পঁচাত্তরের ১৫ আগস্টের মর্মান্তিক হত্যাকাণ্ডের পর আমাদের কতিপয় বন্ধু কাদের সিদ্দিকীর আহ্বানে সাড়া দিয়ে ভারতে আশ্রয় নিয়ে সশস্ত্র প্রতিরোধও গড়ে তোলার প্রয়াস পেয়েছিলেন। এ সময়ে আমরা যারা সক্রিয় ছিলাম দেশের অভ্যন্তরে তাদের একটা গুরুত্বপূর্ণ অংশ ভারতে আশ্রয় নেই। (ভারতে আমাদের আশ্রয় সময়ের ঘটনাবলী নিয়ে পৃথক একটি রচনা তৈরী করার ইচ্ছা আছে)। এ সময়টাতে আমাদের নেত্রী শেখ হাসিনা সপরিবারে ভারতে নির্বাসিত জীবন যাপন করছিলেন। তিনি নির্বাসনে থেকেও দেশের অভ্যন্তরে কি ঘটছে তা জানার চেষ্টা করেছেন। সেনা শাসক জিয়া ঘরোয়া রাজনীতির অনুমোদন দিলে আওয়ামী লীগের বড় বড় সাহেবেরা খোলস ছেড়ে বেড়িয়ে এসেছিলেন এবং মূলধারার আন্দোলনকারীদেরকে (পঁচাত্তর পরবর্তী আন্দোলনকারীদেরকে) বিভ্রান্ত করার লক্ষ্যে নানা তৎপরতায় লিপ্ত হন। ঘরোয়া রাজনীতির প্রথম সভা ১ সেপ্টেম্বর ১৯৭৬ অনুষ্ঠিত হয়েছিল ধানমন্ডিতে রংপুরের মতিউর রহমান সাহেবের(তিনি তখন কারাগারে) বাড়িতে। শোক প্রস্তাবে শেখ কামালের নাম নেই। কথা বলতে হল আমাকে (আমরা তখন ভারত থেকে অনেকেই ফিরে এসেছি)। শেখ কামালের নাম শোক প্রস্তাবের অন্তর্ভুক্ত করা হয়। দলকে ‘বাকশাল’ নয় আওয়ামী লীগ হিসেবে পুনর্গঠনের প্রস্তাবও আমার এবং তা গ্রহণ করা হয়। ফল আমার গ্রেফতার অক্টোবরে (১৯৭৬)।
তৎপরতা শুরু হল সেনা শাসক জিয়ার ইচ্ছানুযায়ী আওয়ামী লীগের ঘোষণাপত্র ও গঠনতন্ত্র তৈরীর অপপ্রয়াস। মুখ্য ভুমিকায় মিজান চৌধুরী আর আব্দুল মালেক উকিল। সৈয়দা জোহরা তাজউদ্দিন, সৈয়দা সাজেদা চৌধুরী, শামসুদ্দিন মোল্লা ও মোল্লা জালালউদ্দিন এর নেতৃত্বে ছাত্র-যুব নেতাকর্র্মীদের প্রবল বাঁধার মুখে মিজান চৌধুরী, মালেক উকিল গং এর অপতৎপরতা ব্যর্থ হয়। বঙ্গবন্ধুর আদর্শের ভিত্তিতে দেশ পুনর্গঠনের প্রত্যয় ঘোষণা দিয়ে আওয়ামী লীগের ঘোষণাপত্র ও গঠনতন্ত্র সরকারের বরাবরে জমা দেওয়া হয়। শুধু তাই নয়, সরকারের অনুমোদন উপেক্ষা করেই সাংগঠনিক তৎপরতা পরিচালনার সিদ্ধান্ত নিয়ে আমরা মাঠে থাকার প্রত্যয় দৃঢ় সংকল্প নিয়ে কর্মতৎপর হয়ে উঠি। পরবর্তী ও আজকের আওয়ামী লীগের নেতাদের অনেকেরই সেদিন কোনো খোঁজ ছিল না। পাকিস্তানি ভাবধারাপুষ্ট মোশতাকপন্থীরা পঁচাত্তর পূর্ববর্তী আওয়ামী লীগ যেমন দখল করে নিয়েছিল অনেকাংশেই (যা পনেরই আগস্ট পরবর্তী ঘটনা প্রবাহই প্রমাণ করে), অনুরূপ পাকিস্তানি ভাবধারার রাজনীতিও অনেকের আশ্রয়ে প্রশ্রয়ে লালিত পালিত হয়ে ক্রমে মহিরূহের রূপ ধারণ করছে।
ফলাফল রাজনীতিতে দুর্বৃত্তায়ন ও দুষ্টচক্রের দাপট। এ দাপটের কারণে সর্বত্র আজ অন্ধকারের কালো ছায়া। পনের আগস্ট পরবর্তী সীমিত আকারের প্রতিরোধ আন্দোলন সংগ্রামে যারা সেদিন ঘরে বসে বসে কাজ করেছে তারা আজও ঘরে বসে বসেই রাজা উজির মারছে। কাজের কাজ কিচ্ছু হচ্ছে না। রাজনীতি এখন রাজনৈতিক ব্যক্তিদের হাতে নেই। সামরিক-বেসামরিক আমলাতন্ত্র আর ধনিক-বণিকদের হাতে চলে গেছে রাজনীতি। রাজনীতির বাণিজ্যিকরণ হয়ে গেছে। পাকিস্তানি ধারায়। গণতান্ত্রিক প্রতিষ্ঠানসমূহ দুর্বল থেকে দুর্বলতর হয়ে পড়ছে ক্রমান্বয়ে।
জয় হউক মুজিবাদর্শের।
জয় বাংলা। জয় বঙ্গবন্ধু।
লেখক : সংসদ সদস্য,
যুদ্ধাহত বীর মুক্তিযোদ্ধা, পঁচাত্তর-পরবর্তী প্রতিরোধ যোদ্ধা,
সম্পাদক, মত ও পথ।