মার্চ ১৯১৭, রাশিয়ায় জারের স্বৈরশাসনের বিরুদ্ধে ঐতিহাসিক গণ-অভ্যুত্থান সংঘটিত হয়। যার ফলে ১৫ মার্চ রাশিয়ার শেষ সম্রাট জার দ্বিতীয় নিকোলাস পদত্যাগে বাধ্য হন। অস্থায়ী সরকার দায়িত্বভার গ্রহণ করে। ১৯১৭ সালের ২৫ অক্টোবর ভ্লাদিমির লেলিনের নেতৃত্বে সশস্ত্র বিপ্লবের মাধ্যমে বলশেভিকরা রাশিয়ার ক্ষমতা দখল করে নেয়। বিশ্বের ইতিহাসে যা ‘রুশ সমাজতান্ত্রিক বিপ্লব’ বা ‘অক্টোবর বিপ্লব’ নামে পরিচিতি পায়। ডানপন্থি, মধ্যপন্থি ও সাম্রাজ্যবাদীরা ঐক্যবদ্ধ হয়ে হোয়াইট আর্মি গঠন করে। অতঃপর হোয়াইট আর্মি এবং বলশেভিকদের নেতৃত্বাধীন রেড আর্মির মধ্যে গৃহযুদ্ধের সূচনা হয়।
১৭ জুলাই ১৯১৮, ইয়েকাতারিনবার্গের অর্থডক্স গির্জায় জার দ্বিতীয় নিকোলাস এবং তার পরিবারবর্গের মৃত্যুদণ্ডাদেশ কার্যকর করা হয়। নভেম্বর ১৯১৭, সাংবিধানিক বিধানসভা নির্বাচন অনুষ্ঠিত হয়। বলশেভিকরা ৭১৫ আসনের বিধানসভায় মাত্র ১৭৫টি আসনে জয়লাভ করে। গৃহযুদ্ধ চলাকালে ১৯২২ সালের ডিসেম্বর আরো কয়েকটি সমাজতান্ত্রিক প্রজাতন্ত্র একত্রিত হয়ে ইউএসএসআর বা সোভিয়েত ইউনিয়ন গঠিত হয়। ১৯২৩ সালের জুনে গৃহযুদ্ধের লেলিহান শিখা স্তিমিত হয়ে আসে। ১৬ জুন, বলশেভিকদের নেতৃত্বাধীন রেড আর্মিরা যুদ্ধে জয়লাভ করে। সমাজতন্ত্র ও কমিউনিজমের মতাদর্শ ক্রমান্বয়ে পূর্ব ইউরোপ ও মধ্য এশিয়ায় বিস্তার লাভ করে।
১৯৯০ সালেও সোভিয়েত ইউনিয়ন পৃথিবীর অন্যতম পরাশক্তি হিসেবে প্রতিষ্ঠিত ছিল। কিন্তু ব্ল্যাক মার্কেটের কারণে সোভিয়েত ইউনিয়ন ধ্বংসের দ্বারপ্রান্তে উপনীত হয়। কমিউনিস্ট পলিটব্যুরোর ক্ষমতাধর নেতৃবৃন্দ দুর্নীতিতে জড়িয়ে পড়ায় সোভিয়েত ইউনিয়নের অর্থনৈতিক ব্যবস্থা ভঙ্গুর হয়ে পড়ে। ১১ মার্চ ১৯৮৫, গর্বাচভ কমিউনিস্ট পার্টির সাধারণ সম্পাদক হিসেবে দায়িত্বভার গ্রহণ করেন। ইতিমধ্যে রাশিয়ার জনগণ কমিউনিস্টদের অত্যাচারে অতিষ্ঠ হয়ে ওঠেন। মিখাইল গর্বাচভ সোভিয়েত ইউনিয়নের সংস্কারের গুরুত্ব উপলব্ধি করেন। ১৯৮৬ সালে গ্লাসনস্ত (স্বচ্ছতা) এবং পেরেস্ত্রোইকা (পুনর্গঠন) নীতি গ্রহণ করেন।
আগস্ট ১৯৯১, কট্টরপন্থী কমিউনিস্টরা গর্বাচভকে ক্ষমতাচ্যুত করার নিমিত্তে অভ্যুত্থানের চেষ্টা করেন। গর্বাচভের সমর্থনে হাজার হাজার জনতা রাস্তায় নেমে আসে এবং অভ্যুত্থানকে ব্যর্থ করে দেয়। ১৫টি সোভিয়েত প্রজাতন্ত্রের অনেকগুলোতে স্বাধীনতার আন্দোলন জোরদার হয়ে ওঠে। ইউক্রেনসহ অন্য কয়েকটি প্রজাতন্ত্রে স্বাধীনতার দাবিতে গণভোট অনুষ্ঠিত হয়। ইউক্রেন নেতা লিওনিদ ক্রাভচুক ‘একটি স্বাধীন ইউক্রেন রাষ্ট্র’ প্রতিষ্ঠার স্বপ্ন দেখতেন। একটি পুরোনো রাষ্ট্রের ধ্বংসাবশেষের নিচে থেকে লাখ লাখ মানুষকে কীভাবে উদ্ধার করা যায়, এটাই ছিল মূল চিন্তা। ৭ ডিসেম্বর ১৯৯১, বেলারুশ নেতা স্ট্যানিস্লাভ শুশকেভিচের আমন্ত্রণে রাশিয়ান নেতা ইয়েলিসন এবং ইউক্রেন নেতা লিওনিদ ক্রাভচুক বেলারুশের বিশাল খামারবাড়িতে এক বৈঠকে মিলিত হন। বাড়িটা ছিল খুবই বিলাসবহুল। সোভিয়েত রীতি অনুযায়ী উক্ত বৈঠকে প্রচুর খানাপিনার আয়োজন করা হয়। পরদিন ৮ ডিসেম্বর তিন নেতা তাদের প্রধানমন্ত্রীদের সঙ্গে নিয়ে আনুষ্ঠানিক বৈঠকে বসেন। বৈঠকের শুরুতেই তর্কবিতর্ক ব্যতিরেকেই প্রথম লাইনটিতে ঐকমত্যে পৌঁছান। লাইনটি ভূরাজনৈতিক বাস্তবতা এবং আন্তর্জাতিক আইনের বিষয় হিসেবে ‘ইউনিয়ন অব সোভিয়েত সোশ্যালিস্ট রিপাবলিকান বা ইউএসএসআর-এর কোনো অস্তিত্ব নেই।’ পরবর্তী কয়েক ঘণ্টায় তারা চুক্তির মোট ১৪টি অনুচ্ছেদের ব্যাপারে ঐকমত্যে পৌঁছান।
রাত ৩টার মধ্যে সোভিয়েত ইউনিয়ন অবসানের চুক্তির খসড়া প্রস্তুত হয়। চুক্তিপত্রটি সমগ্র বিশ্বের সামনে ঘোষণার অপেক্ষায়! উক্ত বৈঠক থেকে বেলারুশ নেতা শুশকেভিচ টেলিফোনে প্রেসিডেন্ট গর্বাচভের সঙ্গে কথা বলেন। দুজনের মধ্যে কঠিন কথাবার্তা হচ্ছিল। একপর্যায়ে গর্বাচভ রেগে গিয়ে বলেন, আপনারা কী করছেন! পুরো পৃথিবী ওলটপালট করে দিয়েছেন। সবাই তো আতঙ্কের মধ্যে আছে। কিন্তু শুশকেভিচ ছিলেন শান্ত ধীরস্থির। কী ধরনের চুক্তিতে সই করতে যাচ্ছেন তা বেলারুশ নেতা শুশকেভিচ প্রেসিডেন্ট গর্বাচভকে বুঝিয়ে বলার চেষ্টা করেন। গর্বাচভ উত্তরে বললেন, তাহলে আন্তর্জাতিক সম্প্রদায়ের কী হবে? শুশকেভিচ বলেন যে, প্রকৃতপক্ষে এই মুহূর্তে ইয়েলিসন প্রেসিডেন্ট বুশের সঙ্গে কথা বলছেন এবং প্রেসিডেন্ট বুশের কোনো আপত্তি নেই মনে হয়। মাত্র কয়েক ঘণ্টা পরেই উল্লিখিত তিন নেতা সংবাদ সম্মেলনে আনুষ্ঠানিকভাবে উক্ত ঐতিহাসিক চুক্তি স্বাক্ষর করেন। ফল হিসেবে সোভিয়েত ইউনিয়নের অবসান হয়। সোভিয়েত ইউনিয়নের কফিনে শেষ পেরেক ঠুকলেন ইউক্রেন নেতা ক্রাভচুক, রাশিয়ান নেতা ইয়েলিসন এবং বেলারুশ নেতা শুশকেভিচ। ইতোমধ্যে ইয়েলিসন প্রেসিডেন্ট বুশের সঙ্গে কথা বলেন এবং উল্লিখিত বিষয়গুলো অবহিত করেন। শেষ পর্যন্ত তিনটি আঞ্চলিক পার্লামেন্ট এই চুক্তি অনুমোদন করে। অন্যান্য সেভিয়েত প্রজাতন্ত্রগুলোও এতে যোগ দেয়।
উক্ত ঘোষণায় প্রাক্তন ১৫টি সোভিয়েত প্রজাতন্ত্রের স্বাধীনতা স্বীকার করে নেওয়া হয়। সোভিয়েত ইউনিয়নের সর্বশেষ প্রেসিডেন্ট গর্বাচভ পদত্যাগ করেন; তার পদ বিলুপ্ত ঘোষণা করেন এবং সোভিয়েত পরমাণু ক্ষেপণাস্ত্র উেক্ষপণের নিমিত্তে কোডগুলোর নিয়ন্ত্রণসহ রাশিয়া নব্য প্রেসিডেন্ট বরিস ইয়েলিসনের নিকট দায়িত্ব হস্তান্তর করেন। ৭টা ২৩ সন্ধ্যায় সোভিয়েত পতাকা শেষ সময় ক্রেমলিনের কাছ থেকে নেমে এসেছিল এবং বিপ্লবী রাশিয়ার প্রাক্তন পতাকা প্রতিস্থাপিত হয়েছিল।
সোভিয়েত ইউনিয়ন অবসানের পর রাশিয়া আশা করেছিল, ১৯৯১ সালের পর ইউরোপে যে নিরাপত্তাকাঠামো গড়ে উঠবে রাশিয়া তার অন্তর্ভুক্ত হবে। যুক্তরাষ্ট্র দ্রুত রাশিয়ার প্রতিবেশী পূর্ব ইউরোপ ও বাল্টিক দেশগুলোকে ন্যাটোর অন্তর্ভুক্ত করে নেয়। ২০১৪ সালের নির্বাচনে কিয়েভে মস্কোবিরোধী সরকার প্রতিষ্ঠিত হওয়ায় মস্কো ক্ষুব্ধ হয়। ইউক্রেন ন্যাটোর সদস্য হওয়ার ইচ্ছা প্রকাশ করলে পুতিনের নিকট তা হলো অমার্জনীয় অপরাধ। ফল হিসেবে ২০১৪ সালে রাশিয়া ক্রিমিয়া দখল করে নেয়। প্রতিক্রিয়া হিসেবে ওয়াশিংটন মস্কোর বিরুদ্ধে সীমিত আকারে অর্থনৈতিক নিষেধাজ্ঞা আরোপ করে। কিন্তু ২০২১ সালের শেষার্ধে ইউক্রেনের প্রেসিডেন্ট জেলেনস্কি ন্যাটোর সদস্য পদ লাভের জন্যে তত্পর হয়ে ওঠেন। শত বছরের ভ্রাতৃত্বের বন্ধনকে পদদলিত করে ২৪ ফেব্রুয়ারি ২০২২, ভোরে বিনা উসকানিতে রাশিয়ার প্রেসিডেন্ট ভ্লাদিমির পুতিন ‘বিশেষ সামরিক অভিযানের’ নামে ইউক্রেনের বিরুদ্ধে সর্বাত্মক যুদ্ধ ঘোষণা করেন।
যুদ্ধের ফল হিসেবে বিশ্বব্যাপী জ্বালানি তেল এবং খাদ্যের সংকট দেখা দিয়েছে। যুদ্ধ দীর্ঘ ছয় মাস অতিক্রান্ত হয়েছে। এ যুদ্ধ আরো কত মাস-বছর চলবে? যুদ্ধ দীর্ঘায়িত হলে, শুরু হবে গেরিলা যুদ্ধ। দীর্ঘমেয়াদি যুদ্ধ চলতে থাকলে রাশিয়ার প্রেসিডেন্ট ভ্লাদিমির পুতিন এবং ইউক্রেনের প্রেসিডেন্ট জেলেনস্কির পক্ষে অর্থনৈতিক ও সার্বিক বিপর্যয় মোকাবিলা করা সম্ভব হবে কি?
লেখক : প্রাক্তন সাংগঠনিক সম্পাদক, জাতীয় চার নেতা পরিষদ।