একটি দেশ কতটা উন্নত তার অন্যতম নির্ধারক হলো মাথাপিছু বিদ্যুৎ শক্তির ব্যবহার। ডিজিটাল বিশ্ব ব্যবস্থায় বিদ্যুৎ ছাড়া একটি মুহুর্ত চিন্তাও করা যায় না। বাংলাদেশের মতো উন্নয়নশীল দেশের সার্বিক অগ্রগতির মূল চালিকাশক্তি বিদ্যুৎ। আওয়ামী লীগ সরকারের গত এক দশকের প্রচেষ্টায় বিদ্যুৎ খাত ব্যাপক সাফল্য দেখিয়েছে। কিন্তু প্রশ্ন উঠছে, এতদিনে এ খাতের ভিত্তি কতটা মজবুত হয়েছে?
এ বছরের মার্চে শতভাগ বিদ্যুতায়নের সাড়ম্বর ঘোষণা এসেছে। কিন্তু চার মাস না যেতেই জুলাইয়ে শুরু হলো এক ঘণ্টা করে লোডশেডিং। বাস্তবে হয়তো তা আরও বেশি ছিল। তখন বলা হলো এই লোডশেডিং সাময়িক, অক্টোবর থেকে আর থাকবে না। কিন্তু আজ অক্টোবরে এসে দেখা যাচ্ছে, পরিস্থিতির উন্নতি হয়নি বরং এখনকার দিনের লোডশেডিং জনগণের সহনীয়তার মাত্রা ছাড়িয়ে যাচ্ছে।
সার্বিক পরিস্থিতি বিবেচনায় বর্তমান সরকার এই খাতকে যথেষ্ট অগ্রাধিকার দিয়েছে। ২০০৯ সালে শেখ হাসিনার নেতৃত্বাধীন বর্তমান সরকার ক্ষমতায় আসার পরপরই বিদ্যুৎখাতকে ঢেলে সাজানোর উদ্যোগ নেয়। সে লক্ষ্যে বেসরকারি খাতে কুইক রেন্টালের মাধ্যমে বিদ্যুতের সাময়িক চাহিদা মেটানোর পথও বেছে নেওয়া হয়। বিনিয়োগে উৎসাহিত করতে দেওয়া হয় দায়মুক্তির বিধান। কিন্তু অত্যন্ত হতাশার ব্যাপার, সরকারের এই অগ্রাধিকারকে সুযোগ হিসেবে নিয়ে অনেক প্রতিষ্ঠানই নানা টালবাহানায় চাহিদা মোতাবেক বিদ্যুৎ সরবরাহ না করেই চুক্তি অনুযায়ী বাৎসরিক চার্জ তুলে নিচ্ছে।
১৯৭১ সালের ডিসেম্বরে বাংলাদেশের বিদ্যুৎ উৎপাদন সক্ষমতা ছিল মাত্র ৪০০ মেগাওয়াট। ২০০৯ সালে সাড়ে চার হাজার মেগাওয়াট যা ২০২২ সালে এসে ২৫ হাজার ৭৩০ মেগাওয়াট হয়েছে। তবে সক্ষমতা ব্যাপকভাবে বাড়লেও এতটা উৎপাদন কখনো করা যায়নি, সর্বোচ্চ উৎপাদন হয়েছে ১৪ হাজার ৭৮২ মেগাওয়াট। ফলে প্রায় ১০ হাজার মেগাওয়াট সক্ষমতা অব্যবহৃত রয়ে গেছে। অথচ ক্যাপাসিটি চার্জের ঘানি ঠিকই সরকারকে টানতে হয়েছে। এ ধরনের বাড়তি খরচ কমিয়ে আনা যায় কিভাবে তা দেখতে হবে এবং সর্বোপরি আমদানি নির্ভরতা কমাতে হবে। সম্প্রতি যে বড় ধরনের ব্ল্যাকআউট হলো। বিদ্যুৎ খাতে ব্ল্যাকআউট উন্নত দেশেও হয়, কিন্তু তা সামাল দিতে এতটা সময় কখনো লাগে না। ঘটনার ২৩ দিন পেরিয়ে গেছে পরিস্থিতির উন্নতি হয়নি।
বিদ্যুৎ খাতের সাথে সংশ্লিষ্ট ঠিকাদার প্রতিষ্ঠান, দেখভালের দায়িক্তে থাকা কর্মকর্তাদের বিরুদ্ধে বিস্তর অভিযোগ পত্রিকার শিরোনাম হচ্ছে। এদিকে অজানা কারণে বিদ্যুতের সিস্টেম লস কমানোই যাচ্ছে না। এর মধ্যে গত ৪ অক্টোবর জাতীয় গ্রিডে বিপর্যয় ঘটে গেলে দেশের সার্বিক উন্নয়নের স্বার্থে বিদ্যুৎ খাতের প্রতিটি প্রকল্পের উপর কঠোর নজরদারির মাধ্যমে সুশাসন প্রতিষ্ঠা সময়ের দাবি। সংশ্লিষ্ট কর্তৃপক্ষকে এ ব্যাপারে এখনই সচেতন হতে হবে। একটি টেকসই মজবুত ভিত্তিসম্পন্ন বিদ্যুৎ খাত সুনিশ্চিত করার এই যে ব্যর্থতা, এর দায়ভার কোনোভাবেই এড়াতে পারে না বিদ্যুৎ বিভাগ।
অন্যদিকে ২০৪১ সালের মধ্যে ৬০ হাজার মেগাওয়াট উৎপাদনের লক্ষ্যমাত্রা নেওয়া হয়েছে। দেশে একশটি ইকনোমিক জোন প্রতিষ্ঠার কাজ চলমান, তৈরি পোশাক শিল্প অচিরেই অটোমেশনে যাবে, মাথাপিছু বিদ্যুতের চাহিদা সমানুপাতিক হারে বাড়ছে। মোটকথা, চতুর্থ শিল্পবিপ্লবের চ্যালেঞ্জ মোকাবেলায় বিদ্যুৎ অন্যতম হাতিয়ার। সুতরাং বাংলাদেশকে ২০৪১ সালের মধ্যে উন্নত দেশে উন্নীত করতে নিজস্ব সক্ষমতাভিত্তিক বিদ্যুৎ ব্যবস্থার বিকল্প নেই। এজন্য আমদানিনির্ভরতা কমিয়ে দেশীয় উৎসনির্ভর টেকসই জ্বালানি নীতি গ্রহণ করতে হবে।