একটি অকল্পনীয় এবং বর্ণাঢ্য রাজনৈতিক জীবনের সমাপ্তি ঘটিয়ে গত রোববার রাতে পরপারে পাড়ি জমালেন মুক্তমনা, প্রগতিশীল রাজনীতির ধারক ও বাহক বেগম সৈয়দা সাজেদা চৌধুরী। দেশ ভাগের পর এপার বাংলায় যেখানে নারী রাজনীতির আকাল চলছিল ঠিক তখন যে ক’জন নারী নেতৃত্ব তাদের নেতৃত্বের গুণে এদেশে পরিচিত হয়ে ওঠেছিলেন তাদের মধ্যে অন্যতম হচ্ছেন বেগম সৈয়দা সাজেদা চৌধুরী। সাজেদা চৌধুরী ২১ বছর বয়স থেকেই আওয়ামী রাজনীতির সঙ্গে জড়িত হয়ে জীবনের শেষদিন পর্যন্ত ওই দলেই অবস্থান করে দলের বিভিন্ন সাংগঠনিক দায়িত্ব সুচারুভাবে পালন করেছেন। ১৯৩৫ সালে জন্মগ্রহণকারী সৈয়দা সাজেদা চৌধুরী ১৯৫৬ সাল থেকেই আওয়ামী রাজনীতির সঙ্গে জড়িত হয়ে সামনের কাতারে থেকেই বিভিন্ন রাজনৈতিক আন্দোলন সংগ্রামে অংশগ্রহণ করেন।
১৯৬৯ সালে বাংলাদেশ মহিলা আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক নির্বাচিত হন এবং উক্ত দায়িত্ব তিনি ১৯৭৫ সাল পর্যন্ত পালন করেন। বঙ্গবন্ধু হত্যার পর দলের কঠিন সময়ে তিনি বাংলাদেশ আওয়ামী লীগের ভারপ্রাপ্ত সম্পাদকের দায়িত্ব পালন করেন। সৈয়দা বেগম সাজেদা চৌধুরী ১৯৭১ সালে মুক্তিযুদ্ধে যোগ দিয়ে কলকাতায় ‘গোবরা নার্সিং হোম’ প্রতিষ্ঠা করে সেখানে আহত মুক্তিযোদ্ধাসহ বাংলাদেশি শরণার্থীদের চিকিৎসার সুযোগ করে দেন। মুক্তিযুদ্ধ চলাকালীন সাজেদা চৌধুরীর দায়িত্বশীল তৎপরতা এবং দলের প্রতি নিষ্ঠার কারণে পরবর্তী সময়ে তাকে বাংলাদেশ আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক, প্রেসিডিয়াম সদস্য, মন্ত্রী এবং সংসদ উপনেতা হিসেবে দায়িত্ব পালন করতে হয়। সৈয়দা সাজেদা চৌধুরী ১৯৮৬ থেকে ১৯৯২ সাল পর্যন্ত বাংলাদেশ আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক থাকাকালে দেশ যখন ’৯০-এর স্বৈরাচারবিরোধী আন্দোলনে উন্মুক্ত, ঠিক তখন তিনি দলকে সামনের সারি থেকে নেতৃত্ব দিয়ে সফল হয়েছিলেন। ১৯৯২ সালে তিনি বাংলাদেশ আওয়ামী লীগের প্রেসিডিয়াম সদস্য নির্বাচিত হন এবং পরে তিনি প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা কর্তৃক পার্বত্য চট্টগ্রাম শান্তিচুক্তি বাস্তবায়ন কমিটির আহ্বায়কও নির্বাচিত হন।
গ্রামীণ উন্নয়ন ও শিক্ষায় বিশেষ অবদানের জন্য ১৯৭৪ সালে সাজেদা চৌধুরী আন্তর্জাতিক সংস্থা ইউনেস্কো কর্তৃক ফেলোশিপ প্রাপ্ত হন। গার্লস গাইডের সর্বোচ্চ পদক ‘সিলভার এলিফ্যান্ট’ অর্জন করে নিয়েছিলেন তিনি। রাজনীতিতে বহুবিদ অবদানের জন্য সর্বশেষ বাংলাদেশ সরকার সৈয়দা সাজেদা চৌধুরীকে ২০১০ সালে স্বাধীনতা পদকে ভূষিত করেন। এই চৌকস, প্রাজ্ঞ এবং মেধাবী রাজনীতিকের বিদায়ে দেশের যে ক্ষতি হলো তা কাটিয়ে উঠতে অনেক বছর সময় লেগে যাবে। আমরা নারী নেতৃত্বের এই অকুতোভয় সৈনিকের প্রতি বিনম্র শ্রদ্ধা জানাচ্ছি। আমরা প্রত্যাশা করছি তার পথ ধরে এদেশে অজস্র নারী নেতৃত্বের বিকাশ ঘটবে।
রতন কুমার তুরী : লেখক ও শিক্ষক, ঢাকা।