যোগ মোকাবিলা করা যায়। চলমান অবকাঠামোগুলোর গুণগত মান উন্নত করা আবশ্যক। তবে বাংলাদেশে এখনো অনেক কম পরিমাণে মেইনটেইনেন্স বাজেট হয়। ফলে প্রকল্পগুলো তৈরি হওয়ার পর বেশিদিন টিকে না।
ভূমিকম্প ঝুঁকিতে থাকা এলাকাগুলোর মধ্যে রয়েছে, ঢাকা মেট্রোপলিটন এলাকা। এখানে ভূমিকম্প হলে জনসংখ্যার পাশাপাশি শিল্প ও সেবা খাতের বিশাল ক্ষয়ক্ষতি হবে। দ্বিতীয় সর্বোচ্চ ঝুঁকি রয়েছে চট্টগ্রাম শহর। ভূমিকম্প হলে ঢাকায় যেসব ক্ষতি হতে পারে, চট্টগ্রামেও একই ধরনের ক্ষতি হওয়ার শঙ্কা দেখছে প্রতিষ্ঠানটি।
এছাড়া সবেচেয়ে ঝুঁকিতে থাকা শহরের মধ্যে রয়েছে সিলেট ও ময়মনসিংহ এলাকা। ভূমিকম্পের মতো দুর্যোগ মোকাবিলায় এসব এলাকায় জাইকার অর্থায়নে ১০ বছর মেয়াদি পাঁচটি প্রকল্প চলছে।