‘তিতাসে যতদিন পানি থাকবে, ততদিন নৌকা বাইচ অয়োজন অব্যাহত থাকবে’

ব্রাহ্মণবাড়িয়া প্রতিনিধি

ঢেউয়ের কলতান, হেইয়োরে হেইয়ো আর সারিবদ্ধ বৈঠার ছলাত ছলাত শব্দে উত্তাল ব্রাহ্মণবাড়িয়ার তিতাস নদী। আর দুই পাড়ের হাজার হাজার দর্শকের করতালিতে উৎসব মুখর পরিবেশ। ভাদ্রের প্রচণ্ড রোদ উপেক্ষা করে গ্রাম-বাংলার ঐতিহ্যবাহী নৌকা বাইচ উপভোগ করেন তিতাসপাড়ের লক্ষাধিক মানুষ।

আবহমান বাংলার ঐতিহ্য ধরে রাখতে করোনার প্রাদুর্ভাব কমে আসার দুই বছর পর এবার ব্রাহ্মণবাড়িয়ার তিতাস নদীতে অনুষ্ঠিত হয়েছে ‘নৌকা বাইচ’প্রতিযোগিতা।

universel cardiac hospital

বিকেল তিনটা। প্রখর রোদ। শান্ত তিতাস উদ্বেল। সুরের আবহে বৈঠার ছন্দে উত্তাল। দাপুটে ঢেউ আছড়ে পড়ছে পাড়ে। রং বেরংয়ের জার্সি গায়ে জড়ানো আট শ’র অধিক শত মাঝির কণ্ঠে একই সুর, হেইও হেইও। সঙ্গে হাজার মানুষের আবেগি উচ্ছ্বাস, বাইয়া দে বাইয়া দে।

নৌকা বাইচ-২০২২। স্থানীয় ভাষায়, নাও দৌড়ানি। স্থান তিতাস নদীর ব্রাহ্মণবাড়িয়ার অংশ। শিমরাইলকান্দি থেকে মেড্ডা। প্রায় সোয়া কিলোমিটার পথ। অংশ নেয় ১৩টি নৌকা। চার পর্বে শেষ হয় প্রতিযোগিতা। ব্রাহ্মণবাড়িয়ার পাশাপাশি হবিগঞ্জ ও কিশোরগঞ্জ থেকে আসে নৌকা। প্রতিযোগিতায় অংশ নেওয়া একেকটি নৌকায় ৭২ জন করে মাঝি ছিল। বিশেষ বাদ্যের তালে তালে তাদের নৌকা এগিয়ে চলে। মাঝিদের বৈঠার আঘাতে তিতাসে ঢেউ বেশ গতিতে আছড়ে পড়ে পাড়ে।

রোববার বিকেল ৩টার দিকে হওয়া উদ্বোধনী অনুষ্ঠানে প্রধান অতিথির বক্তব্যে বেসামরিক বিমান পরিবহন ও পর্যটন মন্ত্রণালয় সম্পর্কিত সংসদীয় স্থায়ী কমিটির সভাপতি এবং ব্রাহ্মণবাড়িয়া-৩ (সদর-বিজয়নগর) আসনের সংসদ সদস্য যুদ্ধাহত বীর মুক্তিযোদ্ধা র আ ম উবায়দুল মোকতাদির চৌধুরী বলেন, বাংলার আদি থেকে এখন পর্যন্ত চলে আসা ঐতিহ্যের অংশ হলো নৌকা বাইচ। এটি বাঙালির প্রাণের উৎসব। তিতাসে যতদিন পানি থাকবে, ততদিন ঐতিহ্যবাহী এই অয়োজন অব্যাহত থাকবে।

তিনি বলেন, একটি সময় মৌলবাদীদের কারণে এই প্রাণের উৎসবটি অনেক বছর ব্রাহ্মণবাড়িয়াতে বন্ধ ছিল। আমরা এই বাইচ ২০১২ সাল থেকে আবারো চালু করেছি। লাখো মানুষের উপস্থিতি প্রমান করে এই বাইচ সবায় চায়। বাঙালির প্রাণের এই উৎসব প্রতি বছর চালু রাখার জন্য আমরা চেষ্টা করে যাব।

এসময় ধর্মান্ধতাকে পেছনে ফেলে আয়োজনটি সফল করায় সমাপনী বক্তব্যে তিনি সকলের প্রতি কৃতজ্ঞতা জানিয়েছেন।

উদ্বোধনী অনুষ্ঠানের সভাপতি জেলা প্রশাসক মো. শাহগীর আলম বলেন, ‘মুক্তিযুদ্ধের চেতনার সঙ্গে যায় এমন আয়োজন অব্যাহত থাকবে।’

অনুষ্ঠানে বিশেষ অতিথি হিসেবে উপস্থিত ছিলেন মাধ্যমিক ও উচ্চশিক্ষা অধিদপ্তরের প্রাক্তন মহাপরিচালক (গ্রেড-১) এবং ব্রাহ্মণবাড়িয়া বিশ্ববিদ্যালয়ের কোষাধ্যক্ষ প্রফেসর ফাহিমা খাতুন, পুলিশ সুপার মো. আনিসুর রহমান, পৌর মেয়র মিসেস নায়ার কবির।

প্রতিযোগিতায় ব্রাহ্মণবাড়িয়া সদরের এম আব্দুল আলীর নৌকা প্রথম, একই উপজেলার মো. জাকির হোসেনের নৌকা দ্বিতীয় ও আশুগঞ্জের মো. সেলিম মিয়ার নৌকা তৃতীয় স্থান অধিকার করে। তবে তিন নৌকাই হবিগঞ্জ থেকে আনা। প্রথম পুরস্কার হিসেবে নগদ এক লাখ টাকা, দ্বিতীয় পুরস্কার হিসেবে ষাট হাজার টাকা, তৃতীয় পুরস্কার হিসেবে ৩০ হাজার টাকা দেওয়া হয়। নৌকা বাইচকে কেন্দ্র করে তিতাস নদীর দুই পাড়ে হাজার হাজার লোকের সমাগম হয়।

এছাড়া উৎসুক জনতা কয়েক শ’ নৌকা নিয়ে তিতাসে আনন্দ করে ঘুরে বেরিয়ে প্রতিযোগিতা উপভোগ করেন। রজব আলী নামে এক ব্যক্তি বলেন, ‘বছর বছর যাতে নাও দউরানি অ আমডা চাই।’ একটি নৌকার মাঝি আব্দুল হক বলেন, ‘আমরা এটি বেশ উপভোগ করি।’

শেয়ার করুন