নদীকে হাইকোর্টের রায়ে বলা হয়েছে—‘জীবন্ত সত্তা’। কিন্তু এই নদীকে ধীরে ধীরে হত্যা করছি আমরা! নদীর জায়গা দখল, দূষণ, বাঁধ আর জলবায়ু পরিবর্তনজনিত দুর্যোগ আমাদের এই জলপথকে এক গভীর সংকটের মুখে ঠেলে দিয়েছে। নদীকে বাঁচাতে হলে জাতীয় স্বার্থকে সব ধরনের ব্যক্তি ও গোষ্ঠীস্বার্থের ঊর্ধ্বে রেখে কঠোর পদক্ষেপ প্রয়োজন। নইলে বাঁচবে না জীবন, জীবিকা ও জীববৈচিত্র্য।
দখল ও দূষণের কারণে বিগত ৪ দশকে দেশের ৪০৫টি নদনদীর মধ্যে প্রায় বিলুপ্ত হয়েছে ১৭৫টি। বাকি ২৩০টিও রয়েছে ঝুঁকির মুখে। ২৪ হাজার কিলোমিটার নৌপথ কমে গিয়ে হয়েছে প্রায় ৬ হাজার কিলোমিটার, শুষ্ক মৌসুমে যা ৪ হাজার কিলোমিটারে এসে দাঁড়ায়। এই চিত্র বদ্বীপটির কৃষি, যোগাযোগ, পরিবেশ, জীববৈচিত্র্য, মানুষের জীবনযাত্রা সবকিছুর জন্যই ভয়াবহ হুমকিস্বরূপ। দেশের ৫৩ জেলার নদী ও খালের বিভিন্ন অংশ দখল করেছে ১০ হাজারেরও বেশি ব্যক্তি ও প্রতিষ্ঠান। তবে দখলদারদের সংখ্যা আরো অনেক বেশি। নদীর ধারে গড়ে উঠেছে বড় বড় কলকারখানা, শত শত বাঁধ। দেশের প্রভাবশালী প্রতিষ্ঠানগুলোর দখলে নদীর জমি। এর মধ্যে সরকারি প্রতিষ্ঠানের নামও আছে। অবৈধভাবে দখলের কারণে নাব্যতাসংকট দেখা দিচ্ছে, পানিপ্রবাহের গতিপথ পরিবর্তন হয়ে যাচ্ছে; নদনদী সংকীর্ণ হয়ে পড়ছে, মরে যাচ্ছে। এতে বর্ষাকালে পানির স্বাভাবিক প্রবাহ ব্যাহত হওয়ার পাশাপাশি অনেক স্থানে বৃষ্টির পানি জমে ফসল ও বাড়িঘর তলিয়ে যায়।
নদী-খাল ছাড়া মানবসভ্যতা বাঁচে না। নদীকে বাঁচাতে হলে আইন সংশোধন করে জাতীয় নদী রক্ষা কমিশনকে শক্তিশালী করা ও নদী আদালত গঠন অতীব জরুরি। একসময় ঢাকায় ৫২টি প্রাকৃতিক খাল ছিল। সড়ক সম্প্রসারণের নামে ইচ্ছামতো বাঁধ দিয়ে খালের ওপর সড়ক নির্মাণ করা হয়েছে। বর্তমানে সেগুলো বিলীন হওয়ার পথে। খাল, জলাশয়গুলো আগের অবস্থায় ফিরিয়ে আনতে হবে। হাউজিং কোম্পানির দখল থেকে জলাশয় দখলমুক্ত জরুরি। বলতে হয়, নদীর অপমৃত্যুতে দখল প্রক্রিয়ার চেয়ে দূষণ তাণ্ডব কম দায়ী নয়। রাজধানীর চারপাশে চারটি নদী দূষণে মেরে ফেলার জন্য ঢাকা ওয়াসা এবং দুই সিটি করপোরেশনও কমবেশি দায়ী। অভিযোগ রয়েছে, পরিশোধন যন্ত্র থাকলেও কোনো কোনো কারখানায় বর্জ্য পরিশোধন না করে সরাসরি তা নদী-জলাশয়ে ফেলে দেওয়া হয়।
নদী রক্ষা কমিশন প্রতিষ্ঠা এবং কমিশনের সক্রিয় ভূমিকা কিছুটা আশার আলো দেখালেও দুর্ভাগ্যজনক বাস্তবতা হচ্ছে, এই কমিশনকে শক্তিশালী ও কার্যকর তদারকি সংস্থা হিসেবে মেনে নেওয়ার সংস্কৃতি এখনো তৈরি করা যায়নি। বরং পদেপদে বৈরীতার মুখোমুখি হতে হচ্ছে জাতীয় নদী রক্ষা কমিশনকে। বাংলাদেশে নদী দখল ও দূষণকারীদের দৃষ্টান্তমূলক শাস্তি দেওয়া অপরিহার্য হয়ে পড়েছে। এজন্যও নদী আদালত গঠন আবশ্যক। নদী দখলদার ও তাদের পৃষ্ঠপোষকদের বিরুদ্ধে যথাযথ পদক্ষেপ নিতে দেরি করা হলে লোকদেখানো যত অভিযানই পরিচালনা করা হোক না কেন, তাতে কাঙ্ক্ষিত সুফল কখনোই সম্ভব নয়।
লেখক : সাংবাদিক ও গবেষক। প্রেসিডেন্ট, হিউম্যানিস্ট সোসাইটি