জ্বালানি নয়, বাংলাদেশের মূল সমস্যা অর্থনীতিতে: অধ্যাপক ম. তামিম

বাংলাদেশ প্রকৌশল বিশ্ববিদ্যালয়ের (বুয়েট) প্রকৌশল অনুষদের ডিন, পেট্রোলিয়াম প্রকৌশল বিভাগের অধ্যাপক এবং সাবেক তত্ত্বাবধায়ক সরকারের প্রধান উপদেষ্টার জ্বালানিবিষয়ক বিশেষ সহকারী ম. তামিম। মত ও পথের জন্য তাঁর সাক্ষাৎকার নিয়েছেন ইয়াসির আরাফাত

দেশের বিদ্যুৎ ও জ্বালানি খাত এখন গভীর সংকটে পড়েছে। এ সংকটের মূল কারণ কী?

universel cardiac hospital

অধ্যাপক ম. তামিম: বিভিন্ন কারণ আছে। সবচেয়ে বড় কারণ হলো আমদানি নির্ভরশীলতা। যখনই আমরা জ্বালানির জন্য আমদানি নির্ভর হয়ে যাব তখনই মূল্য ও সরবরাহের যে ঝুঁকি আছে, দেশ সে ঝুঁকির মধ্যে পড়বে। আমরা দুর্ভাগ্যজনকভাবে আজকে পড়ে গেছি, কিন্তু এই ঝুঁকিতে পড়ার সম্ভাবনা সবসময় ছিল। আমাদের আমদানি নির্ভরশীলতার কারণেই বর্তমান ঝুঁঁকির মধ্যে আমরা পড়েছি। এমন না যে, আমরা আমদানি থেকে সম্পূর্ণ সরে আসতে পারব। কিন্তু যতটুকু স্বনির্ভর থাকা যায় একটা দেশের জ্বালানি নিরাপত্তার জন্য ততো ভালো। আমাদের অর্থনীতি যদি এমন জায়গায় পৌঁছে যায় যে, যতো বেশি মূল্য হোক না কেন আমরা আমদানি করতে পারব, তখন এটা বড় কোনো সমস্যা না। কিন্তু আমরা অর্থনৈতিকভাবে উঠছিলাম এমতাবস্থায় জ্বালানি খাতে আমদানি নির্ভরশীলতা, করোনাপরবর্তী অর্থনৈতিক পুনর্গঠন এবং রাশিয়া-ইউক্রেন যুদ্ধ- সবমিলিয়ে আমরা একটা ঝুঁকির মধ্যে পড়ে গেছি।

এ মাসের শুরুতে দেশের প্রায় অর্ধেকটাজুড়ে যে ব্ল্যাকআউট হলো, এর কারণ কী?

ম. তামিম: তদন্ত কমিটি বলেছে, আশুগঞ্জ পাওয়ার প্লান্ট বন্ধ হয়ে গিয়েছিল, যে কারণে হঠাৎ করে গ্রিডে সরবরাহ ঘাটতি দেখা যায়। সেই প্রেক্ষিতে চাহিদা কমানোর প্রয়োজন ছিল, চাহিদা কমানোর নির্দেশনাও এসেছে কিন্তু বিতরণ কোম্পানিগুলো চাহিদা কমায়নি এবং চট্টগ্রামের একটি স্টিল মিল কোম্পানি তাদের চাহিদা বাড়িয়ে দিয়েছিল। সবমিলিয়ে চাহিদা ও সরবরাহের যে ভারসাম্যহীনতা তা থেকেই এই ব্ল্যাকআউট। এই যে যোগাযোগ করা- ন্যাশনাল ডিসপ্যাচ সেন্টার যেটা আছে, যেখানে চাহিদা ও সরবরাহের ভারসাম্য রক্ষা করা হয়, তাদের নির্দেশনা যদি না মানা হয় তাহলে এই ঘটনা আরও ঘটবে। এগুলো মৌখিকভাবে হচ্ছে, অটোমেটিক কোনো ব্যবস্থা নেই। এজন্য আমি মনে করি, আমাদের অটোমেশনের দরকার আছে। আধুনিকায়ন ও প্রশিক্ষণের প্রয়োজন আছে, কারণ সিস্টেম অনেক বেশি কমপ্লেক্স হয়ে যাচ্ছে। একইসাথে আমাদের অনেক আনরিলায়েবল পাওয়ার প্লান্ট আছে যেগুলো যেকোনো সময় বন্ধ হয়ে যেতে পারে। এজন্য সিস্টেম অটোমেশন করা, প্রশিক্ষণের ব্যবস্থা করা এবং যারা অপারেট করে তাদেরকে পূর্ণ স্বাধীনতা দেওয়া জরুরি। এনএলডিসি— যারা চাহিদা ও সরবরাহের ভারসাম্য বজায় রাখে, তারা পাওয়ার গ্রিড কোম্পানি অব বাংলাদেশের (পিজিসিবি) অধীনে কাজ করে। পিজিবিসি আবার পাওয়ার ডেভেলপমেন্ট বোর্ডের (পিডিবি) নির্দেশনায় কাজ করে। অর্থাৎ তাদের কোনো স্বাধীনতা নেই, এই স্বাধীনতা না থাকার কারণে আরও বেশি সমস্যার সৃষ্টি হয়। সিস্টেম অপারেট করে যারা তাদের পূর্ণ স্বাধীনতা দেওয়া দরকার, যাকে বলা হয় আইএসও (ইন্ডিপেন্ডেন্ট সিস্টেম অপারেটর)। সপ্ত-পঞ্চবার্ষিক পরিকল্পনায় আইএসও আধুনিকায়নের কথা নির্দিষ্ট করে বলা হয়েছে, কারণ আমাদের নিউক্লিয়ার পাওয়ার প্লান্ট আসছে। তখন যদি হঠাৎ করে এই ধরনের ঘটনা ঘটে তাহলে নিউক্লিয়ার পাওয়ার প্লান্টের উপর প্রচণ্ড চাপ সৃষ্টি হবে। কারণ হঠাৎ করেই নিউক্লিয়ার পাওয়ার প্লান্ট বন্ধ করে দেওয়া যায় না। পায়রা-রামপাল বিদ্যুৎকেন্দ্র আসছে, একসাথে ৩৬০০ মেগাওয়াট বিদ্যুৎ উৎপাদন হবে, এগুলো যদি ম্যানেজ করতে হয় তাহলে অবশ্যই আমাদেরকে আধুনিকায়নের দিকে যেতে হবে। আমাদের লাইনের দিকেও নজর দিতে হবে, বিভিন্ন দুর্বল লাইন আছে, আমার দশটা ভালো লাইনের সাথে একটা দুর্বল লাইন থাকলে ঐ একটা দুর্বল লাইন থেকেই দুর্ঘটনা ঘটবে। অর্থাৎ আমাদের পুরো সিস্টেমের সঞ্চালন ও বিতরণে মনোযোগ দিতে হবে।

এখন সঞ্চালন ও বিতরণ ব্যবস্থাপনার আধুনিকায়নের কথা বলছেন। ২০১৪ সালে দেশজুড়ে ব্ল্যাকআউট হয়েছিল। ৮ বছর পর ২০২২ সালে এসে আবারও প্রায় অর্ধেক দেশ বিদ্যুৎহীন হয়ে গেল। এতদিন সঞ্চালনে আধুনিকায়ন কেন করা হয়নি বলে মনে করেন?

ম. তামিম: অবশ্যই দরকার ছিল। সমস্যা হচ্ছে, বাংলাদেশে যে সমস্যা বেশি জরুরি সেটা আগে দেখা হয়। এই ঘটনাগুলো তো অনেকদিন পরপর ঘটে, যখন ঘটে তখন হইচই শুরু হয় কিন্তু পরক্ষণেই আবার অন্য কোনো ঘটনা প্রায়োরিটি পায়, ফলে এই সমস্যা জরুরি হিসেবে চিহ্নিত করে সমাধান করা হয়ে ওঠে না। কিন্তু আমি মনে করি, এটা অত্যন্ত জরুরি, এটাকে প্রায়োরিটি দিয়ে কাজ করা উচিত।

এখন জ্বালানি সংকটের পর দেশীয় উৎস থেকে গ্যাস উৎপাদন বাড়ানোর দিকে নজর দেওয়ার কথা বলা হচ্ছে। এক্ষেত্রে সংকট শুরুর আরও আগেই তৎপর হওয়ার সুযোগ ছিল কি?

ম. তামিম: এটা আরেকটা চরম অবহেলার ব্যাপার। আমদানি নির্ভরশীলতার কারণে আমাদের নিজস্ব গ্যাস উৎপাদনে যে উদ্যোগের দরকার ছিল সেখানে পেট্রো বাংলা ও তার কোম্পানিগুলো ব্যর্থ হয়েছে। এখন যে কাজ তারা হাতে নিয়েছে- ২০২৫ সালের মধ্যে ৬০০ ঘনফুট গ্যাস উৎপাদনের লক্ষ্যমাত্রা- এটা তারা চাইলেই আরো ৬-৭ বছর আগেই করতে পারত। কারণ গ্যাসের উৎপাদন বৃদ্ধি পেয়ে আবার যে কমা শুরু করবে তা তাদেও প্রক্ষেপণের মধ্যেই আছে। তাদের প্রক্ষেপণের মধ্যে তারা দেখিয়েছে, ২২-২৩ থেকে শুরু করে ২৫ সাল পর্যন্ত গ্যাসের ঘাটতি বাড়তেই থাকবে। অথচ এই ঘাটতি খুব সহজেই পূরণ করা যেত, যদি নিজস্ব উৎপাদনের উদ্যোগ আগেই নেওয়া হতো, যেটা তারা এখন শুরু করেছে। এখন তারা বলছে, পারবে। আমার প্রশ্ন হলো, এখন যদি পারেন তাহলে পাঁচ বছর আগে এটা পারলেন না কেন? সে যদি শুরু করত তাহলে ৬০০ মিলিয়ন গ্যাস আমার রিজার্ভ থাকত। মাত্র ২০০-৩০০ মিলিয়ন ঘনফুট গ্যাসের জন্য আমাদের যে বর্তমান ঘাটতি, এটা হত না যদি ২৩০০ মিলিয়ন ঘনফুট গ্যাস থেকে ২৬০০ অথবা ২৭০০ করা যেত। বাড়তি ৩০০ মিলিয়ন যদি আমরা রিজার্ভে রাখতে পারতাম তাহলে বর্তমান বিপর্যয়ে অনেকটা স্বস্তি পেতাম।

দেশের বিদ্যুৎ খাতে বেসরকারি প্রতিষ্ঠানগুলো যে কাজ করছে, এ বিষয়টিকে আপনি কিভাবে দেখেন?

ম. তামিম: বেসরকারি কোম্পানির কারণেই আজকে আমাদের বিদ্যুৎ এ পর্যায়ে এসেছে। সরকারের কাছে টাকা ছিল না, লোকবল ছিল না, বিশ্বের যে দাতা সংস্থা আছে তারা বলেছিল এই খাতে তারা অর্থ দেবে না। যদিও ট্রান্সমিশন ডিস্ট্রিবিউশনে তারা এখন টাকা দেবে বলছে। ৯৫ সালে প্রথম প্রাইভেট ইনভেস্টমেন্ট শুরু হয়, বিদ্যুৎ আইনের মাধ্যমে। আমি বলব, একমাত্র প্রাইভেট ইনভেস্টমেন্ট ও পার্টিসিপেশনের কারণেই আজকে আমরা বিদ্যুৎ খাতে এ পর্যায়ে এসেছি। সরকারিভাবে এখানে আসা কঠিন ছিল।

সরকার যে পথে আগাচ্ছে, আন্তর্জাতিক বাজার পরিস্থিতি বিবেচনায় অল্প দিনেই চলমান সংকট কাটবে কিনা বা কতদিন লাগতে পারে বিদ্যুৎ পরিস্থিতি স্বাভাবিক হতে?

ম. তামিম: এখন বিশ্ববাজারের উপর আমাদের সংকট নির্ভর করবে। শীতকাল আসছে, নভেম্বরের মাঝামাঝি থেকেই শীত শুরু হতে পারে। তখন এয়ারকন্ডিশনের যে লোড তা কমবে। আমরা দেখি, কেবল ঢাকা শহরেই ১৮ লাখ টন লোড আছে, সারাদেশে ২৮ লাখ টন। আবার সারাদেশ থেকে ঢাকায় ৩ ডিগ্রি তাপমাত্রা বেশি। শীতকালে এয়ারকন্ডিশনের এই লোড কমে যাবে। গতবার শীতকালে আমরা দেখেছি, সর্বোচ্চ ১০-১১ হাজার মেগাওয়াট চাহিদা থাকে। ১০ হাজার মেগাওয়াট চাহিদা হলে তখন আর লোডশেডিংয়ের প্রয়োজন হবে না; হয়তো দিনের বেলায় কিছু হবে, যদি তারা জ্বালানিতে কিছু সাশ্রয় করতে চায়। জ্বালানি তেলের দাম বেড়েছে, স্পট এলএনজির দাম বেড়েছে, দীর্ঘমেয়াদি এলএনজির দাম আরো বেড়েছে। জ্বালানি নয়, বাংলাদেশের মূল সমস্যাটা হলো অর্থনীতিতে। আজকে যদি আমরা অর্থনৈতিকভাবে মজবুত থাকতাম, তাহলে জ্বালানি আমদানি করা এত কঠিন হত না। আমরা এখন দেখছি ডলারের ঘাটতি, এই ডলারের ঘাটতি জ্বালানি আমদানিকে মারাত্মকভাবে ব্যাহত করছে। সুতরাং অর্থনৈতিক উন্নয়ন অত্যন্ত জরুরি। আবার একই সাথে দেখতে পাচ্ছি, শিল্পে আমরা গ্যাস দিতে পারছি না। যে শিল্প আমাকে বৈদেশিক মুদ্রা অর্জনে সহায়তা করবে সেখানে গ্যাস দিতে পারছি না। তাতে এই চক্রটি আরও জটিল হয়ে গভীর গর্ত তৈরি করছে। আমরা জ্বালানি দিতে পারছি না টাকার অভাবে; টাকা না আসলে জ্বালানি আমদানির সম্ভাবনা আরও কমে যাচ্ছে। সুতরাং অন্যান্য সবকিছুর চেয়ে শিল্পকে অগ্রাধিকার দিয়ে শিল্পে যেন আমরা গ্যাস সরবরাহ করতে পারি সেই ব্যবস্থা আমাদেরকে করতে হবে।

বিদ্যুৎ প্রতিমন্ত্রী জানিয়েছিলেন সেপ্টেম্বর থেকে আর লোডশেডিং হবে না, কিন্তু তা বাস্তবায়ন হয়নি। হয়তো তারা যেমনটা প্রত্যাশা করছেন, তেমনটা ফিল্ডে বাস্তবায়ন করা সম্ভব হচ্ছে না। তারা ভেবেছিলেন রামপাল থেকে ৬০০ মেগাওয়াট বিদ্যুৎ পাবেন, এটা আশা করে সেপ্টেম্বর থেকে লোডশেডিং না হওয়ার কথা বলেছিলেন। কিন্তু যেকোনো কারণেই হোক এটি হয়নি। এখন বলা হচ্ছে ডিসেম্বরে আসবে রামপাল থেকে ৬০০ মেগাওয়াট আর আদানি থেকে ৪০০ মেগাওয়াট। আদানি থেকে ১৬০০ আসার কথা; এই ডিসেম্বরের মধ্যেই ৮০০ আসার কথা কিন্তু এখানেও আমাদের প্রস্তুতিতে ঘাটতি আছে। যে লাইনগুলো করার কথা সেগুলো আমরা করতে পারিনি। আমার প্রশ্ন হচ্ছে, পায়রা থেকে যে দুই বছর আমরা সর্বোচ্চ বিদ্যুৎ নিতে পারিনি তার প্রধান কারণ হচ্ছে পদ্মা নদী পার হয়ে গোপালগঞ্জ দিয়ে যে সঞ্চালন লাইন তৈরি করার কথা তা আমরা করতে পারিনি, পদ্মা নদী পার হওয়া সম্ভব হয়নি। এই যে করতে পারলাম না এই দায়দায়িত্ব কার? পায়রাকে আমরা সাড়ে চার হাজার কোটি টাকা দিয়েছি কিন্তু সর্বোচ্চ বিদ্যুৎ আমরা নিতে পারিনি; এর দায়দায়িত্ব সম্পূর্ণ পিজিসিবির- যাদের উপর সঞ্চালন লাইন তৈরির দায়িত্ব। তারা যত অজুহাতই দেখাক না কেন, কাউকে না কাউকে ধরতে হবে, প্রশ্নের মুখোমুখি করতে হবে যে, আমাদের বিদ্যুৎকেন্দ্র প্রস্তুত কিন্তু বিদ্যুৎ সরবরাহের লাইন কেন যথাসময়ে পাইনি? যদি দুই-চার মাস দেরি হত তাও মেনে নেওয়া যেত, কারণ প্রজেক্ট সবসময় হুবহু তারিখ অনুযায়ী হয় না। ছয় মাস পর্যন্ত সহ্য করা যায়, কিন্তু দুই বছর তো কোনোভাবেই মেনে নেওয়া যায় না। এখন বলা হচ্ছে, আগামী ডিসেম্বরের মধ্যে সব লাইন তৈরি হয়ে যাবে। কিন্তু এই যে এত দেরি হলো এ নিয়ে একজন আরেকজনকে দোষারোপ করলে হবে না। যার দোষ তাকে শাস্তি দিতে হবে, জবাবদিহিতা নিশ্চিত করতে হবে। আমাদের দেশের সবচেয়ে বড় সমস্যা হচ্ছে, প্রজেক্ট সময়মতো শেষ হয় না। প্রজেক্ট শেষ না হওয়ায় মূল্য বৃদ্ধি পায়, সময় বৃদ্ধি পায়। এই দুটোর কারণে আমরা পিছিয়ে যাচ্ছি। রামপাল সবার আগে পরিকল্পিত প্রজেক্ট, মাঝখানে কিছু আন্দোলন হয়েছে কিন্তু আন্দোলনের উপর কোনোভাবেই এত ডিলে হওয়ার দায় চাপানো যাবে না। গত পাঁচ সাত বছর তো রামপাল নিয়ে কোনো কথাই হচ্ছে না, এই পাঁচ সাত বছরে তারা কী করল? যেখানে চাইনিজরা পায়রা বিদ্যুৎকেন্দ্র তিন বছরে শেষ করেছে; ১৩২০ মেগাওয়াটের বিদ্যুৎকেন্দ্র সময়ের আগেই শেষ করেছে, সেখানে ভারতীয়দের এত ডিলে হওয়ার কোনো যৌক্তিক কারণই থাকতে পারে না। নিশ্চয়ই প্রজেক্ট বাস্তবায়নে কোনো সমস্যা আছে।

রাশিয়া-ইউক্রেন যুদ্ধ সহসাই থামবে বলে মনে হয় না। সেক্ষেত্রে জ্বালানি সরবরাহ স্বাভাবিক রাখতে বাংলাদেশ সরকারের করণীয় কী?

ম. তামিম: করণীয় কিছুই নেই। সম্প্রতি দেখলাম ব্রুনাইয়ের সাথে চুক্তি হয়েছে। তাদের কাছ থেকে যদি ডিসকাউন্টে কিছু আনা যায় তাহলে ভালো হবে। বর্তমান বিশ্বে সবাই চাচ্ছে সর্বোচ্চ লাভ করতে। রাশিয়া ডিসকাউন্ট দিতে চেয়েছিল, কিন্তু সেই তেল আমরা ব্যবহার করতে পারব না। রাশিয়ার তেল আনার যে খরচ তাও অনেক বেশি। সবমিলিয়ে আমাদের জন্য তাতে লাভজনক কিছু হবে না।

লোডশেডিংয়ে সারা দেশের মানুষের চরম ভোগান্তি হচ্ছে, এটি কমানোর উপায় কী?

ম. তামিম: ভোগান্তি কমানোর সবচেয়ে বড় উপায় হচ্ছে ব্যবহার কমানো। আমরা সবাই মিলে যত কম ব্যবহার করতে পারব ততো ভালো হয়। এসির যে ব্যবহার, অনেক এসি আছে এত বেশি বিদ্যুৎ টানে, সেক্ষেত্রে ইনভার্টারযুক্ত এসি ব্যবহার করলে বিদ্যুৎ অনেক কম লাগবে। এসি, ফ্রিজসহ যেসব মেশিনজাতীয় জিনিস বেশি বিদ্যুৎ টানে সেগুলোর মধ্যে কোনগুলো কত কম বিদ্যুৎ খরচ করে ব্যবহার করা যায় সেভাবে রেটিং করতে হবে। রেটিং করে সর্বোচ্চ রেটিংয়ের এসি, ফ্রিজ প্রমোট করতে হবে। এভাবে বিদ্যুতের ব্যবহারটা কমে আসবে। আর নিজেদেরকেও সচেতন থাকতে হবে। সবাইকে ২৫ ডিগ্রিতে এসি সেট করতে হবে। সবাই যদি ২৪-২৫ ডিগ্রিতে ব্যবহার করে তাহলে এই শীতকালে ১ থেকে দেড় হাজার মেগাওয়াট বিদ্যুৎ সাশ্রয় হতে পারে। জনগণকে এই সংকট বুঝতে হবে এবং সবাইকে সহযোগিতা করতে হবে। যতই সমালোচনা করা হোক না কেন, সরকার এই করে নাই কেন, সেই করে নাই কেন, কাজ হবে না। আজকে ইউরোপকে জিজ্ঞাসা করা যায়, তোমরা রাশিয়ার গ্যাসের ওপর কেন এত নির্ভরশীল হয়েছিলে? তোমাদেরকে এই সতর্কবার্তা আগেই দেওয়া হয়েছিল। আমেরিকা বহুবছর ধরে ইউরোপকে রাশিয়ার গ্যাস থেকে বের হয়ে আসার কথা বলে আসছে। কিন্তু ইউরোপ শোনেনি, তারা সস্তায় গ্যাস পাচ্ছে, যে কারণে বেশি বেশি রাশান গ্যাস ব্যবহার করেছে। কিন্তু এই বিপদ যে আসতে পারে তা তো তাদের মাথায় ছিল না। এখন ইউরোপীয় নেতাদের জবাবদিহিতা দরকার, তাদের পদত্যাগ করা দরকার, কিন্তু তা হচ্ছে না। তারা চেষ্টা করছে বিপদটা কাটিয়ে উঠতে। আমাদের দেশেও ভুলভ্রান্তি হয়েছে, কোন সন্দেহ নাই, এজন্য সমালোচনা আমরা করব, ভবিষ্যতে যেন এমন ভুল না হয় সে ব্যাপারে আমাদেরকে সোচ্চার থাকতে হবে। কিন্তু একই সাথে আমাদেরও সহযোগিতা করতে হবে।

ভারত থেকে বাংলাদেশ বর্তমানে ১১৬০ মেগাওয়াট বিদ্যুৎ আনছে। আগামী ডিসেম্বরে ভারতের আদানি গ্রুপের কয়লাভিত্তিক বিদ্যুৎকেন্দ্র থেকে আরও দেড় হাজার মেগাওয়াট বিদ্যুৎ আনার কথা রয়েছে। এক্ষেত্রে আমদানির বিষয়টি বাংলাদেশের জন্য বোঝা হয়ে দাঁড়াবে কিনা?


ম. তামিম: না, আমদানির ব্যাপারটি মোটেই বোঝা হয়ে দাঁড়াবে না। প্রথমত, ভারত-বাংলাদেশ সম্পর্ক ভালো। কিন্তু রাশিয়ার গ্যাস আমদানির মতো ঐ ধরনের ভুল করলে চলবে না। একক নির্ভরশীলতা তৈরি হলে তা আমাদের জন্য ঝুঁকিপূর্ণ হবে। যতই আমরা বলি যুদ্ধ হবে না কখনো, সমস্যা হবে না, কিন্তু আমাদের নিরাপত্তার স্বার্থে এই ঝুঁকিপূর্ণ অবস্থায় যাব না। কারণ কোনো দেশই নিজের স্বার্থ ছাড়া অন্যের স্বার্থ দেখবে না। সুতরাং আমার স্বার্থটা আমাকেই দেখতে হবে। আমি মনে করি, ভারত থেকে আমাদের চাহিদার ১৫ বা ২০ ভাগ আনতে পারি, এর বেশি আনাটা আমাদের জন্য ঝুঁকিপূর্ণ হয়ে যাবে।

বিদ্যুৎ খাত বড় ধরনের লোকসানের মুখোমুখি হতে যাচ্ছে। এক্ষেত্রে ফের দাম বাড়ালে মানুষজনের জন্য তা বোঝা দাঁড়াবে।


ম. তামিম: কিছুদিন আগে দাম বাড়ানোর কথা উঠেছে, শুনানি হয়েছে। কিন্তু সরকার তা করতে চায়নি দুটি কারণে, একটি হলো এই মুহূর্তে সরবরাহ ঘাটতি। দিনে চার-পাঁচ ঘণ্টা লোডশেডিং হচ্ছে, এখন বিদ্যুতের দাম বাড়ালে মানুষ ক্ষেপে যাবে, কোনোভাবেই গ্রহণ করবে না। আমি নিয়মিত সরবরাহ করে বলতে পারি যে, এই সরবরাহ চালু রাখতে হলে দাম বাড়াতে হবে। লোডশেডিং করে যদি দাম বাড়াই তাহলে জনগণ বলবে একদিনও লোডশেডিং করা যাবে না। কিন্তু এই মুহূর্তে দাম বাড়িয়েও সার্বক্ষণিক বিদ্যুৎ দেওয়ার ক্ষমতা নেই, যে কারণে দাম বাড়াচ্ছে না। লোডশেডিংয়ের কারণে হয়তো পার ইউনিটে খরচ বেড়ে গেছে, ভর্তুকি দিতে হচ্ছে। কিন্তু সবমিলিয়ে ইউনিট সংখ্যা কমে যাওয়ায় ভর্তুকির পরিমাণ বেশি বাড়েনি। গত বছর যে ভর্তুকি দেওয়া হয়েছে এবারও একই যাবে। দিনে পাঁচ ঘণ্টা করে যদি বিদ্যুৎ উৎপাদন না হয় তাহলে তো সেখানে বড় ধরনের জ্বালানি সাশ্রয় হচ্ছে। উৎপাদন ক্ষমতা যতই বৃদ্ধি পাক, পাঁচ ঘণ্টা করে বন্ধ থাকার কারণে সার্বিক মূল্যটা কম। সরকার হয়তো এটা দেখেছে এবং দেখেই বলেছে যে, এটুকু ভর্তুকি আমি দিতে পারব। বাংলাদেশের মতো উন্নয়নশীল দেশ, যেখানে মানুষের ক্রয়ক্ষমতা সীমিত সেখানে মৌলিক চাহিদার ব্যাপারগুলো যেমন পানি, গ্যাস, এগুলোতে ভর্তুকি দিয়েই চালাতে হয়। অর্থনীতিকে বাঁচিয়ে রাখতে হলে এবং মূল্যস্ফীতি নিয়ন্ত্রণে রাখতে হলে ভর্তুকি দিতে হয়। এই ভর্তুকি এক ধরনের বিনিয়োগ। এ বিনিয়োগের ফলে আমরা মানুষের অর্থনৈতিক সমৃদ্ধি পাচ্ছি। এই সমৃদ্ধি যখন একটা পর্যায়ে পৌঁছাবে তখন আবার ভর্তুকি উঠিয়ে দিতে হবে, কারণ তখন মানুষের ক্রয়ক্ষমতাও বড়বে। যতটুকু দ্রুততম সময়ে আমরা চেয়েছিলাম ততটুকু হচ্ছে না, কিন্তু কম হলেও হচ্ছে। এই মুহূর্তে যদি সবকিছু থেকে ভর্তুকি উঠিয়ে দেওয়া হয়, যেমন তেল থেকে উঠিয়ে দেওয়া হয়েছে, ফলে তেলের দাম এত বেড়ে গেল, এবং সরকারের লাভ হলো কিন্তু মূল্যস্ফীতি নিয়ন্ত্রণের বাহিরে চলে গেছে। একে তো আন্তর্জাতিক বাজারে মূল্যস্ফীতি আছেই, তারউপর এই দেশীয় মূল্যস্ফীতিটা যোগ করা ভুল হয়েছে। আমি মনে করি, তেলের দাম না বাড়িয়ে বিদ্যুতের দাম বাড়ালে বাজারে মূল্যস্ফীতির প্রভাবটা অনেক কম পড়ত। তেলের দামের প্রভাব অনেক বেশি। কারণ এটা নিত্যপ্রয়োজনীয় পণ্যের দামের সাথে যুক্ত। কেবল খাবার না, পরিবহন খরচও বেড়ে যায় তেলের দামের অজুহাতে। আমাদের দেশের বেশিরভাগ ব্যবসায়ী সৎ না, অর্থাৎ এই সুযোগে তারা আগের চেয়ে বেশি পরিমাণে লাভ করছে। বড় বড় কোম্পানির প্রফিট অনেক বেড়ে গেছে।

শেয়ার করুন