ইলন মাস্কের টুইটার অধিগ্রহণের পর বেশ কিছু প্রশ্ন উঠছে। প্রথমটি নীতির প্রশ্ন: বিশ্বের সবচেয়ে ধনী ব্যক্তির জন্য জনসাধারণের বিতর্কের এত গুরুত্বপূর্ণ প্ল্যাটফর্মের মালিক হওয়া কি ঠিক? এরপর আইনগত প্রশ্ন: অধিগ্রহণের কয়েক দিনের মধ্যে এত কর্মীকে ছাঁটাইয়ের বিষয়ে তার সিদ্ধান্ত কি বোর্ডেরও ওপরে? পরের প্রশ্ন কৌশল নিয়ে: টুইটার কি বিজ্ঞাপন-নির্ভর ব্যবসায়িক মডেল থেকে সরে সাবস্ক্রিপশন-নির্ভর মডেলে গিয়ে অর্থ উপার্জন করতে পারবে?
কাজ, সিদ্ধান্ত গ্রহণ এবং সিইও’র ভূমিকা সম্পর্কে ইলন মাস্ক যেভাবে চিন্তা করেন, স্পষ্টতই তিনি স্রোতের বিপরীতে চলছেন। কর্মীদের প্রতি মনোভাব তার প্রথাবিরোধী পদ্ধতির একটি সুস্পষ্ট উদাহরণ। একজন ভবিষ্যতবাদী হিসেবে মাস্ক বেশ পুরোনো ধাঁচের (ওল্ড ফ্যাশনড) বস। তিনি দূরে থেকে কাজ (ওয়ার্ক ফ্রম হোম) পছন্দ করেন না।
চলতি বছরের শুরুতে গাড়িনির্মাতা প্রতিষ্ঠান টেসলার কর্মীদের কাছে একটি ইমেইল পাঠিয়েছিলেন মাস্ক, যেন তারা সপ্তাহে কমপক্ষে ৪০ ঘণ্টা সশরীরে অফিস করেন। কেউ এটিকে পুরোনো ধাঁচ মনে করলে ‘অন্য কোথাও কাজের ভান করতে পারেন’, তিনি টুইট করেছিলেন।
একসঙ্গে এত টুইটার কর্মীকে চাকরিচ্যুত করার সিদ্ধান্তের বৈধতা যা-ই হোক না কেন, তার পদ্ধতি কিন্তু নৃশংস। চাকরিচ্যুত কর্মীদের করপোরেট অ্যাকাউন্টগুলো হুট করে বন্ধ করে দেওয়া হয়েছে, ছোট্ট একটা ইমেইলের মাধ্যমে ক্যারিয়ার শেষ হয়েছে তাদের, এক ঝলকে টুইটারের অর্ধেক কর্মী নাই হয়ে গেছে। যেন থানোসের (মারভেল কমিকসের ভিলেন) হাত পড়েছে এই ব্যবসায়।
এরপর যারা রয়ে গেছেন, তাদের জন্যেও সামনের দিনগুলো কঠিন হতে চলেছে। সংশ্লিষ্টরা বলছেন, টুইটার অফিসে ইলন মাস্কের প্রথম কাজগুলোর মধ্যে একটি ছিল মাসিক ‘বিশ্রামের দিন’ বাতিল করা।
তবে মাস্কের সমালোচকদের মেনে নিতে হবে, তার ‘আমার পথ, নাহয় অন্য পথ’ পদ্ধতি আগে কাজ করেছে। টেসলা ও স্পেসএক্সের মতো অন্য প্রতিষ্ঠানগুলোতে তিনি সহানুভূতি না-ও দিতে পারেন, কিন্তু বৈদ্যুতিক গাড়ি জনপ্রিয় করা থেকে মঙ্গল গ্রহে উপনিবেশ স্থাপনের মতো সুবিশাল লক্ষ্য দিয়েছেন। এটি টুইটারের জন্যেও কাজ করবে কি না, তা পরিষ্কার নয়।
টুইটারকে এমন একটি ‘ডিজিটাল টাউন স্কয়ার’ হিসেবে গড়ে তোলা যেখানে মুক্তচিন্তার বিকাশ লাভ করবে, ইলন মাস্কের এই চিন্তা অবশ্যই দুর্দান্ত। তবে এবার তিনি এমন একটি ব্যবসায় হাত দিয়েছেন, যেখানে বিচার এবং রাজনীতি ইঞ্জিনিয়ারিংয়ের মতোই সমান গুরুত্বপূর্ণ।
আবার, ইলন মাস্ক যেভাবে সিদ্ধান্ত নেন, তা-ও সংখ্যাগরিষ্ঠ পদ্ধতি নয়। প্রতিষ্ঠানের প্রধান নির্বাহীরা (সিইও) কীভাবে সিদ্ধান্ত নেন সে বিষয়ে খুব কমই গবেষণা হয়েছে। তবে ২০২০ সালে হার্ভার্ড বিজনেস স্কুল সেখানকার ২৬২ জন সাবেক শিক্ষার্থীকে জিজ্ঞাসা করেছিল, তারা কীভাবে কৌশল নির্ধারণ করেন।
গবেষকরা কয়েক ধরনের পদ্ধতি লক্ষ্য করেন। কিছু ব্যবস্থাপক জোরালো বিশ্বাসের ওপর নির্ভর করেন, অন্যরা আনুষ্ঠানিক প্রক্রিয়া ব্যবহার করেন। গবেষকরা দেখেছেন, যেসব কর্মকর্তা তুলনামূলক বেশি কাঠামোগত প্রক্রিয়া ব্যবহার করেন, তারা বড় এবং দ্রুত বর্ধনশীল সংস্থাগুলোর নেতৃত্ব দেন। এ ধরনের বসদের মধ্যে ধীরে সিদ্ধান্ত নেওয়ার প্রবণতা বেশি।
কিন্তু ইলন মাস্ক ও তার সহযোগীরা ভিন্ন শিবিরের। তারা দ্রুত, অনানুষ্ঠানিক ও আক্রমণাত্মক। চাকরিচ্যুত টুইটার কর্মীদের ফিরে আসতে বলা হয়েছে এমন খবর এরই মধ্যে সামনে এসেছে।
টুইটারের নতুন সিইও আরও একটি দিক থেকে প্রথাবিরোধী। প্রখ্যাত ব্যবস্থাপনা চিন্তাবিদ পিটার ডুকারের বর্ণনায় সিইও হলেন সেই ব্যক্তি, যিনি বহির্বিশ্ব এবং প্রতিষ্ঠানের অভ্যন্তরীণ কাজকর্মের মধ্যে সেতুবন্ধন তৈরি করেন। তবে ইলন মাস্ক এই ব্যবধান পূরণ করার মতো তেমন কিছু করছেন না।
ব্যক্তিগত ব্র্যান্ড ও সম্পদ তার মালিকানাধীন অন্য প্রতিষ্ঠানগুলোর সঙ্গে অঙ্গাঙ্গীভাবে জড়িত। টুইটারে তিনি আরও এগিয়ে যাচ্ছেন। তার নিজের টুইটার ফিডে পণ্যের ধারণা তুলে ধরছেন, গ্রাহকদের মতামতের জন্য ভোট নিচ্ছেন এবং বিষয়গুলো কীভাবে চলছে তার সবশেষ চিত্র তুলে ধরছেন।
টুইটার নিজেই এমন একটি প্ল্যাটফর্ম যেখানে ব্যবহারকারী, সাবেক কর্মচারী, প্রতিষ্ঠাতা, নীতিনির্ধারক, পণ্ডিত— প্রত্যেকে সব কিছু কেমন চলছে তা প্রকাশ্যে বলেন। এখানে ভেতরে কথা বলার মতো তেমন কিছু নেই।
আপনি হয়তো বলতে পারেন, ইলন মাস্ক একজনই, এই চুক্তিটিও তাই। তিনি যখন প্রথম টুইটার কেনার প্রস্তাব দিয়েছিলেন, তখন স্পষ্টভাবে বলেছিলেন, এটি কোনো অর্থনৈতিক কারণে হচ্ছে না। পরে লেনদেন থেকে সম্পূর্ণভাবে বেরিয়ে আসারও চেষ্টা করেন।
একটি সোশ্যাল-মিডিয়া প্ল্যাটফর্মের বিলিয়নিয়ার মালিকের সঙ্গে বেশিরভাগ পাবলিক প্রতিষ্ঠানের বেতনভোগী কর্মকর্তাদের চ্যালেঞ্জের খুব বেশি মিল পাওয়া যাবে না। কিন্তু মাস্ক যদি রূঢ় সিদ্ধান্তের ওপর ভর করে, পাওয়ারপয়েন্ট প্রেজেন্টেশন এড়িয়ে তার সবশেষ উদ্যোগে আরেকটি সফলতা অর্জন করেন, তারপরও নিজেকে কিছুটা পরিবর্তন করার প্রয়োজন হবে।
সূত্র: দ্য ইকোনমিস্ট