রাজধানীতে চলাচলরত গণপরিবহনে ভাড়া নৈরাজ্য চলছেই। সেই সঙ্গে অবৈধ ওয়েবিল তো আছেই। রাজধানীর প্রতিটি রুটে অবৈধ ওয়েবিল বসিয়ে যাত্রীদের কাছ থেকে বাসের মালিক-শ্রমিকরা মনগড়াভাবে ভাড়া আদায় করছে। অথচ সরকার থেকে এই অবৈধ ওয়েবিল বন্ধ করে দেওয়া হয়েছে। কে শোনে কার কথা? আসলে কার নির্দেশে চলছে এই অবৈধ ওয়েবিল বাণিজ্য; যার কারণে অবৈধ ওয়েবিল ভাড়ায় যাত্রীরা দিশেহারা।
আমাদের দেশে তেলের দাম যে পরিমাণ বেড়েছে তার থেকে কয়েকগুণ বেশি বেড়েছে বাস ও অন্যান্য গণপরিবহন ভাড়া। নির্ধারিত ভাড়ারও কয়েকগুণ বাড়তি ভাড়া আদায় করে বাসের শ্রমিকরা। সরকার বর্ধিত ভাড়া আদায় বন্ধে কখনই বাস মালিক-শ্রমিকদের বিরুদ্ধে কোনো ব্যবস্থা নিচ্ছে না। ফলে বাসের মালিক-শ্রমিক সিন্ডিকেটের কাছে আজ সাধারণ মানুষ জিম্মি।
যাত্রীরা বলছেন, মালিকের দোহাই দিয়ে চালক-শ্রমিকরা তাদের গলা কাটতে চাচ্ছেন। মিরপুরের বাসিন্দা মুনতাসির বলেন, সরকার বলেন সর্বনিম্ন ভাড়া ১০ টাকা। তা না হয় মানলাম। কিন্তু আবার বলা আছে, কিলোমিটার হিসাবে ভাড়া হবে। দূরে যেতে গেলে তারা আবার কিলোমিটার হিসেবে ভাড়া নেবে না। তখন তারা নেবে ওয়েবিল হিসেবে। ওরা আসলে কোনটা ধরে ভাড়া নিচ্ছে- এটাই আমরা বুঝতে পারি না।
মিরপুর-১২ থেকে মাটিকাটা ইসিবি পর্যন্ত চার কিলোমিটারে ১০ টাকা ভাড়া হয়। অথচ ওই রুটে চলাচলকারী বাসগুলো যাত্রীদের কাছ থেকে নিচ্ছেন ২৫ টাকা। ওয়েবিল নিষিদ্ধ হলেও সেই অনুযায়ী ভাড়া নেওয়া হচ্ছে।
গণপরিবহণে প্রতারণার নাম ওয়েবিল। ওয়েবিলের নাম করে অযথা বেশি ভাড়া আদায় ও সময়ক্ষেপণ করেন গণপরিবহণের চালক ও কর্মচারীরা। প্রতারণার মাধ্যমে ওয়েবিলের নামে টাকা বেশি নেওয়ায় নিয়মিতই যাত্রীদের দুর্ভোগ পোহাতে হচ্ছে। যাত্রাপথে বারবার বাস থামিয়ে ওয়েবিল নামক কাগজে স্বাক্ষর নেওয়া যেন এক যন্ত্রণায় পরিণত হয়েছে। তবে বাস মালিক সমিতি আনুষ্ঠানিকভাবে এই ওয়েবিল নামক যন্ত্রণার পদ্ধতি বন্ধ ঘোষণা করলেও রাজধানীর কোনো রুটেই এ পদ্ধতি এখনো কার্যকর হয়নি। মালিক সমিতি অবশ্য ঘোষণার পর থেকে বন্ধ কার্যক্রমে তেমন কোনো তদারকিও করছে না। যাত্রী হয়রানি ও বাস ভাড়া বেশি নেওয়ার এ প্রতারণার ওয়েবিল কার নির্দেশে এখনো চলছে এই প্রশ্ন এখন সাধারণ যাত্রী ও পরিবহন সংশ্লিষ্টদের।
পরিবহন সংশ্লিষ্টরা বলছেন, ওয়েবিলে যখন গণপরিবহন চলাচল করে তখন নির্দিষ্ট বাস স্টপেজের জন্য তাদের নির্ধারিত ভাড়া দিতে হয়। পরবর্তী স্টেশনে নামলে বা ওয়েবিল যেখানে চেক করা হয় তারপর নামলেই বেশি ভাড়া দিতে হয়। কিছুক্ষণ পরপরই চেকার উঠে গাড়ির যাত্রী গণনা করেন এবং ওয়েবিলে স্বাক্ষর করেন। এই ওয়েবিলে স্বাক্ষরের বিনিময়ে তিনি ১০ টাকা করে হেলপারের কাছ থেকে নেন। আর এই টাকা প্রতি ট্রিপে কয়েক স্থানে দিতে হয়। এতে নিদিষ্ট গন্ত্যব্যে যেতে যাত্রী প্রতি নেওয়া হয় বেশি ভাড়া। কারণ ওয়েবিল চেকারের কোনো নির্ধারিত বেতন নেই। বাসের যাত্রী চেক করার পর যে ১০ টাকা নেন সেটাই তার পারিশ্রমিক। এভাবে চেকাররা তার নিদিষ্ট কোম্পানির বাস থেকে ওয়েবিলের নামে টাকা তোলেন। আর এই টাকা সাধারণ যাত্রীদের পকেট থেকেই নেওয়া হচ্ছে। এতে যাত্রীদের যাতায়াত ভাড়া বেশি দিতে হচ্ছে বলে জানান তারা।
নাম প্রকাশ না করার শর্তে কয়েকজন ওয়েবিল চেকার বলেন, বাস মালিকদের সিদ্ধান্তেই আমরা কাজ করছি। আমাদের নির্ধারিত বেতন নেই। বাস থেকেই বেতনের টাকা তুলতে হয়। চেকিং পয়েন্টের পরে নামলে ১০ থেকে ২৫ টাকা ভাড়া বেশি দিতে হয় এমন প্রশ্নের জবাবে তারা বলেন, এ বিষয়ে আমরা কিছু জানি না। আমরা শুধু যাত্রীর হিসাব রাখি। ভাড়া কম বেশি নেওয়া চালক হেলপারের কাজ।
গণপরিবহণে চলছে এখন লুটপাটের মতো অবস্থা। যে যার মতো করে ভাড়া আদায় করছে। কোনো নিয়ম-কানুনের বালাই মানছে না বাস শ্রমিকরা। বাসের নৈরাজ্য যেন থামছেই না। তাহলে সাধারণ মানুষের কী হবে- এটা ভাবার দায়িত্ব কার? সবমিলিয়ে এক হাঁসফাঁস অবস্থা। এর দায়ভার কে নেবে? কে শুনবে সাধারণ যাত্রীদের দুর্দশার কথা। কে করবে এর সমাধান? সরকারের সংশ্লিষ্ট কর্তৃপক্ষ কী বিষয়টা নিয়ে একটু ভাববেন?
লেখক : সাংবাদিক ও কলামিস্ট