শ্রমবাজার স্থিতিশীল হওয়া প্রয়োজন

মো. মাজেদুল হক

বাংলাদেশি শ্রমিক
প্রবাসে বাংলাদেশি শ্রমিক। ফাইল ছবি

এ বছরের সেপ্টেম্বর পর্যন্ত বিভিন্ন দেশে বাংলাদেশি প্রবাসীদের সংখ্যা ১৫ মিলিয়নের কাছাকাছি। বাংলাদেশের শ্রমশক্তির বিশ্বের প্রায় ২০টি দেশে চাহিদা রয়েছে। এর মধ্যে মধ্যপ্রাচ্যের দেশগুলোতে সর্বাধিক জনশক্তি বাংলাদেশ থেকে পাঠানো হয়। বিদেশে কর্মরত মোট জনশক্তির মধ্যে ৩৬ শতাংশ সৌদি আরবে, ১৭ শতাংশ আরব আমিরাতে অবস্থান করছে। দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়ার দেশগুলোতেও কিছুসংখ্যক শ্রমশক্তি বাংলাদেশ থেকে পাঠানো হয়। এ সংখ্যা এত বেশি নয়। মালয়েশিয়া হলো দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়ার একটি দেশ, যেখানে বাংলাদেশ থেকে পাঠানো মোট শ্রমশক্তির ৭ শতাংশ কর্মরত আছে। মালয়েশিয়া সরকার বিভিন্ন সময়ে অভিবাসন নীতি পরিবর্তন করে প্রবাসী বাংলাদেশিদের দেশে ফেরত পাঠিয়ে দিয়েছে। একসময় ‘লেবার রিকলিব্রেশন’ প্রোগ্রাম চালু করে প্রায় ২৬ হাজার বাংলাদেশি শ্রমিকদের দেশে পাঠানোর ব্যবস্থা করেছিলেন।

বলা প্রয়োজন যে, যাদের কোনো বৈধ কাগজপত্র ছিল না তাদের এ প্রোগ্রামের আওতায় আনা হয়েছিল। পরবর্তী সময়ে মালয়েশিয়া সরকার ‘ব্যাক ফর গুড’ প্রোগ্রাম চালু করে প্রায় ৪০ হাজার শ্রমিকের দেশে পাঠানোর জন্য উদ্যোগ নিয়েছিল। ২০১৬ সালে বাংলাদেশ এবং মালয়েশিয়া সরকারের মধ্যে একটি চুক্তি স্বাক্ষরিত হয়। এ চুক্তির আওতায় বাংলাদেশ থেকে শ্রমশক্তি নেওয়ার কথা থাকলেও বাস্তবে তা দেখা যায়নি। ২০১৮ সাল থেকে মালয়েশিয়া বাংলাদেশি শ্রমিকদের জন্য ভিসা বন্ধ করে দিল। পরে ২০২১ সালের শেষের দিকে দুই দেশের মধ্যে আরো একটা চুক্ত স্বাক্ষরিত হয়। এ চুক্তির মাধ্যমে মালয়েশিয়া সরকার ৫ লাখ লোক বাংলাদেশ থেকে নেবে। এখন দীর্ঘ ৪৫ মাস পর আবার মালয়েশিয়া সরকার বাংলাদেশিদের জন্য দরজা খুলে দিল। কিছু দিন আগ থেকে কিছু লোক যাচ্ছেন।

বাংলাদেশ সরকারের সঙ্গে মালয়েশিয়া যেটা করেছিল, আমার কাছে মনে হচ্ছে একটি ব্যবধান তৈরি হয়ে গিয়েছিল। সেই ব্যবধান সৃষ্টি হওয়ার কারণে মালয়েশিয়া ‘ব্যাক ফর গুড পলিসি’ চালু করেছিল। এই পলিসি চালুতে কিছু লোক মালয়েশিয়া থেকে ফেরত এসেছে। সেটা করোনা ভাইরাসের সময় তারা বেশি করে এ সুযোগ নিয়েছে। ব্যাক ফর গুড প্রোগ্রামের আওতায় মালয়েশিয়া থেকে বাংলাদেশের অনেক শ্রমিক চলে আসে। তখন বাংলাদেশের অর্থনীতির ওপর একটা চাপ বেড়ে যায়। আমি বলব, মালয়েশিয়ার যে ‘ব্যাক ফর গুড প্রোগ্রাম’ সে প্রোগ্রামটা বাতিল করে দেওয়া উচিত। এটা এখনো চালু আছে। এটা যতক্ষণ পর্যন্ত বাতিল না হবে, ততক্ষণ পর্যন্ত শ্রমিক ফেরত পাঠানোর সুযোগ থেকে যাবে। মালয়েশিয়াতে শ্রমিক পাঠানোর ক্ষেত্রে যে সিন্ডিকেটের কথা বলা হচ্ছে, মালয়েশিয়াতে সিন্ডিকশন যে এত শক্ত, সেটা সরকারও তাদের কাছে নতি স্বীকার করছে। সমস্যাগুলো আজও সমাধান হয়নি। তাদের যারা মিডল ম্যান’ হিসেবে কাজ করছে ওটা তো ভাঙতে পারেনি। সুতরাং মালয়েশিয়া লোক পাঠানোর যে চুক্তি ছিল, সেটা তো এজেন্সির সঙ্গে চুক্তি ছিল না। সেটা তো সরকারের সঙ্গে চুক্তি ছিল। জিটুজি পদ্ধতিটির ওপর নিষেধাজ্ঞা আরোপ করে কর্মী নেওয়া বন্ধ করার পেছনে শক্তিশালী যুক্তি ছিল না। পরে বাংলাদেশের ১০টি রিক্রুটিং এজেন্সিকে অনুমোদন দিয়ে ‘জিটুজি প্লাস’-এর মাধ্যমে শ্রমিক পাঠানোর উদ্যোগ নেওয়া হয়। অন্যদিকে বাংলাদেশের দেড় হাজারের বেশি রিক্রুটিং এজেন্সিকে তখন বাইরে রাখা হয়। এতে সিন্ডিকেট ও অনিয়মের অভিযোগে পুরো প্রক্রিয়াই শেষ পর্যন্ত বন্ধ করে দেওয়া হয়। এখন যে শ্রমিক যাচ্ছে নতুন চুক্তি হয়নি। সেই চুক্তিতে আবার নতুন করে লোক পাঠানো শুরু হয়েছে। ঐ চুক্তিটি যেন বাস্তবায়ন করে সেটা দেখতে হবে। আমাদের সমস্যাটা কোন জায়গায়? সুদানে যখন লেবারের ডিমান্ড বাড়ল তখন ইন্ডিয়া সঙ্গে সঙ্গে লোক পাঠিয়েছে। বাংলাদেশ সরকার তিন বছর পরে সুদানে লোক পাঠানোর জন্য পদক্ষেপ নিয়েছে, যেটা ইন্ডিয়া তিন বছর আগে পাঠিয়েছে। আমাদের মার্কেট অ্যাসেসমেন্ট করার ক্ষেত্রেও ঘাটতি আছে।

সম্প্রতি মালয়েশিয়ার কর্তৃপক্ষ বাংলাদেশ থেকে ১০ হাজার কর্মী নেওয়ার একটি নতুন প্রক্রিয়া শুরুর কথা জানিয়েছে। এটি হবে সরকারের সহযোগিতায় (জিটুজি) বাংলাদেশ থেকে কর্মী নিয়োগের একটি প্রকল্প। বাংলাদেশ থেকে নির্ধারিত ২৫টি এজেন্সির মাধ্যমে কাঙ্ক্ষিত কর্মী পাঠাতে না পারায় দেশটি নতুন এই প্রকল্পের নামে বাংলাদেশ থেকে কর্মী নিতে চাইছে। বোয়েসলের মাধ্যমে স্বল্প অভিবাসন ব্যয়ে এইসংখ্যক কর্মী যাওয়ার কথা বলা হচ্ছে। ফলে দেখা যাচ্ছে, মালয়েশিয়ায় কাঙ্ক্ষিত জনশক্তি রপ্তানি করতে হলে ঘুরেফিরে জিটুজি চুক্তিটিই বাস্তবায়ন করতে হবে। না হয়, সিন্ডিকেট ও অনিয়মের কারণে কাঙ্ক্ষিত শ্রমিক পাঠানো সম্ভব হবে না।

কারণ ইউরোপীয় ইউনিয়নের দেশগুলো থেকে যে শুল্ক সুবিধা পাচ্ছি, সেটা তো অন্য দেশ থেকে পাওয়া সম্ভব নয়। সুতরাং সেটাতো গভর্মেন্ট থেকে গভর্মেন্ট চিন্তা করতে হবে। সুতরাং আমার কথা হচ্ছে যে, আমাদের নির্ভর করতে হচ্ছে ফরেন রেমিট্যান্সের ওপর। এটা দিয়ে রাতারাতি ফরেন রিজার্ভকে বড় স্কেল করা সম্ভব।

প্রাসঙ্গিক, সৌদি আরব বিভিন্ন সময়ে বাংলাদেশি প্রবাসীদের ওপর বিভিন্ন ধরনের ফি বাড়িয়ে দিচ্ছে। এতে করে অনেক শ্রমিক দেশে ফিরে আসছেন। এছাড়াও, মধ্যপ্রাচ্যেও অনেক দেশের নিয়োগকারী প্রতিষ্ঠানের কাছে অনেক বকেয়া আছে, যা তারা দিচ্ছে না। নারী শ্রমিকদের কর্মপরিবেশ এখনো নিশ্চিত করা যায়নি। মালয়েশিয়ায় নারী শ্রমিকের সংখ্যা বাড়াতে হবে। নারী শ্রমিক সবচেয়ে বেশি যাচ্ছেন মধ্যপ্রাচ্যের দেশগুলোতে।

শুধু শ্রমিক পাঠালে হবে না। দক্ষ শ্রমিক পাঠাতে না পারলে কাঙ্ক্ষিত সাফল্য আসবে না। বিদেশে বর্তমানের শ্রমবাজারগুলোতে স্থিতিশীল পরিবেশ তৈরি করতে ব্যর্থ হলে ফরেন রিজার্ভ দ্রুত কমতে থাকবে। এর পাশাপাশি শ্রমিক পাঠানোর জন্য নতুন নতুন বাজার খুঁজে বের করতে হবে। সিন্ডিকেট বন্ধ করতে না পারলে বিদেশে জনশক্তি সরবরাহ থমকে যাবে, যা অর্থনীতির জন্য হুমকি হয়ে দাঁড়াবে

লেখক : অর্থনীতি বিশ্লেষক

শেয়ার করুন