মদিনা সনদ : সম্প্রীতি ও সহাবস্থানের ঐতিহাসিক দলিল

র আ ম উবায়দুল মোকতাদির চৌধুরী

আমাদের প্রিয় নবী হজরত মোহাম্মদ (সা.) মক্কা থেকে ইয়াসরেবে অভিবাসী হওয়ার (হিজরত করার) কিছুদিন পর ইয়াসরেবে বিভিন্ন ধর্মীয় ও জাতিগোষ্ঠীর সঙ্গে এক ঐতিহাসিক চুক্তি স্বাক্ষর করেন, যা পরবর্তী সময়ে ঐতিহাসিক মদিনা চুক্তি নামে খ্যাতি লাভ করে। এই চুক্তি হয়েছিল মুহাজির মুসলিম ও আনসার মুসলিম যাদের বেশির ভাগ ছিলেন মুসলিম কোরাইশ এবং ইয়াসরেব ও তৎসংলগ্ন এলাকার অমুসলিম সম্প্রদায়সমূহের পারস্পরিক সম্পর্ক নির্ধারণে নীতিমালা প্রণয়নের উদ্দেশ্যে। এই চুক্তির উদ্দেশ্য ছিল ইয়াসরেবের সব ধর্মীয় সম্প্রদায় ও গোষ্ঠী এবং জাতিসমূহকে নিয়ে এমন একটি কাঠামো তৈরি করা, যা আধুনিক রাষ্ট্র—বৈজ্ঞানিক পরিভাষার ‘রাষ্ট্র’ গঠনে মুখ্য ভূমিকা পালন করবে। ইয়াসরেব মদিনাতুন্নবি নামকরণের পূর্বেই এই চুক্তি সম্পাদিত হয়েছিল। ধর্ম-বর্ণ-গোষ্ঠীনির্বিশেষে সবাইকে একত্র করে একটি রাজনৈতিক কাঠামোর মধ্যে নিয়ে আসার মৌল চিন্তা থেকে সম্পাদিত এই চুক্তি। চুক্তির অন্তর্ভুক্ত সব মানুষ একই রক্ষাব্যূহে আবদ্ধ থেকে বহিঃশত্রুর মোকাবিলা করবে এবং নিজেদের মধ্যে সম্প্রীতি, সৌহার্দ আর সহাবস্থান বজায় রেখে নিজেদের ঐক্যকে সুদৃঢ় করবে। বস্তুত শুধু সম্প্রীতি আর সৌহার্দের মধ্যে আবদ্ধ থাকেনি এই চুক্তি। আরবের গোষ্ঠী-গোত্র বিভক্ত সমাজ কখনো রাষ্ট্র কী, তা জানত না। ইয়াসরেবের ঐতিহাসিক চুক্তির পরই ইয়াসরেব ও পার্শ্ববর্তী এলাকা নিয়ে একটি রাষ্ট্র গড়ে ওঠে। সেদিক থেকে বিবেচনা করলে ইয়াসরেবের এই চুক্তি, অনেকেরই মতে মানবেতিহাসের প্রথম লিখিত সংবিধান। পবিত্র কোরআনের বিদ্যমানতা সত্ত্বেও এই মানবরচিত চুক্তি বা সংবিধান রচনা অত্যাবশ্যকীয় ছিল বিধায় নবী করিম (সা.) এই চুক্তিতে পৌঁছেছিলেন। কেননা, কোনো রাষ্ট্রেই কেবল একক বিশ্বাস ও ভাবনাচিন্তার মানুষেরা বসবাস করে না। ধর্ম-বর্ণ-বিশ্বাস আর সংস্কৃতির বৈচিত্র্য নিয়েই নাগরিকেরা একটি রাষ্ট্রে বসবাস করে থাকে। ইসলামের সর্বশেষ ভাষ্যের উদ্গাতা, মহানবী মোহাম্মদ (সা.) এ কথা জানতেন বলেই নাগরিকদের নিজস্ব ধর্মীয় সংস্কৃতি ও চিন্তার স্বাধীনতার স্বীকৃতি দিয়ে তিনি এই চুক্তি করেছিলেন, যা আজকের মদিনা সনদ।

মানুষে মানুষে বৈরিতা নয়, পারস্পরিক সৌহার্দ হচ্ছে এই চুক্তির মূলমন্ত্র। তদানীন্তন সময়ে ইয়াসরেবে ও পার্শ্ববর্তী জনপদসমূহকে সুরক্ষা ও সুশাসনের এবং মৈত্রীর এক ছাতার নিচে আসার জন্যই চুক্তি করা হয়েছিল। চুক্তির ধারা উপধারাসমূহ মনোযোগ সহযোগে দেখলেই বুঝতে অসুবিধা হবে না যে, সম্প্রীতি আর সহাবস্থান মানুষের জীবনে বিশেষত রাষ্ট্রীয় ও সমাজ-জীবনে কতটা প্রয়োজনীয়। হিজরতের পরপরই নবী মোহাম্মদ (সা.) পরস্পরবিরোধী চিন্তা, সংস্কৃতি ও ধর্মীয় স্বাতন্ত্র্য বজায় রেখে কীভাবে একই লক্ষ্যে একত্র হওয়া যায়, সেই চিন্তা থেকেই চুক্তিটি সম্পাদিত হয়েছিল। পৌত্তলিক, ইহুদি, খ্রিষ্টান, মুসলমান আনসার আর মুহাজিরদের একটি প্ল্যাটফরমে সমবেত করার চুক্তি হচ্ছে এই সনদ। আরবের রাজনৈতিক-সামাজিক মানচিত্রে বৃত্তের দেশজ ভাবনা (National Unity-এর ভাবনা) ছিল অনুপস্থিত। নগরবাসী আর বেদুইন উভয় শ্রেণির মানুষের ঐক্যচেতনা (Unity thinking) গোত্র ও গোষ্ঠীর গণ্ডিতেই আবদ্ধ ছিল। এই রকম রাজনৈতিক ও সামাজিক পরিবেশে সবাইকে সমস্বার্থের তথা আবাসভূমির সুরক্ষায় বা দেশের সুরক্ষায় সমবেত করার কাজটি ছিল খুবই সহজ। কিন্তু এই দুরূহ কাজটিই সফলভাবে সম্পাদন করতে পেরেছিলেন হজরত মোহাম্মদ (সা.), লিখিত চুক্তিতে সকল পক্ষকে স্বাক্ষর করিয়ে নিতে পেরে।

ইয়াসরেববাসীদের এই চুক্তি ইয়াসরেবের নাম মদিনাতুন্নবি হওয়ার পর ‘মদিনা সনদ’ নামে পরিচিতি লাভ করে, যা আজও বিদ্যমান। একটি মানবসমাজ বা একটি আবাসভূমির বাসিন্দারা কীভাবে সম্প্রীতি ও সৌহার্দ বজায় রেখে সহাবস্থান করতে পারে এবং একই লক্ষ্যে কাজ করতে পারে তার উজ্জ্বল দৃষ্টান্ত হচ্ছে এই ইয়াসরেব চুক্তি বা মদিনা সনদ। এই সনদবলে আরবে এক নতুন ধরনের রাজনৈতিক কাঠামো গড়ে ওঠে। অনেকগুলো গোত্র ও গোষ্ঠী এবং জাতিসত্তা মিলে একটি ‘কওম’ বা ‘জাতি’ বা ‘ন্যাশন’ গড়ে ওঠা সম্ভব হয়ে যায় এই সনদের বলে। এই চুক্তি বা সনদে বলা হয়েছে :‘এই চুক্তি নবী ও আল্লাহর রসুল (সা.)-এর পক্ষ থেকে কোরাইশ (এখানে মক্কাবাসী মোহাজেরদের বোঝানো হয়েছে)।’ ইয়াসরেবেরই লোকদের মধ্যে এবং তাহাদের মধ্যে যাহারা তাহাদের অনুসরণ করিবে এবং প্রয়োজনে জিহাদে অংশগ্রহণ করিবে এই প্রকার লোকেরা (অর্থাৎ চুক্তির অন্তর্ভুক্ত যারা) একত্রে অন্যান্য, লোক হইতে স্বতন্ত্র একটি উম্মতে বা জাতিতে পরিগণিত হইবে। (ইসলামী বিশ্বকোষ, ২০শ খণ্ড)। এই প্রসঙ্গে মাওলানা আকরম খাঁ সাহেব প্রখ্যাত ইসলামি চিন্তাবিদ ও দৈনিক আজাদ পত্রিকার সম্পাদক, মালিক (অধুনালুপ্ত) বলেন, “মদীনা ও তত্পার্শ্ববর্তী পল্লীগুলি এখন বিভিন্ন ধর্মাবলম্বী তিনটি (বস্তুত অনেকগুলি), যেমন খ্রিষ্টান ও পৌত্তলিকদের নানা ধরন স্বতন্ত্র জাতির আবাসভূমি। পরস্পর বিরোধী চিন্তা, রুচি ও ধর্মভাবাপন্ন ইহুদী (খ্রিষ্টান), পৌত্তলিক ও মুসলমানদিগকে দেশের (ইয়াসরেব ও পার্শ্ববর্তী অঞ্চলসমূহ) সাধারণ স্বার্থ রক্ষা ও মঙ্গল বিধানের জন্য; একই কর্মকেন্দ্রে সমবেত করিতে হইবে, তাহাদিগকে একটা রাজনৈতিক ‘জাতি’ বা ‘কওমে’ পরিণত করিতে হইবে। তাহাদিগকে শিখাইতে হইবে যে, এক দেশের বিভিন্ন ধর্মাবলম্বী সম্প্রদায়সমূহ, নিজেদের ধর্মগত স্বাতন্ত্র্য সম্পূর্ণ রক্ষা করিয়াও দেশের সেবা-কার্যে একত্রে সমবেত হইতে পারে এবং এইরূপ হওয়াই কর্তব্য।” মাওলানার এই বক্তব্য যে, আজকের এক শ্রেণির সংকীর্ণবাদী ধর্মান্ধ গোষ্ঠীগুলির বিরুদ্ধে কত বড় অবস্থান তা বুঝদার মানুষেরা সহজেই বুঝতে পারেন। এই যে চুক্তির অন্তর্ভুক্ত পক্ষসমূহ, চাই সে পৌত্তলিক, ইহুদি, খ্রিষ্টান বা মুসলমান, যেই হোক না কেন, সবাই মিলে একটি ‘উম্মাহ বা জাতি’ নবী করিম (সা.)-এর এই মহান দর্শন আজকের কুযুক্তির ধর্মান্ধদের দ্বারা লাঞ্ছিত হচ্ছে। তাই সাম্প্রদায়িক সম্প্রীতির ক্ষেত্রে, নানা সংস্কৃতির, নানা ধর্মের, নানা ভাবনাচিন্তার লোকদের সহাবস্থানের পক্ষে ‘মদিনা সনদ এক ঐতিহাসিক ঘোষণা। মদিনা সনদের অনুসরণ হচ্ছে সুন্নতে নববী (সা.)।

মদিনা সনদের অন্তর্ভুক্ত গোষ্ঠী ও গোত্রসমূহ : ১. মক্কা থেকে হিজরত করা কোরাইশ ও অন্যান্য মুসলিম; ২. মদিনা বা ইয়াসরেবের মুসলিমগণ যারা মোহাজেরদের আশ্রয় দিয়েছেন; ৩. মদিনার বা ইয়াসরেবের আওফ গোত্র, বনি হারিস গোত্র, বনি সায়েদা গোত্র, বনি জুশাম গোত্র, বনি নাজ্জার গোত্র, বনি আমর ইবনে আওফ গোত্র, বনি নাবিত গোত্র, বনি ছালাবা গোত্র, বনি জুফনা, বনি শাবাতায়; ৪. ইহুদিগণ; ৫. খ্রিষ্টানগণ; ৬. হানাফগণ (যারাই এই চুক্তি মেনে চলবেন)।

এই সনদে স্পষ্ট ভাষায় বলা হয়েছে, ‘বনু আওফের ইহুদিরা মুমিনদের সঙ্গে একই উম্মতরূপে গণ্য হবে। ইহুদিদের জন্য তাদের ধর্ম, মুসলমানদের জন্য তাদের ধর্ম—তবে যে ব্যক্তি জুলুম বা অপরাধ করবে, সে নিজেকে ও নিজ গৃহবাসীদের ছাড়া অন্য কাউকেই ক্ষতিগ্রস্ত করবে না।’ মদিনা সনদের ভিত্তিতে প্রতিষ্ঠিত রাষ্ট্রটি ছিল, বস্তুতপক্ষে একটি অসাম্প্রদায়িক ও ধর্মনিরপেক্ষ রাষ্ট্র। চুক্তিটির একটি গুরুত্বপূর্ণ ধারা হচ্ছে :‘আল্লাহ তাআলার দায়িত্ব সবার জন্য সমান।’

অতএব, আমরা নির্দ্বিধায় বলতে পারি যে, যারা সাম্প্রদায়িক সহিংসতার বীজ বপন করে, যারা ধর্মীয় সংকীর্ণতাকে মানুষের ওপর চাপিয়ে দিতে চায়, তারা কার্যত নবী করিম (সা.)-এর সুন্নতের বিরুদ্ধে। এই ধরনের সাম্প্রদায়িক শক্তির বিরুদ্ধে রুখে দাঁড়ানো সকল মুসলমান ও শান্তিবাদী মানুষের কর্তব্য। আসুন, আমরা সকলে মিলে সাম্প্রদায়িক সম্প্রীতি ও মানবিক সহাবস্থানের পক্ষে কাজ করি এবং অপশক্তিসমূহকে রুখে দিয়ে সামনে পথ চলি। নাসরুম্মিনাল্লাহে ওয়া ফাতহুন কারিব—অর্থাৎ আল্লাহ্র সাহায্য ও বিজয় সমাগত।

লেখক : সংসদ সদস্য, ব্রাহ্মণবাড়িয়া-৩
সম্পাদক, মত ও পথ।

শেয়ার করুন