শিশুর নৈতিক মূল্যবোধের প্রাতিষ্ঠানিক চর্চা

সাদিয়া জেরিন

প্রতীকী ছবি

পিপীলিকার যূথবদ্ধ চলাচল, মৌমাছির দলগত শৃঙ্খলা, বাবুই পাখির শৈল্পিক বাসা তৈরির মতো প্রতিটি প্রাণীর টিকে থাকার প্রয়োজনে রপ্ত করতে হয় নানাবিধ কৌশল। উন্নত বিবেক, পরিশীলিত জ্ঞান মানুষকে শারীরিকভাবে সামর্থ্যবান অনেক প্রাণী থেকে ভিন্নতা দিয়েছে। সুশ্রী চেহারা, দেহ অবয়বের উত্তম গঠন মানুষ ছাড়া অন্য কোনো প্রাণীতে নেই। আবার কথা বলার ক্ষমতা, অন্যের সঙ্গে যোগাযোগ, ভাবের আদান-প্রদানের সক্ষমতা মানব জাতিকে করেছে অনন্য বৈশিষ্ট্যমণ্ডিত। মহান সৃষ্টিকর্তা যা কিছু সৃষ্টি করেছেন; সবই মানুষের কল্যাণে এবং সব সৃষ্টির ওপর মানুষকে শ্রেষ্ঠত্ব দিয়েছেন। এ কারণেই ‘আশরাফুল মাখলুকাত’ বা সৃষ্টির সেরা জীব বলা হয় মানুষকে।

নৈতিক অবক্ষয়, মূল্যবোধের অভাবে মানুষ মনুষ্যত্বহীন, উপলব্ধি ক্ষমতাশূন্য জড় পদার্থের মতো আচরণ করে। বলা হয়, ‘তরুলতা সহজেই তরুলতা, পশুপাখি সহজেই পশুপাখি, কিন্তু মানুষ প্রাণপণ চেষ্টায় তবে মানুষ।’ সততা, কর্তব্যপরায়ণতা, শিক্ষা, পরমতসহিষুষ্ণতা, শিষ্টাচার, দেশপ্রেম, মূল্যবোধ অর্জন মানুষকে তার নামের সার্থকতা দেয়। যার মধ্যে শিক্ষা মানুষকে সভ্য, সহনশীল, উদার চেতনায় বিশ্বাসী করে তোলে এবং নৈতিক মূল্যবোধের চর্চাকে উৎসাহিত করে। মূল্যবোধের অনুপস্থিতি সামগ্রিক উন্নয়নকে ব্যাহত করে।

প্রাগৈতিহাসিককাল থেকেই বলা হয়- পরিবার হলো শিশুর প্রথম প্রতিষ্ঠান। যেখানে সে স্নেহ-ভালোবাসা, দায়িত্ব-কর্তব্য, শিষ্টাচারের শিক্ষা পায়। এর পর আসে প্রাতিষ্ঠানিক শিক্ষা। ছাত্র, শিক্ষক এবং শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান- পরস্পরের যোগসূত্র অবিচ্ছেদ্য। শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান ছাত্রছাত্রীদের আলোকিত জীবনের সন্ধান দেয়; যেখানে অনুশীলন হয় মূল্যবোধের। শিক্ষার্থীদের জীবনের আলোকবর্তিকা, মূল্যবোধের কারিগর হলেন শিক্ষক। এ দুইয়ের মেলবন্ধনে একজন ছাত্র সন্ধান পায় সেই অমৃত সুধার, যা তাকে অন্ধকারে পথ হারাতে দেয় না, বরং আলোর দিশা দেয়। মূল্যবোধের যথার্থ বিকাশ প্রজন্মকে সুনাগরিক হিসেবে আত্মপ্রকাশে সহায়তা করে।

প্রচলিত এবং বৈজ্ঞানিকভাবেও এ কথা সত্য- শিশুরা নরম কাদামাটির মতো। তাদের যে গঠন দেওয়া হয়, তারা সে-ই আকার ধারণ করবে। তাই প্রাথমিক বিদ্যালয়ে অধ্যয়নকাল শিক্ষার্থীদের নৈতিক মূল্যবোধ বিকাশের শ্রেষ্ঠ সময়। এ ক্ষেত্রে প্রাথমিক বিদ্যালয়ের শিক্ষকরা নৈতিক গুণাবলিসম্পন্ন আদর্শ মানুষ গঠনে জোরালো ভূমিকা রাখতে পারেন। সত্য কথা বলার অভ্যাস গঠন করে শিষ্টাচারবহির্ভূত আচরণ অগ্রহণযোগ্য করার শিক্ষা দিতে হবে। বয়োজ্যেষ্ঠদের সম্মান, ছোটদের স্নেহ করা শিশুদের সুন্দর ব্যবহারের বহিঃপ্রকাশ- সেটি তাদের বোঝাতে হবে। এ ধরনের আচরণ সবার কাছে গ্রহণযোগ্য হয়, প্রশংসিত হয়- সেটা জানাতে হবে। নিজের কাজ নিজে করার মধ্য দিয়ে স্বাবলম্বী হওয়া এবং অন্যকে সাহায্য করার মাধ্যমে সহযোগিতার মনোভাব গড়ে তুলতে হবে। প্রাথমিক বিদ্যালয় শিক্ষার্জনের প্রথম পর্যায়। তাই শিশুর ধৈর্য ধারণের অভ্যাস বাড়াতে তাদের অনুপ্রাণিত করতে হবে। জীবনে অনেক বাধাবিপত্তি আসবে। সেগুলো উপেক্ষা করে কীভাবে লক্ষ্যে এগিয়ে যেতে হবে- শিশুদের সামনে উপস্থাপন করতে হবে এমন বাস্তব উদাহরণ।

নৈতিক মূল্যবোধের বিকাশ না ঘটলে জীবনের সর্বক্ষেত্রে বিপর্যয়, অবক্ষয় ঘটার আশঙ্কা রয়েছে। যেসব পরিবারে ধর্মীয় অনুশাসন, ইতিবাচক দৃষ্টিভঙ্গির চর্চা আছে সেসব পরিবারের সন্তান ছোটবেলা থেকেই দৃঢ়চেতা, আত্মনির্ভরশীল হয়ে বেড়ে ওঠে। জীবনের কঠিন বিপর্যয়েও পদস্খলন হয় না তাদের। অপরদিকে দুর্বলচিত্তের মূল্যবোধহীন পরিবেশে বড় হওয়া শিশুদের জীবনের পরবর্তী স্তরে বাধাবিপত্তির সম্মুখীন হতে হয়। আত্মবিশ্বাসের অভাবে শিশুরা পিছিয়ে পড়ে। মনোবল ভেঙে যায়।

শিশুরা অত্যন্ত অনুকরণপ্রিয়। তারা শিক্ষক, সহপাঠী, বড়দের আচরণ অনুকরণ করে। তাই প্রাথমিক বিদ্যালয়গুলোতে নৈতিক শিক্ষাকে আবশ্যিক হিসেবে অন্তর্ভুক্ত করতে হবে। ন্যায়-অন্যায়, উচিত-অনুচিত, সত্য-মিথ্যার পার্থক্য বাস্তব উদাহরণ দিয়ে শিশুদের বোঝাতে হবে।
রবীন্দ্রনাথের ভাষায়, ‘আমাদের শিক্ষার মধ্যে এমন একটি সম্পদ থাকা চাই যা কেবল আমাদের তথ্য দেয় না, সত্য দেয়; যা কেবল ইন্ধন দেয় না, অগ্নি দেয়।’ বোধ করি বিশ্বকবি এখানে সেই সত্যের শুভ্রতায় মোহনীয় সম্পদ বলতে মূল্যবোধকেই ইঙ্গিত করেছেন। আজকের শিশু আগামী দিনের ভবিষ্যৎ। তাই এখনই সময় আমাদের ভবিষ্যতের সঠিক পরিচর্যার।

লেখক : উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা, কালীগঞ্জ, ঝিনাইদহ

শেয়ার করুন