১৫ আগস্ট যে ঘাতক চক্র বঙ্গবন্ধুকে হত্যা করেছিল সেই চক্রান্তকারীরা এখনো ঘৃণ্য তৎপরতা চালিয়ে যাচ্ছে অভিমত ব্যক্ত করে এসব চক্রান্ত ব্যর্থ করতে শপথ নিতে জাতীয় সংসদে একটি সাধারণ প্রস্তাব আনা হয়েছে।
বুধবার (৩১ আগস্ট) জাতীয় সংসদের অধিবেশনে এ সাধারণ প্রস্তাব করা হয়।
বেসামরিক বিমান পরিবহন ও পর্যটন মন্ত্রণালয় সম্পর্কিত সংসদীয় স্থায়ী কমিটির সভাপতি এবং ব্রাহ্মণবাড়িয়া-৩ আসনের সংসদ সদস্য যুদ্ধাহত বীর মুক্তিযোদ্ধা র আ ম উবায়দুল মোকতাদির চৌধুরী ১৪৭ ধারার আওতায় প্রস্তাবটি আনেন। এ সময় স্পিকার ড. স্পিকার ড. শিরীন শারমিন চৌধুরীর সভাপতিত্ব করেন।
প্রস্তাবে বলা হয়, ‘এই মহান সংসদের অভিমত এই যে, যে ঘৃণ্য খুনীচক্র ও চক্রান্তকারী গোষ্ঠী জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানসহ ১৫ আগস্টের শহীদদেরকে নিষ্ঠুর ও নির্মমভাবে হত্যা করেছিল তাদের প্রতি তীব্র ঘৃণা জানাচ্ছি। কিন্তু চক্রান্তকারীদের প্রেতাত্মারা এখনও ক্ষান্ত হয়নি।
আজও তারা ঘৃণ্য তৎপরতা চালিয়ে যাচ্ছে পুনরায় রাষ্ট্র ক্ষমতায় ফিরে এসে ইতিহাসের চাকাকে ঘুরিয়ে দিতে। তাদের এই ঘৃণ্য চক্রান্তকে সফল হতে দেওয়া যায় না। ইতিহাসের পাদদেশে দাঁড়িয়ে জাতির পিতা, বাঙালির মহত্তম ব্যক্তিত্ব বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানসহ সব শহীদদের চিত্তে ও শ্রদ্ধায় স্মরণ করছি এবং বঙ্গবন্ধু তনয়া জননেত্রী শেখ হাসিনার নেতৃত্বে সব চক্রান্তকে ব্যর্থ করে দেওয়ার শপথ করছি, ২০২২ এর আগস্ট মাসে একাদশ জাতীয় সংসদের উনবিংশতম অধিবেশনে এই হোক প্রত্যয় দৃঢ় ঘোষণা। ’
প্রস্তাব উত্থাপনের সময় নিজের অনুভূতি ব্যক্ত করে মোকতাদির চৌধুরী বলেন, আমি অত্যন্ত কষ্টের সাথে উল্লেখ করছি, বঙ্গবন্ধুর আগমন উপলক্ষে ১৫ আগস্ট রাতে সর্বশেষ আমরা যখন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে কাজ করছিলাম, তখন রাত ১১টার দিকে ক্যাপ্টেন শেখ কামালকে (যিনি জাতীয় ছাত্রলীগের সদস্য ছিলেন) অনেকটা জোর করেই আমরা বাসার দিকে পাঠিয়ে দিয়েছিলাম। বাসায় পাঠানোর ঘন্টা খানেক পরেও তার সাথে আমাদের কয়েকজনের কথা হয়েছিল। এই স্মৃতি যখন আসে মনে, তখন নিজের ওপরে খুবই কষ্ট হয়। সেদিন বঙ্গবন্ধু হত্যাকাণ্ডের প্রতিবাদ করতে আমরা অনেকের কাছেই ছুটে গিয়েছিলাম, কিন্তু প্রথম সারির কারোরই সাড়া পায়নি। তারপরও আমরা থেমে থাকিনি, আমরা সংগঠিত হওয়ার জন্য যথেষ্ট চেষ্টা করেছিলাম; আমার যতটুকু মনে আছে-সেপ্টেম্বর মাসে সারা বাংলাদেশে আমরা ঘুরে ঘুরে ছাত্রলীগকে সংগঠিত করেছি। যেজন্য আমরা ২০ অক্টোবর ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় খোলার দিন প্রথম আমরা সাহস করে মিছিল বের করতে পেরেছিলাম। বলতে পারেন, এই সাহসটা এতো দেরিতে আসলো কেন? আপনারা হয়তো অনেকে জানেন না, ১৫ আগস্টের ভোরে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রত্যেকটা হলের সামনে মিলিটারি ট্যাংক নিয়ে সামরিক বাহিনীর লোকেরা উপস্থিত ছিল এবং সেখানে ছাত্রলীগের নেতাকর্মীদের খোঁজা হচ্ছিল।
তিনি বলেন, আমরা ২০ অক্টোবর মিছিল করেই ক্ষান্ত হয়নি, ২১ অক্টোবরে আমাদের ওপরে হামলা হয়েছিল, কিন্তু আমাদের অবস্থান ভালো থাকায় হামলাকারীরা আমাদের সাথে সেদিন পেরে ওঠেনি। আমাদের তৎপরতা দেখে জাসদ ছাত্রলীগের নেতাকর্মীরা অবাক হয়েছিল, তারা বুঝতে পেরেছিল মুজিববাদীরা পারে, তারা এখন শক্তি-সাহস হারায়নি। পরে আমরা রাজপথে মিছিলের উদ্যোগ নেয় যেটা ৪ নভেম্বর ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের বটতলা থেকে বঙ্গবন্ধু ভবন পর্যন্ত গিয়েছিল। ঐ মিছিলটি সফল করার জন্য বিভিন্ন গ্রুপে ভাগ হয়ে প্রতিটি ক্লাসে গিয়েছি, সেসময় সকল শিক্ষক আমাদের সহযোগিতা করেছিলেন ক্লাসে বক্তব্য রাখার জন্য এবং সকল ছাত্র-ছাত্রী অত্যন্ত মনোযোগ দিয়ে আমাদের বক্তব্য শুনেছিল, আর এজন্য ৪ নভেম্বর বিশাল জনসমাগম করা সম্ভব হয়েছিল।
প্রবীণ এই আওয়ামী লীগ নেতা বলেন, ১ সেপ্টেম্বর ১৯৭৬ সালে যখন আমাদেরকে রাজনৈতিক কর্মকাণ্ড পরিচালনার অনুমতি দেওয়া হয়, সেদিন বঙ্গবন্ধুর মন্ত্রিসভার সদস্য মতিউর রহমান সাহেবের বাসায় আওয়ামী লীগের প্রথম সভা হয়েছিল, কিন্তু আমরা এতোই সংকীর্ণমনা ছিলাম যে সেখানে শোক প্রস্তাব আনা হয়েছিল অথচ শেখ কামালের নাম ছিল না। আমি দাঁড়িয়ে যখন প্রতিবাদ করলাম এবং আমার বন্ধু মুস্তফা জালাল মহিউদ্দিন এটা সমর্থন করলো তারপরই শেখ কামালের নাম শোক প্রস্তাবে অন্তর্ভুক্ত করা হয়।
তিনি আরও বলেন, সেনা শাসক জিয়ার ইচ্ছানুযায়ী আওয়ামী লীগের ঘোষণাপত্র ও গঠনতন্ত্র তৈরীর অপপ্রয়াস শুরু হলে সৈয়দা জোহরা তাজউদ্দিন, সৈয়দা সাজেদা চৌধুরী, শামসুদ্দিন মোল্লা ও মোল্লা জালালউদ্দিন এর নেতৃত্বে আমাদের ছাত্র-যুব নেতাকর্র্মীদের প্রবল বাঁধার মুখে মিজান চৌধুরী, মালেক উকিল গংদের অপতৎপরতা ব্যর্থ হয়। বঙ্গবন্ধুর আদর্শের ভিত্তিতে দেশ পুনর্গঠনের প্রত্যয় ঘোষণা দিয়ে আওয়ামী লীগের ঘোষণাপত্র ও গঠনতন্ত্র সরকারের বরাবরে জমা দেওয়া হয়। শুধু তাই নয়, সরকারের অনুমোদন উপেক্ষা করেই সাংগঠনিক তৎপরতা পরিচালনার সিদ্ধান্ত নিয়ে আমরা মাঠে থাকার প্রত্যয় দৃঢ় সংকল্প নিয়ে কর্মতৎপর হয়ে উঠি, এর ফলে আমাকে দীর্ঘদিন কারাগারে থাকতে হয়।
প্রস্তাবটির উপর সাধারণ আলোচনায় অংশ নিয়ে আইনমন্ত্রী আনিসুল হক বলেন, ‘কোনও আনন্দ নয়, একটা দায়বদ্ধতা থেকে এই মহান সংসদে ঘোষণা দিতে চাচ্ছি— আগামী ১৬ ডিসেম্বরের পরে এই বছর (২০২২ সাল) শেষ হওয়ার আগে, আমরা কমিশন অব ডকুমেন্টস অ্যাক্টের আন্ডারে একটি কমিশন গঠন করবো। সেই কমিশন বঙ্গবন্ধু হত্যার নেপথ্যে যারা ছিল, তাদের পরিচয় উদঘাটন করে দেবে।’
তিনি বলেন, ‘কোনও প্রতিহিংসামূলক বা প্রতিশোধের জন্য নয়, এই কমিশনের দায়িত্ব হবে—নতুন প্রজন্মকে বেইমানদের চিহ্নিত করে যাওয়া। নতুন প্রজন্ম, ভবিষ্যৎ প্রজন্মের কাছে আমরা দায়বদ্ধ থাকবো, আমরা যদি এসব বেইমান, যারা বাংলাদেশকে ধ্বংস করতে চেয়েছিল, তাদের নতুন প্রজন্মের কাছে চিহ্নিত করে না দিয়ে যেতে পারি। বঙ্গবন্ধুকন্যা আজকের প্রধানমন্ত্রী আমাদের বাংলাদেশকে মধ্যম আয়ের দেশ করেছেন। সারা বিশ্বে উন্নয়নের রোল মডেলের মর্যাদা দিয়েছেন। নিজস্ব অর্থায়নে পদ্মা সেতু হয়েছে। ২০৪১ সালের স্বপ্ন, বঙ্গবন্ধুর সোনার বাংলাদেশ হবে উন্নত দেশ। সেই উন্নত দেশ তৈরি করতে হলে, উন্নত দেশকে টিকিয়ে রাখতে হলে, সেই বেইমানদের পরিচয় উদঘাটন করতে হবে। না হলে সেদিনের প্রজন্ম আমাদের দোষী করবে। বলবে, আমরা তো তাদের পরিচয় দিয়ে যাইনি—তারা কীভাবে ব্যবস্থা করবে।’
ওয়ার্কার্স পার্টির সভাপতি রাশেদ খান মেনন বলেন, বঙ্গবন্ধু হত্যাকাণ্ডের স্বরূপ না বুঝতে পারলে আজকের চক্রান্তও বুঝতে পারবো না। বঙ্গবন্ধুকে হত্যার পর তার লাশ ৩২ নম্বরের সিঁড়িতে পড়ে থাকা অবস্থায় তার দলের সহকর্মীরা মন্ত্রীসভায় যোগদান করেছিলেন। আমরা দেখেছি— সেনাবাহিনীর প্রধানরা দলে দলে গিয়ে খুনিদের কাছে আনুগত্য ঘোষণা করেছেন। পরবর্তীকালে আমরা প্রতিরক্ষা উপদেষ্টা হিসেবে জেনারেল ওসমানীকে দেখেছি। মেজর জেনারেল খলিলুর রহমানকে দেখেছি আনুগত্য প্রকাশ করতে। তিনি পরবর্তীকালে আওয়ামী লীগের এমপি হয়েছিলেন। সেই ব্যক্তিরা পরবর্তীকালে কী ভূমিকায় ছিলেন এবং কী ভূমিকা পালন করেছেন সেটা আমাদের জানার দরকার বলে মনে করি।
ইনডেমনিটি অধ্যাদেশ জারির প্রসঙ্গ টেনে তিনি বলেন, এই হত্যাকাণ্ডের বিচার আইনি বাধার মুখে পড়ে। খন্দকার মোশতাক ইনডেমনিটি অধ্যাদেশ জারি করেছিলেন। জিয়াউর রহমান সেই আইনকে সংবিধানের ৫ম সংশোধনীতে যুক্ত করেছিলো। এই বিচার রাজনৈতিক বাধার মুখেও পড়ে।
কেবল সেনাবাহিনীর কিছু বিপথগামী সদস্য এই হত্যাকাণ্ডে জড়িত মনে করলে আমরা ভুল করবো। আত্মস্বীকৃত খুনিদের বক্তব্যগুলো খতিয়ে দেখলেই এই বিষয়টি আমরা জানতে পারবো। খুনি কর্নেল ফারুক বলেছেন, বঙ্গবন্ধু বাংলাদেশকে ধর্মনিরপেক্ষ রাষ্ট্র করতে চেয়েছিলেন বলেই তাকে আমরা হত্যা করেছি। আমরা পরবর্তীতে দেখেছি কীভাবে আমাদের সংবিধান থেকে ধর্মনিরপেক্ষতা বাদ পড়েছে। কীভাবে সমাজতন্ত্রের সংজ্ঞা পরিবর্তন হয়ে গেছে। কীভাবে বাঙালি জাতীয়তাবাদের পরিবর্তে বাংলাদেশি জাতীয়তাবাদ হয়েছে।
খন্দকার মোশতাককে হত্যার জন্য বড় পরিকল্পনা হয়েছিল উল্লেখ করে জাতীয় পার্টির সংসদ সদস্য কাজী ফিরোজ রশীদ বলেন, ‘‘আওয়ামী লীগ নেতা মুজিবুর রহমান চৌধুরীর কাছে গেলাম। বললাম, সব ঠিক আছে, একজন নেতার তো ইয়ে লাগবে। উনি বললেন, এমন কাজ তোমরা করতে যাবে না।’ হয় নাই। সব যুদ্ধে জেতা যায় না। প্রধানমন্ত্রী যে বলেন, ‘এত আওয়ামী লীগ নেতা, সেদিন (১৫ আগস্ট) কাউকে পাওয়া যায় নাই।’ আমরাও কাউকে পাই নাই। না পেয়ে এখানে (বিরোধী দল) বসে আছি। না হলে ওখানে (সরকারি দল) থাকতাম।’’
দুর্ভাগ্য এটাই, এখন অনেক কথা শুনতে হয়, মানতে হয় এবং গ্রহণ করতে হয় বলে দাবি করেন ফিরোজ রশীদ।
তিনি বলেন, ‘১৫ আগস্ট প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা তার বাবা, মা, ভাইদের হারিয়েছেন। ঠিক তেমনি আমরা যারা ছাত্রলীগ, যুবলীগ করতাম— আমরাও নেতাকে হারিয়ে রাজনীতিতে এতিম হয়ে গিয়েছিলাম।’