মাথাপিছু আয় যদি বিশ্বব্যাপী কমে যায়, তাহলে সেটাকে বলে বিশ্বমন্দা। করোনা মহামারি পৃথিবীকে করেছিল স্তব্ধ। মন্থর হয়েছিল অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধি। করোনার রেশ কাটতে না কাটতেই শুরু হয়েছে রাশিয়া-ইউক্রেনের যুদ্ধ। যুদ্ধে পক্ষ-বিপক্ষের শক্তি একে অন্যকে ধরাশায়ী করার বিভিন্ন কৌশল অবলম্বন করেছে। রাশিয়ার ওপর পশ্চিমা বিশ্বের অর্থনৈতিক ও বাণিজ্যিক অবরোধে পৃথিবীব্যাপী সৃষ্টি হয়েছে জ্বালানিসংকট এবং ভেঙে পড়েছে খাদ্যের সরবরাহব্যবস্থা। জ্বালানিসংকটে ইউরোপ জুড়ে বিদ্যুতের ঘাটতি এমন পর্যায়ে পৌঁছেছে যে, মোমবাতির আলোয় চলছে ইউরোপের কোনো কোনো দেশে রেস্টুরেন্টের কার্যক্রম। এমন পরিস্থিতিতে বাংলাদেশও অর্থনৈতিকভাবে স্বস্তিতে নেই। ডলারের দাম বাড়ার ফলে আমদানি ব্যয় বেড়েছে। হুমকির মুখে পড়েছে প্রান্তিক জনগোষ্ঠীর খাদ্যনিরাপত্তা।
প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা সম্প্রতি যুক্তরাজ্য ও যুক্তরাষ্ট্র সফর শেষে দেশে ফিরে সংবাদ সম্মেলনে স্পষ্ট করেই বলেছেন যে, আগামী বছর বিশ্বব্যাপী অর্থনৈতিক মন্দা সবচেয়ে খারাপ আকার ধারণ করবে। তিনি এই মন্দা মোকাবিলায় সতর্কতামূলক ব্যবস্থা গ্রহণের আহ্বান জানিয়েছেন এবং এই লক্ষ্যে সবাইকে সাশ্রয়ী হতে বলেছেন। তিনি কৃষির উৎপাদন বৃদ্ধির আহ্বানও জানিয়েছেন। এ আশঙ্কা যে শুধু প্রধানমন্ত্রী করেছেন, তা নয়; বিশ্বের অনেক নামিদামি অর্থনীতিবিদ এবং আর্থিক খাতের বিশ্লেষকগণও একই ধরনের আশঙ্কা ব্যক্ত করে আসছেন অনেক আগে থেকেই। তাই বৈশ্বিক মন্দা মোকাবিলায় ব্যাংকিং ও আর্থিক খাত, কর্মসংস্থান খাত, অভ্যন্তরীণ উৎপাদন খাত ও বাণিজ্যিক খাতের দিকে বিশেষ নজরদারি এখন সময়ের দাবি।
ব্যাংকিং ও আর্থিক খাতে আমাদের মূল সমস্যা দুর্নীতি, অর্থের অপচয়, মুদ্রা পাচার, কর্মসংস্থানের অপ্রতুলতা ইত্যাদি। এর সঙ্গে এখন যুক্ত হয়েছে জ্বালানিসংকট। ফলে অভ্যন্তরীণ উৎপাদনের পরিমাণ হ্রাস পাওয়ার সম্ভাবনা রয়েছে। মূল্যস্ফীতির কারণে বৈদেশিক মুদ্রার রিজার্ভ কমছে, টাকার বিনিময় হারের সঙ্গে সঙ্গে কর্মসংস্থানের সমস্যাগুলো ধীরে ধীরে আরো প্রকট হয়ে উঠছে। এই সমস্যাগুলো মোকাবিলায় আমাদের সমন্বিত পদক্ষেপ নিতে হবে। আর্থিক খাতের সব প্রতিষ্ঠান, যেমন :বাংলাদেশ ব্যাংক, এনবিআর, কাস্টমস, এক্সপোর্ট প্রমোশন ব্যুরো সবাইকে একযোগে সমন্বিত পন্থায় কাজ করতে হবে। রপ্তানিতে আন্ডার ইনভয়েজিং, ওভার ইনভয়েজিং হচ্ছে কি না, এ বিষয়ে সব মন্ত্রণালয় এবং সংস্থাকে আন্তরিকভাবে নজরদারি বাড়াতে হবে। মন্দা মোকাবিলায় আর্থিক খাতে শৃঙ্খলা ও সুশাসন প্রতিষ্ঠা করা জরুরি। খেলাপি ঋণ ফেরতের ব্যবস্থা করতে হবে, ব্যাংক ঋণ নিয়ে বাইরে অর্থ পাচার করা রোধ করতে হবে। অন্যদিকে কুটিরশিল্প, ছোট ও মাঝারি শিল্পগুলোতে চাহিদা অনুযায়ী সহজ শর্তে ঋণ দিতে হবে।
আমাদের বৈদেশিক মুদ্রা আয়ের প্রধান উৎস হলো প্রবাসী আয়। বিশ্বের ১৭২ দেশে প্রায় ১ কোটি ২৫ লাখ বাংলাদেশি নাগরিক কর্মরত আছেন। ২০২১-২২ সালে প্রবাসী আয় ছিল ২৩ বিলিয়ন ডলার। বৈশ্বিক মন্দার কারণে প্রবাসী আয় হ্রাস পাবে। তথ্যমতে সেপ্টেম্বর এবং অক্টোবর দুই মাসেই প্রবাসী আয়ের সূচক নিম্নগামী। বিশ্বমন্দার এই সময়ে আফ্রিকা এবং দক্ষিণ আমেরিকা মহাদেশে নতুন শ্রমবাজার সন্ধান করতে হবে। আমাদের পাশের দেশ ভারতের প্রায় ৩০ লাখ লোক আফ্রিকাতে কাজ করে। পরিসংখ্যানে জানা যায়, সেখানে কর্মসংস্থানের যথেষ্ট সুযোগ রয়েছে। ২০২১ সালে গ্লোবাল পিস ইনডেক্স (জিপিআই) র্যাংকিংয়ে দক্ষিণ আমেরিকার দেশগুলির মধ্যে প্রথম থেকে পঞ্চম অবস্থানে রয়েছে যথাক্রমে উরুগুয়ে, চিলি, আর্জেন্টিনা, প্যারাগুয়ে ও পেরু। উল্লেখ্য, উরুগুয়ের জিপিআই সূচক যুক্তরাষ্ট্রের চেয়েও বেশি। আয়তনে বাংলাদেশের চেয়ে বড় দক্ষিণ আমেরিকার একটি দেশ গায়ানা, যা ব্রিটিশ কলোনি ছিল এবং এখানকার মাতৃভাষা ইংরেজি। এর জনসংখ্যা প্রায় ৭ লাখ এবং সাম্প্রতিক কালে তেল উত্তোলিত হচ্ছে। তেলনির্ভর এই দেশটি বাংলাদেশিদের কর্মক্ষেত্র হতে পারে। এর পাশেই রয়েছে সুরিনাম নামে আরো একটি বাংলাদেশের সম-আয়তনের দেশ, যা হল্যান্ডশাসিত ছিল। লোকসংখ্যা ৫ লাখ ৭৫ হাজার। এ দেশটিও শিক্ষিত বাংলাদেশিদের কর্মসংস্থানের নতুন গন্তব্য হতে পারে।
গত ৫০ বছরে কৃষি খাতে বাংলাদেশের অর্জন ঈর্ষণীয়। পরিসংখ্যান বলে, অভ্যন্তরীণ উৎপাদন আমাদের চাহিদা মেটানোর জন্য যথেষ্ট। তবে ভোজ্য তেল ও গমের ক্ষেত্রে আমাদের বিদেশের ওপর নির্ভর করতে হয়। দেশের মোট ভোজ্য তেলের চাহিদা ২৪ লাখ টন। এর মধ্যে ৮৮ ভাগ আমদানি থেকে এবং ১২ ভাগ দেশীয় জোগান থেকে পূরণ হয়। আর দেশে গমের চাহিদা রয়েছে ৮৫-৮৬ লাখ মেট্রিক টন। প্রতি বছর গম আমদানি করতে হচ্ছে ৭৪-৭৫ লাখ মেট্রিক টন। আসন্ন খাদ্যসংকট মোকাবিলায় আমাদের অভ্যন্তরীণ উৎপাদন বাড়াতে হবে। এ লক্ষ্যে পতিত জমিগুলোর সদ্ব্যবহার অপরিহার্য। এক্ষেত্রে দ্রুত একটি নীতিমালা তৈরি করা দরকার, যাতে জমি পতিত রাখলে ভূমি মালিকের জবাবদিহিতার ব্যবস্থা থাকে। ভোজ্য তেল ও গমের সংকট নিরসনে আমরা মধ্যপ্রাচ্যের নীতি অনুসরণ করতে পারি। প্রধানমন্ত্রী বারংবার খাদ্যের অপচয় না করার অনুরোধ করছেন। আমাদের দেশে বুফে ব্যবস্থাপনায় চালু রেস্টুরেন্টগুলোতে ২০ থেকে ১০০ ভিন্ন ভিন্ন পদের খাবার ব্যবস্থা থাকে। একজন ক্রেতা এমন রেস্টুরেন্টে খেতে গিয়ে এতগুলো ভিন্নপদের খাবার দেখে সবই একটু করে পরখ করতে চায়। বাস্তব অভিজ্ঞতায় দেখেছি, এক্ষেত্রে রসনাতৃপ্তির চেয়ে অপচয়টাই বেশি হয়। সরকারের কৃচ্ছ্রসাধন নীতির আওতায় এমন রেস্টুরেন্টগুলোকে বর্তমান পরিস্থিতিতে সীমিতসংখ্যক পদের খাবার ব্যবস্থা রাখার ঘোষণা দেওয়া উচিত অথবা প্রত্যেক পদের খাবারের জন্য মূল্য নির্ধারণ করে দেওয়া উচিত।
প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা তার বক্তব্যে বলেছিলেন, ‘অর্থনৈতিক কূটনীতিতে গুরুত্ব দিতে হবে।’ তিনি বলেন, ‘আজকের বিশ্বে কূটনৈতিক মিশনগুলোর দায়িত্ব পরিবর্তিত হয়েছে। এখন রাজনীতির পাশাপাশি অর্থনৈতিক কূটনীতি অবলম্বন করতে হবে, যাতে আমরা দেশের ব্যবসা-বাণিজ্য জোরদার করতে পারি ও বিশ্বের সবার সঙ্গে একত্র হয়ে অর্থনৈতিক স্বনির্ভরতা অর্জন করতে পারি।’ বিভিন্ন দেশে আমাদের কূটনৈতিক মিশনগুলোকে বাণিজ্যের সম্ভাবনা খুঁজে বের করতে হবে।
সর্বোপরি দেশজ উৎপাদন বৃদ্ধি, জাতীয় ও দৈনন্দিন জীবনে সাশ্রয়ী হওয়া, রপ্তানি বৃদ্ধির উদ্যোগ নেওয়া এবং মন্ত্রণালয়গুলোর মধ্যে নিবিড় সমন্বয় সাধন ও আর্থিক খাতে দুর্নীতি রোধই আসন্ন বৈশ্বিক মন্দা মোকাবিলায় কার্যকরী ভূমিকা রাখবে বলে আমি মনে করি।
লেখক : উপাচার্য, চাঁদপুর বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়