দেশের বিদ্যুৎ পরিস্থিতি দ্রুত বদলে গেল। জনগণ আবার ভোগান্তিতে পড়ল। দিনের মধ্যে তিন/চারবার বিদ্যুৎ যাচ্ছে। কোথাও কোথাও তিন/চার ঘণ্টা বা তারও বেশি সময় বিদ্যুৎ থাকছে না। বিদ্যুৎ সমস্যাকে ঘিরে জনউদ্বেগ বাড়ছে। যে মুহূর্তে সরকার শতভাগ বিদ্যুতায়নের সফলতা উদ্যাপন করল তার পরপরই এ সংকট দেখা দিল।
বাঙালি আজ উৎসব ও উদযাপনপ্রবণ জাতিতে পরিণত হয়েছে। উৎসব বা উদ্যাপনের সুখানুভুতি দীর্ঘস্থায়ী করতে হলে জুতসই পরিকল্পনা দরকার। শতভাগ বিদ্যুৎ মানে প্রতিটি ঘরে বিদ্যুৎ এমন খুশির উদযাপন টেকসই করতে আরেকটু স্মার্ট হওয়া দরকার ছিল।
২০৪১ সালের মধ্যে ক্ষুধা ও দারিদ্র্যমুক্ত একটি উন্নত বাংলাদেশ গড়তে সরকার প্রেক্ষিত পরিকল্পনা ২০২১-২০৪১ প্রণয়ন করেছে। সেখানে প্রবৃদ্ধি অর্জনের ওপর বিশেষ জোর দেওয়া হয়েছে। ২০৪১ সাল নাগাদ উন্নত দেশের কাতারে সামিল হতে মাথাপিছু আয় লাগবে ১২ হাজার ৫০০ মার্কিন ডলার যেখানে বর্তমান মাথাপিছু আয় ২ হাজার ৮২৪ ডলার।
তাহলে বিষয়টি কী দাঁড়ালো- খুব সহজ, উৎপাদন বাড়াতে হবে। এ উৎপাদন বাড়াতে হলে লাগবে বিদ্যুৎ ও জ্বালানি। উৎপাদন বাড়াতে হবে খেতে-খামারে এবং কলে-কারখানায়। খেত-খামার আজ যান্ত্রীকীকরণ হয়েছে। লাঙ্গল জোয়াল ফেলে কৃষক মেশিন নির্ভর চাষাবাদে ঝুঁকেছেন। বাংলার নরম মাটির বুকে অনবরত ছুটছে ট্রাক্টর, হারভেস্টর আরও কতো চমকপ্রদ যন্ত্রপাতি। চাষাবাদে এ যান্ত্রীকীকরণের অনেকগুলো ইতিবাচক দিক আছে। এ আধুনিকায়ন চাষাবাদকে সহজ করেছে।
বাস্তবতা হলো এসব যন্ত্রপাতি সবই জ্বালানিনির্ভর। বেশিরভাগ ক্ষেত্রে ডিজেলে চলে। সুতরাং কৃষককে পয়সা খরচ করে ডিজেল কিনতে হচ্ছে। বৈশ্বিক সংকট ও জাতীয় ব্যবস্থাপনার দুর্বলতার কারণে ডিজেলের দাম বাড়ছে হু হু করে। জ্বালানি ব্যবহারের আরেক বড় ক্ষেত্র হলো পরিবহন সেক্টর, কলকারখানা। দেশে যে কেবল বাস, ট্রাকের সংখ্যা অস্বাভাবিকভাবে বেড়েছে তা নয় বেড়েছে ব্যক্তিগত গাড়ি ব্যবহারের সক্ষমতা। বেড়েছে কলকারখানা। এখন এমন কোনো গ্রাম পাওয়া যাবে না যেখানে পাঁচটি বা দশটি বাইক নেই। যুগপৎভাবে প্রাইভেটকার, মাইক্রোবাস, জিপসহ নানা ধরনের যানবাহনের মালিকানা ও ব্যবহার বেড়েছে। মোদ্দা কথা হলো, বিদ্যুৎ ও জ্বালানির চাহিদা বেড়েছে বহুগুণে।
সরকারের পাওয়ার সেলের ১১ অক্টোবর ২০২২-এর তথ্য অনুসারে বাংলাদেশের বিদ্যুৎ উৎপাদন সক্ষমতা ২৫ হাজার ৭৩০ মেগাওয়াট যেখানে বর্তমানে উৎপাদন অনেক কম। গত এপ্রিলে সর্বোচ্চ ১৪ হাজার ৭৮২ মেগাওয়াট উৎপাদন হয়েছে। বিদ্যুতের সুবিধাভোগী জনগোষ্ঠী শতভাগ। একই সাইটে উল্লেখ করা হয়েছে- জুন ২০২২-এর তথ্য অনুসারে বিদ্যুতের বিতরণ লস শতকরা ৭.৭৪ ভাগ। কিন্তু বাস্তবতা হলো সমৃদ্ধ বাংলাদেশের রূপকল্প সামনে রেখে সরকার ২০৪১ সাল নাগাদ ৬০ হাজার মেগাওয়াট বিদ্যুৎ উৎপাদনের পরিকল্পনা হাতে নিয়েছে (২২ অক্টোবর ২০২২, দৈনিক বণিকবার্তা)। কারণ এ লক্ষ্য পৌঁছাতে হলে যে পরিমাণ বিদ্যুৎ দরকার তার কাঠামোগত বিন্যাস, কারিগরি সক্ষমতা ও পরিচালন ব্যবস্থার মান নিয়ে কৌশলগতভাবে এখন থেকে ভাবতে না পারলে সে পথে পৌঁছা সহজ হবে না। এজন্য পরনির্ভরশীলতা কাটিয়ে আধুনিক প্রযুক্তিনির্ভর, পরিবেশবান্ধব বিদ্যুৎ ব্যবস্থা গড়ে তোলা হবে রুচিশীল সিদ্ধান্ত।
বিদ্যুৎ জ্বালানির ব্যবহার বৃদ্ধির পেছনে কাজ করছে অর্থনৈতিক অগ্রগতি। আয় বাড়লে ভোগ বাড়বে এটাই স্বাভাবিক। কিন্তু সেই ভোগটা নিয়ন্ত্রণও খুব জরুরি বিষয়। জাতিসংঘ পরিস্থিতি বুঝে পরিমিত ভোগ ও টেকসই উৎপাদন নিশ্চিত করার ওপর জোর দিয়েছে। এসডিজির ১২ নম্বর অভীষ্টের লক্ষ্যমাত্রার ১২.২ উল্লেখ করা হয়েছে-২০৩০ সালের মধ্যে প্রাকৃতিক সম্পদের দক্ষ ব্যবহার ও টেকসই ব্যবস্থাপনা নিশ্চিত করতে হবে। একই সঙ্গে পরিবেশবান্ধব উন্নয়ন ব্যবস্থাপনা ও প্রকৃতির সঙ্গে সংগতিপূর্ণ জীবনরীতি অনুসরণের কথা বলা হয়েছে।
দুনিয়াজুড়ে যে ভোগবাদী সমাজ গড়ে উঠেছে তাকে সচল রাখতে যেনতেন উপায়ে বিদ্যুৎ উৎপাদন ও জ্বালানি সংগ্রহে রাষ্ট্রগুলো উঠেপড়ে লেগেছে। পৃথিবী তার বুকের ভেতর হাজার হাজার বছর ধরে যে ফসিল ফুয়েল জমা করেছিল রক্তচোষার দল তা চুষে বের করে আনছে। পৃথিবীর সক্ষমতার সীমাবদ্ধতা রয়েছে। কেবল ফসিল ফুয়েল নয় সার্বিক বিচারে পৃথিবীর প্রতি মানুষ যে নির্মম আচরণ করছে তা কোনোভাবেই গ্রহণযোগ্য নয়। পৃথিবী কোনো কারণে বাসহীন হয়ে পড়লে সমগ্র মানবজাতির জন্য বিপর্যয় নেমে আসবে। সারা পৃথিবীর মানুষ পৃথিবীর পরিবর্তন পর্যবেক্ষণ করছে। যেমন- সমকালীন বাস্তবায়তায় উন্নয়নশীল দেশগুলোর পাশাপাশি ইউরোপ, অস্ট্রেলিয়া জলবায়ু পরিবর্তনজনিত এক ভয়াবহ পরিস্থিতির শিকার। আন্তর্জাতিক গণমাধ্যমে প্রকাশিত প্রতিবেদন থেকে দেখা যাচ্ছে- তাপমাত্রা বেড়ে যাওয়ায় ইউরোপের অনেক দেশে বন আগুনে পুড়ে গেছে। নদ-নদী শুকিয়ে যাচ্ছে- রাইনের মতো নদী শুকিয়ে গেছে। তীব্র জ্বালানি সংকটের মুখে আজ গোটা ইউরোপ।
বিদ্যুৎ আর জ্বালানি হয়ে উঠেছে বিশ্ব রাজনীতি নিয়ন্ত্রণের মহা অস্ত্র। জ্বালানিকে ঘিরে দুনিয়াজুড়ে নতুন রাজনৈতিক মেরুকরণ শুরু হয়েছে। জ্বালানির সংকটে ফেলে মানুষকে নিঃশেষ করা পর্যন্ত হুমকি দেওয়া হচ্ছে। রাশিয়া ও ইউক্রেন সংকট তাতে ঘি ঢালছে। রাশিয়া ইউরোপে তার গ্যাস সরবরাহ লাইন বন্ধ করে দিয়েছে। আসন্ন শীতে গোটা ইউরোপের পরিস্থিতি কী দাঁড়াবে তা নিয়ে বিশ্ববাসী উদ্বিগ্ন! জার্মানি তার কয়লা খনিগুলো পুনরায় খুড়তে শুরু করেছে। অনেকে পারমাণবিক পাওয়ার প্লান্টগুলো আবার চালু করার কথা ভাবছে।
রাজনীতি ও জ্বালানি আজ একে অপরের পরিপূরক। রাজনীতির অংশ হিসেবে আমেরিকা সম্প্রতি এক কোটি পঞ্চাশ লক্ষ ব্যারেল মজুদ তেল বাজারে ছাড়ার সিদ্ধান্ত নিয়েছে। ইউক্রেন-রাশিয়া সংকটের কারণে বৈশ্বিক তেলের বাজার অস্থিতিশীল হয়ে পড়ায় আমেরিকা মজুদ ভান্ডার থেকে বাজারে তেল ছাড়ার সিদ্ধান্ত নিয়েছে। রাশিয়া যে ইউরোপে গ্যাসের লাইন বন্ধ করে দিয়েছে সেটিও যেমন রাজনীতি আমেরিকা যে তেলের মজুদ বাজারে ছাড়ছে তাও রাজনীতি।
বৈশ্বিক রাজনীতির সমীকরণ, বাংলাদেশের তেলের যে চাহিদা এবং দেনদনবারের সক্ষমতা, তা নিয়ে বাংলাদেশ যে সংকট পড়বে তাতে তো কোনো সন্দেহ থাকার কথা নয়। কারণ কেউ নিজের স্বার্থ বির্সজন দিয়ে এমন পরিস্থিতিতে অন্যকে বাঁচাতে আসবে না। সুতরাং, চলমান জ্বালানি সংকট মোকাবেলায় একটু সংরক্ষণবাদী মনোভঙ্গি নিয়ে এগুতে চাচ্ছে বাংলাদেশ- যেটি সম্প্রতি বিদ্যুৎ, জ্বালানি ও খনিজ সম্পদ প্রতিমন্ত্রী নসরুল হামিদ জার্মানভিত্তিক রেডিও ডয়েচে ভেলের সঙ্গে সাক্ষাৎকারে উল্লেখ করেছেন। তিনি উল্লেখ করেন, বিশ্ববাজারে হু হু করে তেলের মূল্য বৃদ্ধি পাচ্ছে। এ পরিস্থিতিতে বিশ্ববাজার থেকে উচ্চমূল্যে তেল কেনার চেয়ে সরকার লোডশেডিংয়ের মাধ্যমে পরিস্থিতি ম্যানেজ করার চেষ্টা করছে।
বড় বড় প্লান্ট, কুইক রেন্টাল, গ্যাস ক্ষেত্র অনুসন্ধান, বিদেশি কোম্পানির সঙ্গে উৎপাদিত গ্যাসের শেয়ার, দুর্বল জ্বালানি নীতি, অস্বচ্ছতা ও পক্ষপাত বাংলাদেশের বিদ্যুৎ ও জ্বালানি খাত বিষয়ক আলোচনার সব চাবি শব্দ। বিদ্যুৎ ও জ্বালানি নিয়ে দেশের ক্রিটিক্যাল ক্লাসের অবস্থান ও বক্তব্য বিশেষভাবে প্রণিধানযোগ্য বিষয়। আমাদের আসলেই দরকার জনবান্ধব বিদ্যুৎ ও জ্বালানি নীতি। ভবিষ্যতের কথা বিবেচনা করে গ্যাস মজুদ ও সংগ্রহ নিজেদের সক্ষমতায় গ্যাসের উত্তোলনকে অগ্রাধিকার এবং কারিগরি ও আর্থিক সক্ষমতা বাড়াতে হবে।
এক হিসাব দেখা যাচ্ছে- ২০৩০ সাল নাগাদ বাংলাদেশকে ৯০ শতাংশ জ্বালানি আমদানি করতে হবে (২২ অক্টোবর ২০২২; দৈনিক বণিকবার্তা)। আর এ জন্য বাংলাদেশকে মোটা অংকের অর্থের যোগান দিতে হবে। উন্নয়নের মূল পাওয়ারবেইজ জ্বালানি তা যদি পুরোটা বিদেশনির্ভর হয় তাহলে তা টেকসই করা সম্ভব নয়।
আগে বলা হয়েছে জ্বালানি আজ রাজনীতির নিয়ামক। বৈশ্বিক রাজনীতির ব্যাকরণ সবসময় এক নিয়মে চলে না। সুতরাং উন্নয়ন পাটাতন শক্ত করতে হলে বিকল্প উৎস থেকে জ্বালানি সংগ্রহ করতে হবে বিশেষত নবায়নযোগ্য জ্বালানি নিয়ে ভাবতে হবে। এজন্য গবেষণা ও উদ্ভাবনায় প্রণোদনা দিতে হবে।
পাশাপাশি উন্নয়ন নিয়ন্ত্রণ করতে হবে। বিদ্যমান সম্পদের যথেচ্ছার ব্যবহার দিয়ে উন্নয়নের রঙিন ছবি আঁকা যায় না। মানুষের অসীম চাহিদা সীমিত সম্পদ দিয়ে ম্যানেজ করাই অর্থনীতির মূল কথা। প্রখ্যাত ইতিহাসবিদ দীপেশ চক্রবর্তী ‘জলবায়ু পরিবর্তন ও বর্তমান অতিমারি, মানুষের ইতিহাসে একটি সন্ধিক্ষণ’ শীর্ষক বক্তৃতায় উল্লেখ করেছেন- উন্নয়ন একটি জরুরি বিষয়। উন্নয়ন হলে তার বণ্টন নিয়ে ভাবতে হবে। সমস্যাটা বণ্টনে, মানুষের সমস্যাটা ন্যায়ের সমস্যা, গণতন্ত্রের সমস্যা। বিদ্যুৎ ও জ্বালানি ক্ষেত্রে কথাগুলো সমভাবে প্রযোজ্য।
বিদ্যুৎ ও জ্বালানি সমস্যার টেকসই সমাধানে স্বদেশজাত দৃষ্টিভঙ্গি একটি উন্নত বিকল্প বলে মনে করি।
খান মো. রবিউল আলম: যোগাযোগ বিশেষজ্ঞ ও লেখক।