অর্থের বিনিময়ে টিকা না নিয়েও সুরক্ষা অ্যাপে সনদ, এনআইডি-জন্মসনদ

নিজস্ব প্রতিবেদক

করোনাভাইরাসের টিকা প্রক্রিয়া সহজতর করতে সরকারের তৈরি সুরক্ষা অ্যাপসের নিয়ন্ত্রণ এখন প্রতারকদের হাতে। কেউ সুরক্ষা অ্যাপসে গিয়ে রেজিস্ট্রশন করার পর প্রতারকচক্রের সদস্যদের জানালে তারা টিকা প্রদান ছাড়াই বের করে দিচ্ছে টিকার সনদ। এজন্য নিচ্ছে নির্ধারিত ফি। অনলাইনে বিভিন্ন গ্রুপে রীতিমতো বিজ্ঞাপন দিয়ে হাতিয়ে নেওয়া হচ্ছে মোটা অংকের টাকা।

সুরক্ষা অ্যাপস ও জাতীয় পরিচয়পত্র তৈরির সার্ভার প্রতারণা চক্রের চার সদস্যকে গ্রেফতার করেছে ঢাকা মহানগর গোয়েন্দা পুলিশের (ডিবি) গোয়েন্দা সাইবার আ্যন্ড স্পেশাল ক্রাইম বিভাগ।

গ্রেফতাকৃতরা হলেন- একরাম হোসেন (২০), জাহিদুল হাসান (১৯), আব্বাস উদ্দীন (২৮) ও সানোয়ার কবির (৩৭)।

৭ অক্টোবর সুনামগঞ্জের তাহিরপুর এলাকায় অভিযান চালিয়ে একরাম হোসেন, কানাইঘাটের অভিযান চালিয়ে আব্বাস উদ্দীন ও ময়মনসিংহের কালাইঘাট থেকে সানোয়ার কবিরকে গ্রেফতার করে ডিবি।

৬ অক্টোবর রাজধানীর কামরাঙ্গীর চর থেকে একরাম হোসেনকে গ্রেফতার করা হয়। তাদের কাছ থেকে ৭টি মোবাইল ফোন ও ১৩টি সিমকার্ড জব্দ করা হয়েছে।

এদের মধ্যে সানোয়ার কবির নির্বাচন কমিশনের কম্পিউটার অপারেটর। তার শিক্ষাগত যোগত্য মাস্টার্স। অন্য তিনজন ছাত্র। তাদের মধ্যে একজন মাদ্রসায় পড়েন।

ডিবির সাইবার আ্যন্ড স্পেশাল ক্রাইম বিভাগ জানায়, দীর্ঘদিন ধরে সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যম ফেসবুক এবং হোয়াটসঅ্যাপসসহ বিভিন্ন গ্রুপে প্রচারণা চালিয়ে এনআইডি, জন্মসনদ ও করেনাভাইরাসের টিকাদানের সনদ বিতরণ করছিল একাধিক চক্র। যথাযথ কর্তৃপক্ষের অগোচরে চক্রের সদস্যরা হাতিয়ে নিচ্ছিল মোটা অংকের টাকা।

যেভাবে দেওয়া হতো করোনা টিকার সার্টিফিকেট, জন্ম নিবন্ধন সনদ ও এনআইডি-

অনলাইনে প্রতারকচক্রের একটি গ্রুপে গিয়ে দেখা যায়, চক্রের ক্লোন সার্টিফিকেটের জন্য যেসব তথ্য চেয়ে বিজ্ঞাপন দিয়েছে সেগুলোর মধ্যে আছে জাতীয় পরিচয়পত্রের নম্বর, পাসপোর্ট নম্বর, নাম ও জন্ম তারিখ ইত্যাদি।

বিজ্ঞাপনে বলা হয়েছে, আসল সনদ নিতে হলে অবশ্যই রেজিস্ট্রেশন করতে হবে। সেখানে লেখা আছে, ব্যাক ডেট দিয়ে একসঙ্গে দুই ডোজ কমপ্লিট করা সার্টিফিকেট দেওয়া হচ্ছে। দেওয়া হচ্ছে কোভিড টেস্টের নেগেটিভ ও পজেটিভ সার্টিফিকেট। হারানো আইডি কার্ড ফেরত দেওয়া হচ্ছে। ডাবল ভোটারের অ্যাক্টিভেট কপির পাশাপাশি বিভিন্ন ধরনের মোবাইল সিমের বায়োমেট্রিক করা হয়। কাজ চলিতেছে বিুদ্যুতের গাতিতে। দ্রুত নক দেন।

ওই গ্রুপের আরেকটি বিজ্ঞাপনে লেখা আছে, সারাদেশের যেকোনো ইউনিয়ন পরিষদ থেকে জন্মসনদের নিবন্ধন দেওয়া হয়। শুধুমাত্র নিজের নাম সংশোধনের জন্য ৬০০ টাকা। অগ্রীম পেমেন্ট আবশ্যক। ওই গ্রুপে আরও বলা হয়েছে, এনআইডি কার্ড দেয়া চলছে।

বিক্রি হচ্ছে এনআইডি অ্যাকাউন্ট

সুরক্ষা এনআইডি সফটওয়্যার নামক একটি গ্রুপে বলা হয়েছে, আপনাদের জন্য এখন এনআইডি অ্যাকাউন্ট পাইকারি রেট। পারলে যত খুশি বিক্রি করেন। আজীবন গ্যারান্টি দিলাম। এনআইডি সার্ভারের ভিআইপি অ্যাকাউন্ট খুলে দিতে পারবো এখন। যেখানে একজন ইউজারের জন্য একটা ফুল সার্ভার বরাদ্দ থাকবে। রেট ১২০০ টাকা ফিক্সড, যদি নেন। ওই গ্রুপে আজীবন গ্যারান্টি দিয়ে নতুন এনআইডি সার্ভরের একটি লিংক দিয়ে বলা হয়েছে, যাদের লাগবে পেমেন্ট করেন।

হারানো আইডি কার্ড উত্তেলন। নামের একটি গ্রুপে বলা হয়েছে, কাজ চলমান। সার্ভিস ভালো। সাইন কপি ও সার্ভার কপি ২-৩ মিনিটের মধ্যে ডেলিভারি।

আমাদের সেবাসমূহ হারানো আইডি কার্ড, জন্মসনদ, সব সিমের বায়োমেট্রিক, জন্মনিবন্ধন সনদ, ডাবল ভোটারদের একটি বাতিল করে অন্যটি একটিভ করা, যারা টিকা দিয়েছেন কিন্তু কার্ড পাননি তাদের কার্ড দেওয়া।

গ্রেফতারকৃতরা যে যেই ভূমিকায়-

গ্রেফতারদের মধ্যে একরাম হোসেন এনআইডি, করোনা ভ্যাকসিন এবং জন্মনিবন্ধন প্রতারণার সঙ্গে নিজের সম্পৃক্ততার কথা স্বীকার করেছেন। জাহিদুল ইসলাম এনআইডি প্রতারণায় জড়িত বলে জানিয়েছেন। আব্বাস উদ্দীন এনআইডি এবং করোনা ভ্যাকসিন প্রতাণায় জড়িত বলে স্বীকার করেছেন। সানোয়ার হোসেন এনআইডি নম্বরের বিপরীতে সব ধরনের তথ্য উপাত্ত সরবরাহ করেন বলে ডিবির কাছে প্রাথমিকভারে স্বীকার করেছেন।

একরাম ফেসবুক ও হোয়াটসঅ্যাপসে এনআইডি তথ্য সরবরাহ, করোনা ভ্যাকসিন আপডেট ও জন্মনিবন্ধন তথ্য পরিবর্তনের বিজ্ঞাপন দিয়ে গ্রাহক সংগ্রহ করতেন। এছাড়া ভ্যাকসিন সুরক্ষা অ্যাপস সার্ভারে প্রবেশের অ্যাকসেস থাকায় একরাম নিজেই অর্থের বিনিময়ে অবৈধভাবে ভ্যাকসিন আপডেট করতেন।

গ্রাহকদের কাছ থেকে এনআইডি কার্ডের অর্ডার নিতেন জাহিদুল। ২০০ থেকে ২৫০টি সংগ্রহের পর তা আব্বাসের কাছে দিতেন। ৮০০ থেকে ১০০০ অর্ডার সংগ্রহের পর তা সানোয়ারের কাছে পাঠাতেন আব্বাস। সানোয়ার এনআইডি নিবন্ধনকারী কম্পিউটার অপারেটর হওয়ায় সার্ভারে তার একসেস রয়েছে। ওই একসেসকে কাজে লাগিয়ে অর্থের বিনিময়ে এনআইডি কার্ড সরবরাহ করতেন তিনি।

একরাম ও আব্বাস দুই বছর ধরে এবং জাহিদুল ও সানোয়ার তিন বছর ধরে এ ধরনের প্রতারণায় জড়িত। গত ছয় মাসে প্রতারণার মাধ্যমে একরাম হোসেন ৩৭ লাখ ৪১ হাজার, জাহিদুল হাসান ৪৪ লাখ ৪৩ হাজার, আব্বাস উদ্দীন ৬৬ লাখ এবং সানোয়ার কবির ১৪ লাখ ১৩ হাজার টাকা উপার্জন করেছেন।

জানতে চাইলে ডিএমপির গোয়েন্দা ফাইন্যান্সিয়াল ক্রাইম ইনভেস্টিগেশনের সাইবার আ্যন্ড স্পেশাল ক্রাইম বিভাগের অতিরিক্ত উপ-পুলিশ কমিশনার (এডিসি) জুনায়েদ আলম সরকার বলেন, সুরক্ষা অ্যাপস ও এনআইডি সার্ভার প্রতারক চক্রের চার সদস্যকে গ্রেফতার করলেও সারাদেশেই চক্রের নেটওয়ার্ক গড়ে উঠেছে। আমরা এ নেটওয়ার্ক গুড়িয়ে দেয়ার লক্ষ্যে কাজ করছি।

প্রতারক চক্রের সদস্যদের কাছ থেকে মানুষের এসব সেবা নেয়ার কারণ হিসেবে এডিসি জুনায়েদ আলম সরকার বলেন, হারিয়ে যাওয়া এনআইডি কার্ডের কপি নিতে হলে সরকারির ফি দিতে হয় ২০০ টাকা। এছাড়া থানায় জিডি করতে হয়। কিন্তু এ চক্রের সদস্যদের কাছ থেকে নিতে হলে কোনো জিডির প্রয়োজন হয় না। ১০০ টাকার বিনিময়েই তারা কার্ড দিয়ে দিচ্ছে। সময়ও কম লাগছে।

ডিবি-সাইবার আ্যন্ড স্পেশাল ক্রাইম (উত্তর) বিভাগের উপ-পুলিশ কমিশনার (ডিসি) মোহাম্মদ তারেক বিন রশিদ বলেন, করোনার টিকা দেয়া ছাড়া বৈধভাবে টিকা সনদ পাওয়া সুযোগ নেই। কিন্তু বিদেশ যাওয়াসহ জরুরি কাজে অনেকের টিকা সনদের প্রয়োজন হয়। তাই দ্রুত সনদ পেতে তারা এ চক্রের দ্বারস্থ হচ্ছে।

তিনি বলেন, এ চক্রের সঙ্গে জড়িত নির্বাচন কমিশনে কর্মরত একজনকে এরই মধ্যে গ্রেফতার করা হয়েছে। চক্রটির সঙ্গে নির্বাচন কমিশন এবং স্বাস্থ্য অধিদপ্তরসহ সরকারে সংশ্লিষ্ট বিভাগের অন্য কেউ জড়িত কি না সে বিষয়টি তদন্ত করে দেখা হচ্ছে। যারাই জড়িত থাকবে তাদেরই আইনের আওতায় আনা হবে।

শেয়ার করুন