উপযুক্ত শিক্ষার জন্য উপযুক্ত শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান, উপযুক্ত পরিবেশ ও উপযুক্ত শিক্ষক যেমন দরকার; একই সঙ্গে দরকার সময়োপযোগী পাঠ্যক্রম। সময়ের প্রয়োজনে, যুগের সঙ্গে তাল মেলাতে শিক্ষাক্রম উন্নয়ন, সংস্কার বা পরিমার্জনের প্রয়োজন হয়। তাই বিভিন্ন দেশের সঙ্গে সমন্বয় রেখে বর্তমান কারিকুলাম আধুনিকায়ন করা হচ্ছে এবং শিক্ষাব্যবস্থাকে ঢেলে সাজানোর পরিকল্পনা করছে সরকার। স্বাধীনতা-উত্তর বাংলাদেশে এ পর্যন্ত তিন বার কারিকুলাম সংস্কার করা হয়েছে। চতুর্থ বারের মতো পরিমার্জিত কারিকুলাম ২০২২ সাল থেকে বাস্তবায়নের কথা থাকলেও করোনার অতিমারির কারণে দীর্ঘদিন শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান বন্ধ থাকায় এক বছর পিছিয়ে ২০২৩ সাল থেকে নতুন এই কারিকুলাম বাস্তবায়ন করা হচ্ছে।
প্রথম থেকে দ্বাদশ শ্রেণি পর্যন্ত এই কারিকুলামে আন্তর্জাতিক মান ও সময়ের চাহিদা বিবেচনা করে পরিবর্তন আনার উদ্যোগ নেয় সরকার। বর্তমান শিক্ষাক্রমে নবম শ্রেণিতে গিয়ে শিক্ষার্থীরা বিজ্ঞান, মানবিক ও ব্যবসায় শিক্ষা শাখায় ভাগ হয়ে ভিন্ন ভিন্ন বিষয়ের ওপর পড়াশোনা করে। নতুন এই কারিকুলামে মাধ্যমিক পর্যন্ত থাকছে না কোনো বিভাগ বিভাজন। ষষ্ঠ থেকে দশম শ্রেণির সবাইকে পড়তে হবে ১০টি অভিন্ন বিষয়। বর্তমানে নবম ও দশম শ্রেণির পাঠ্যসূচি মিলিয়ে এসএসসি পরীক্ষা অনুষ্ঠিত হয়। নতুন কারিকুলামে কেবল দশম শ্রেণির পাঠ্যসূচির ওপরেই অনুষ্ঠিত হবে এসএসসি পরীক্ষা। নতুন শিক্ষাক্রমে একাদশ শ্রেণিতে গিয়ে শিক্ষার্থীরা বিভাগ পছন্দ করতে পারবে এবং একাদশ ও দ্বাদশ শ্রেণি শেষে আলাদা দুটি বোর্ড পরীক্ষা অনুষ্ঠিত হবে। এ দুই পরীক্ষায় প্রাপ্ত নম্বরের সমন্বয়ে তৈরি হবে এইচএসসি পরীক্ষার ফল।
এছাড়া নতুন শিক্ষাক্রমে প্রাথমিকে তৃতীয় শ্রেণি পর্যন্ত কোনো পরীক্ষা থাকছে না। চতুর্থ থেকে পঞ্চম শ্রেণি পর্যন্ত পড়তে হবে আটটি বই। তবে শ্রেণি শিখনকালীন মূল্যায়নেই বেশি জোর দেওয়া হয়েছে। বর্তমান পদ্ধতিতে প্রাথমিক শিক্ষা সমাপনী (পিইসি) ও জুনিয়র স্কুল সার্টিফিকেট (জেএসসি/জেডিসি) পরীক্ষা থাকছে না। আগামী বছর থেকে ধাপে ধাপে নতুন এই শিক্ষাক্রম বাস্তবায়নের প্রক্রিয়া শুরু হবে। ২০২৩ সালে প্রথম ও দ্বিতীয় শ্রেণি এবং ষষ্ঠ ও সপ্তম শ্রেণির শিক্ষার্থীদের মাধ্যমে শিক্ষাক্রম বাস্তবায়ন শুরু করা হবে। ২০২৪ সালে তৃতীয় ও চতুর্থ শ্রেণি এবং অষ্টম ও নবম শ্রেণি এই শিক্ষাক্রমের আওতায় আসবে। ২০২৫ সালে পঞ্চম ও দশম শ্রেণি যুক্ত হবে। ২০২৬ সালে একাদশ ও ২০২৭ সালে যুক্ত হবে দ্বাদশ শ্রেণি।
নতুন এই শিক্ষাক্রম বাস্তবায়নের প্রথম ধাপ হিসেবে এ বছর থেকেই ষষ্ঠ শ্রেণিতে সারা দেশে ৬১টি স্কুল ও মাদ্রাসায় পাইলটিং চলছে। নতুন শিক্ষাক্রমে পরীক্ষার ভার কমবে। কমবে মুখস্থ করার প্রবণতাও। মুখস্থ করার পরিবর্তে বেশি থাকবে বিশ্লেষণমূলক আর অভিজ্ঞতাভিত্তিক শিখন কার্যক্রম। শিক্ষার্থীদের জীবন-দক্ষতা অর্জন অপরিহার্য, সেগুলো পাঠ্যবইয়ে অন্তর্ভুক্ত থাকছে।
প্রাক-প্রাথমিক থেকে তৃতীয় শ্রেণি পর্যন্ত পরীক্ষা না থাকলেও বিদ্যালয়েই শ্রেণিশিক্ষকের ধারাবাহিক মূল্যায়নের মাধ্যমে শিক্ষার্থীদের শিখন অগ্রগতি মূল্যায়ন করা হবে নতুন এই শিক্ষাক্রমে। অর্থাৎ সাময়িক, ষাণ্মাসিক, বার্ষিক পরীক্ষা না থাকলেও শতভাগ মূল্যায়ন শিখনকালীন। চতুর্থ থেকে পঞ্চম শ্রেণিতে ৬০ শতাংশ শিখনকালীন মূল্যায়ন এবং ৪০ শতাংশ পরীক্ষার মাধ্যমে মূল্যায়ন। ষষ্ঠ থেকে অষ্টম শ্রেণি পর্যন্তও শিখনকালীন মূল্যায়ন ৬০ শতাংশ ও পরীক্ষার মাধ্যমে মূল্যায়ন ৪০ শতাংশ। নবম ও দশম শ্রেণিতে ৫০ শতাংশ শিখনকালীন মূল্যায়ন এবং ৫০ শতাংশ পরীক্ষার মাধ্যমে মূল্যায়ন করা হবে। চতুর্থ থেকে দশম শ্রেণি পর্যন্ত কিছু বিষয় শতভাগ মূল্যায়ন শিখনকালীনই করা হবে।
উপযুক্ত শিক্ষক ছাড়া উপযুক্ত শিক্ষা সম্ভব নয়। এবং নতুন এই শিক্ষাক্রম বাস্তবায়নে শিক্ষকদের ভূমিকাই হবে মুখ্য। শ্রেণিকক্ষের মূল্যায়নের ওপরই বেশি গুরুত্ব দেওয়া হয়েছে। তাই উপযুক্ত শিক্ষকের কোনো বিকল্প নেই। তাদের বহুমাত্রিক, সৃজনশীল, সৎ, দক্ষ, যোগ্য, অভিজ্ঞ, মানবিক মূল্যবোধসম্পন্ন, স্বপ্নবান আদর্শ শিক্ষক হতে হবে। কোচিং বাণিজ্য নিয়ন্ত্রণ করতে হবে নতুন শিক্ষাক্রম বাস্তবায়নে। শুধু আইন দ্বারাই হয়তো কোচিং পুরোপুরি বন্ধ করা যাবে না। রাখতে হবে কঠোর নজরদারি। বর্তমানে যেখানে ছাত্রছাত্রীরা শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে ভর্তি হওয়ার আগেই কোচিং সেন্টারে ভর্তি হচ্ছে, সেখানে কোচিং বাণিজ্য নিয়ন্ত্রণ করতে না পারলে বেশি নম্বর পেতে কোচিং সেন্টার বা শিক্ষকদের বাসায় শিক্ষার্থীদের ভিড় আরো বাড়বে বলে মনে করেন শিক্ষাবিদগণ। এর ফলে ক্লাসরুমে পাঠদানের পরিবর্তে কোচিং-প্রাইভেটের রমরমা ব্যবসা শুরু হয়ে যাবে। সব শিক্ষক না হলেও অনেক শিক্ষকের কাছেই শিক্ষার্থীরা হয়ে পড়বে জিম্মি।
তাই নতুন এই শিক্ষাক্রম বাস্তবায়নের জন্য মেধাবী, সৃজনশীল, ব্যক্তিত্ববান, নির্লোভ, নির্মল হৃদয়ের মানবিক মূল্যবোধসম্পন্ন শিক্ষকের বিকল্প নেই। দেশের সবচেয়ে মেধাবীদের শিক্ষকতা পেশায় আকৃষ্ট করতে হবে। এজন্য এই পেশাকে করতে হবে আকর্ষণীয়। জার্মানির চ্যান্সেলর অ্যাঙ্গেলা মার্কেল তার এক বক্তব্যে বলেন, ‘শিক্ষকেরা সাধারণ মানুষ নন। তাই যোগ্যতা ছাড়া শিক্ষকতা পেশা গ্রহণ কাম্য নয়।’ ঐ দেশের বিচারক, চিকিৎসক ও প্রকৌশলীরা যখন সে দেশের সর্বোচ্চ বেতনভোগী শিক্ষকদের সমতুল্য বেতনের অনুরোধ জানান, তখন মার্কেল তাদের বলেন, ‘যারা আপনাদের শিক্ষাদান করেছেন, তাদের সঙ্গে কীভাবে আপনাদের তুলনা করি?’
জাতীয় শিক্ষানীতি অনুযায়ী শিক্ষকদের জন্য পৃথক বেতনকাঠামো এবং শিক্ষক নিয়োগের জন্য সরকারি কর্মকমিশনের (পিএসসি) আদলে পৃথক কর্মকমিশন গঠন করা জরুরি দরকার। ভালো বেতন-ভাতা পেলে শিক্ষকেরা কোচিং-প্রাইভেট পড়াতে নিরুৎসাহিত হবেন। এটা নতুন শিক্ষাক্রমের জন্য, দেশ-জাতির জন্য, ভবিষ্যৎ প্রজন্মের জন্য করা উচিত। নতুন শিক্ষাক্রম বাস্তবায়নের দ্বারা আলোকিত জাতি গঠনের মাধ্যমে আমাদের দেশ পৃথিবীর বুকে দাঁড়াক মাথা উঁচু করে।
লেখক : কলেজশিক্ষক