প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা গতকাল চারদিনের সফরে ভারত পৌঁছেছেন। তার এ সফর নিয়ে জনমনে ব্যাপক কৌতূহল রয়েছে। বাংলাদেশ-ভারত দ্বিপাক্ষিক সম্পর্কে সফরটি নতুন কী মাত্রা যোগ করতে যাচ্ছে, প্রাপ্তি ও সম্ভাবনাই বা কতটা, এসব নিয়ে সর্বস্তরে আলাপ-আলোচনা চলছে।
প্রধানমন্ত্রীর এবারের সফরে দ্বিপক্ষীয় অনেক বিষয়ে পারস্পরিক সহযোগিতার ক্ষেত্র প্রসারিত হতে পরে। এগুলোর মধ্যে রয়েছে বাণিজ্য, যোগাযোগ, জ্বালানি ও প্রতিরক্ষা ক্ষেত্র। এসব ক্ষেত্রে বাংলাদেশ কতটা লাভবান হবে, তা নিয়ে প্রশ্ন রয়েছে। একটা অভিযোগ তো রয়েছেই যে, দ্বিপক্ষীয় সম্পর্কের ক্ষেত্রে সুবিধার দিক থেকে বাংলাদেশ পিছিয়ে থাকে।
যা হোক, ২০১০ সালের পর থেকে বাংলাদেশ-ভারত সম্পর্কে একটি নতুন মাত্রা যুক্ত হয়। সেবার ভারত সফরকালে প্রধানমন্ত্রী একটি উন্মুক্ত আঞ্চলিক নীতির কথাও বলেছিলেন। এই উন্মুক্ত অঞ্চল বলতে পুরো দক্ষিণ এশিয়া এবং পার্শ্ববর্তী অঞ্চলকে বোঝানো হয়েছিল। প্রধানমন্ত্রীর এই চিন্তার মধ্যে প্রজ্ঞা ও দূরদর্শিতার পরিচয় পাওয়া যায়। এই চিন্তার বাস্তব প্রয়োগ ঘটানো গেলে বাংলাদেশসহ ভারত ও দক্ষিণ এশিয়ার দেশগুলোকে যুক্ত করে একটি বৃহৎ উন্মুক্ত অর্থনৈতিক অঞ্চল গড়ে তোলা সম্ভব হবে। এমনকি শুধু দক্ষিণ এশিয়া নয়, মিয়ানমার ও থাইল্যান্ডের মধ্যে যে আঞ্চলিক সড়ক কাঠামো রয়েছে, তার সঙ্গেও বাংলাদেশ যুক্ত হতে পারে।
প্রধানমন্ত্রীর ভারত সফর উপলক্ষ্যে আমরা রোহিঙ্গা সমস্যা সমাধানের ক্ষেত্রে ভারতের সহযোগিতা আশা করতে পারি। রোহিঙ্গা সংকটের কারণে ভারতও ঝুঁকিতে রয়েছে। কিন্তু ভারতের সাম্প্রতিক কথাবার্তা, মিয়ানমারের সঙ্গে তাদের সম্পর্ক ইত্যাদি বিষয় আমলে নিলে রোহিঙ্গা ইস্যুতে ভারতের কার্যকর ভূমিকা প্রশ্নবিদ্ধ হয়ে পড়ে। রোহিঙ্গা সমস্যা যেহেতু শুধু বাংলাদেশের সমস্যা নয়, এটি আঞ্চলিক ও বৈশ্বিক সংকটও বটে, তাই ভারতের উচিত হবে এ ব্যাপারে সক্রিয় ভূমিকা রাখা।
বাংলাদেশ-ভারত সম্পর্কের কথা উঠলে অবধারিতভাবেই পানিসম্পদের কথা আসবে। দুই দেশের মধ্যকার অভিন্ন নদীগুলোর ব্যাপারে একটা সুরাহা হওয়া উচিত অবশ্যই। কুশিয়ারা নদীর পানিবণ্টন বিষয়ে একটা নীতিগত সিদ্ধান্ত হয়েছে বটে; কিন্তু এছাড়া অন্য যে নদীগুলো রয়েছে, সেগুলোর পানিবণ্টন নিয়ে দ্রুত সিদ্ধান্ত হওয়া উচিত বলে মনে করি আমি। তিস্তার পানিবণ্টনের ইস্যুটি দীর্ঘদিন ধরে ঝুলে আছে, ভারতের প্রধানমন্ত্রীর পক্ষ থেকে বারবার প্রতিশ্রুতির পরও চুক্তি স্বাক্ষরিত হচ্ছে না। এই চুক্তি স্বাক্ষরিত হলে দুদেশের মধ্যকার সম্পর্কে এক ইতিবাচক অগ্রগতি সাধিত হবে বলা যায়। দুই দেশের অভিন্ন নদীগুলোর পানিবণ্টন শুধু নয়, পানির ব্যবহার ও জলবায়ু সংক্রান্ত জটিলতার কথা মাথায় রেখেই বিষয়টির নিষ্পত্তি হওয়া দরকার।
আরেকটি বড় ইস্যু হচ্ছে, দুই দেশের মধ্যে বিশাল বাণিজ্য ঘাটতি। বাংলাদেশে যে পরিমাণ ভারতীয় পণ্য আমদানি হয়, সে তুলনায় ভারতে আমাদের পণ্য যায় খুবই কম। প্রধানমন্ত্রীর সফরে ‘সেপা’ চুক্তি অর্থাৎ কম্প্রিহেনসিভ ইকোনমিক পার্টনারশিপ অ্যাগ্রিমেন্ট স্বাক্ষরিত হওয়ার কথা রয়েছে। সেপা চুক্তিতে শুধু বাণিজ্য নয়, বিনিয়োগের ওপরও জোর দেওয়া হয়েছে। এখন দেখার বিষয়, সেপা চুক্তি স্বাক্ষরিত হলে দুই দেশের বাণিজ্য ঘাটতি কতটা কমে আসে। তবে শুধু বাণিজ্য নয়, বাংলাদেশ-ভারতের মধ্যে আরও অনেক বিষয় ভারসাম্যহীনতা রয়েছে, সেগুলোও অ্যাড্রেস করা জরুরি।
লেখক : সাবেক রাষ্ট্রদূত