হঠাৎ করেই আলোচনায় নতুন জঙ্গি সংগঠন ‘জামাতুল আনসার ফিল হিন্দাল শারক্বীয়া’। এই সংগঠনে যোগ দিয়ে নিখোঁজ রয়েছেন দেশের ১৯ জেলার ৫৫ তরুণ। তাদের তথ্য প্রকাশ করেছে র্যাব। এরপরই নড়েচড়ে বসে গোয়েন্দা বাহিনী।
আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনী বলছে, তারা ট্রেনিং নিয়ে পার্বত্য অঞ্চলে আত্মগোপনে আছেন, যা দেশের জন্য নতুন হুমকি হিসেবে দেখা হচ্ছে।
এরইমধ্যে আরেক জঙ্গি সংগঠন আনসার আল ইসলামের সঙ্গে সম্পৃক্ততার অভিযোগে গ্রেপ্তার হয়েছেন জামায়াতে ইসলামীর আমিরের ছেলে ডা. রাফাত চৌধুরী, যা আলোচনায় নতুন মাত্রা যোগ করেছে। পার্বত্য চট্টগ্রামের বিচ্ছিন্নতাবাদী সংগঠন কুকি-চিন ন্যাশনাল ফ্রন্ট (কেএনএফ) এর ক্যাম্পেও যাতায়াত ছিল ডা. রাফাতের। কেএনএফ অর্থের বিনিময়ে হিন্দাল শারক্বীয়ার তরুণদের ট্রেনিং দিয়েছে-এমন তথ্য মিলেছে। আনসার আল ইসলামের মতো অন্য জঙ্গি সংগঠনের সদস্যদেরও ট্রেনিং দিয়ে থাকতে পারে।
এ অবস্থায় নতুন জঙ্গি সংগঠন হিন্দাল শারক্বীয়ার সঙ্গে জামায়াতের সম্পৃক্ততা আছে কি না বা থাকলেও কোন পর্যায়ে তা খতিয়ে দেখতে মাঠে নেমেছে আইনশৃঙ্খলা বাহিনী।
গোয়েন্দা সূত্র বলছে, নতুন জঙ্গি সংগঠন জামাতুল আনসার ফিল হিন্দাল শারক্বীয়া প্রায় চার বছর ধরে গোপনে কার্যক্রম পরিচালনা করলেও এবছরের শুরুতে তারা নতুন নামে আত্মপ্রকাশ করে। নতুন সদস্য সংগ্রহ করে চরাঞ্চল ও পাহাড়ে কেএনএফের মাধ্যমে প্রশিক্ষণ দিচ্ছিল তারা। এ সংগঠনের লক্ষ্য ছিল সশস্ত্র হামলা চালানো। এ লক্ষ্যে তাদের সদস্য সংগ্রহের বিষয়টি জানাজানি হয় গত ২৩ আগস্ট কুমিল্লা থেকে আট কলেজছাত্র নিখোঁজ হওয়ার পর। এসব তরুণের খোঁজ করতে গিয়ে র্যাব জানতে পারে, তাঁদের জঙ্গিবাদে জড়িয়ে ‘হিজরতের’ নামে ঘরছাড়া করা হয়েছে।
এরপর ধারাবাহিক অভিযানের মাধ্যমে র্যাব এই জঙ্গি তৎপরতায় সংশ্লিষ্ট এবং জঙ্গিদের প্রশিক্ষণ দেওয়ায় জড়িত অভিযোগে চট্টগ্রামের দুর্গম পাহাড় ছাড়াও দেশের বিভিন্নস্থানে অভিযান চালিয়ে মোট ২৯ জন এবং সিটিসিটি এখন পর্যন্ত তিনজনকে গ্রেপ্তার করেছে। তাদের মধ্যে একটি ‘বিচ্ছিন্নতাবাদী’ সংগঠনের ৩ সদস্য রয়েছেন। তাছাড়া ডি-রেডিক্যালাইজেশনের মাধ্যমে দুই জঙ্গিকে পরিবারের কাছে ফিরিয়ে দিয়েছে র্যাব। এদের মধ্যে এক নারীকে বুধবার পরিবারে ফিরিয়ে দেয় র্যাব। তবে তার ছেলে এখনো হিন্দাল শারকীয়া’য় যোগ দিয়ে নিখোঁজ আছেন।
আম্বিয়া সুলতানা এমিলি নামের ওই নারীকে যেদিন পরিবারে ফিরিয়ে দেয়া হয় সেদিনই জঙ্গি সম্পৃক্ততার অভিযোগে সিলেট থেকে জামায়াত ইসলামের আমীর শফিকুর ইসলামের ছেলে ডা. রাফাত সাদিক সাইফুল্লাহকে গ্রেপ্তারের তথ্য জানায় কাউন্টার টেররিজম ইউনিট-সিটিটিসি। তাদের দাবি, গ্রেপ্তার রাফাত চৌধুরী নিষিদ্ধ ঘোষিত জঙ্গি সংগঠন আনসার আল ইসলামের সিলেট অঞ্চলের প্রধান সমন্বয়কের ভূমিকা পালন করছিলেন।
সিটিটিসি প্রধান মো. আসাদুজ্জামান বলছেন, জামায়াতের সঙ্গে নতুন জঙ্গি সংগঠন ‘জামাতুল আনসার ফিল হিন্দাল শারক্বীয়া’র কোনো সংযোগ-যোগাযোগ রয়েছে কি না তা খতিয়ে দেখা হচ্ছে। এ সংগঠনের সিলেট অঞ্চলের প্রধান সমন্বয়ক রাফাত জামায়াত আমিরের ছেলে বলে আমরা জানতে পেরেছি।
বৃহস্পতিবার বিকালে ডিএমপি মিডিয়া সেন্টারে এক সংবাদ সম্মেলনে তিনি বলেন, পিতার সংগঠনের (জামায়াত) কোনো নির্দেশনা ছিল কি না বা তাদের দ্বারা নির্দেশিত হয়ে নতুন এই জঙ্গি সংগঠনে যুক্ত হয়েছেন কি না তা রিমান্ডে জিজ্ঞাসাবাদ করে দেখা হবে।
সিটিটিসি জানিয়েছে, ১ নভেম্বর রাজধানীর সায়েদাবাদ এলাকায় অভিযান চালিয়ে সেজাদুল ইসলাম সাহাব তানিম ওরফে ইসা ওরফে আরাফাত ওরফে আনোয়ার ওরফে আনবির, মো. জাহিদ হাসান ভূঁইয়া ও সৈয়দ রিয়াজ আহমদ নামে আনসার আল ইসলামের তিন সদস্যকে গ্রেপ্তার করা হয়। তারা সিলেট থেকে হিজরত করেছিল। সম্প্রতি যত যুবক হিজরত করেছে এরমধ্যে সিলেটে বেশি। হিজরতকালীন মাস্টার মাইন্ড ডাক্তার রাফাত। ডাক্তার রাফাত একটি মেডিকেল থেকে এমবিবিএস পাস করে ইন্টার্নি করছিলেন। ১ নভেম্বর গ্রেপ্তার তানিম, আনবির ও জাহিদের দেওয়া জবানবন্দিতে উঠে এসেছে, তিন যুবকসহ যারাই সিলেট থেকে হিজরত করেছে, নতুন করে দীক্ষা ও রে-ডিক্যালাইডজ হয়েছে এর নেপথ্যে মূল ব্যক্তি ছিলেন ডাক্তার রাফাত।
ডাক্তার রাফাতের নেতৃত্বেই ২০২১ সালের জুন মাসে ১১ যুবক সিলেট থেকে হিজরত করে। তখন তা বেশ চাঞ্চল্যের সৃষ্টি করেছিল। তারা বান্দরবানে যায় কিন্তু কোনো কারণে যোগাযোগ বিচ্ছিন্ন হওয়ায় তারা সাতদিন পর সিলেটে ফিরে আসে। তবে তারা তৎপরতা বন্ধ রাখেননি। ডাক্তার রাফাতের মতো বড় সহযোগী ও সংগঠক তাহহিয়াত। সে আবার গত বছরের আগস্টে পুনরায় হিজরত করে। নাইক্ষ্যংছড়ি পাহাড়ে প্রশিক্ষণ ফেরত এক যুবককে আমরা শনাক্ত ও গ্রেপ্তারে জিজ্ঞাসাবাদ করি। তাহহিয়াতের ছবি দেখালে তিনি তা শনাক্ত করেন। তাহহিয়াতসহ বেশ কয়েকজন তখন ২০২১ সালের আগস্টে প্রশিক্ষণ ক্যাম্পে যোগদেন।
সিলেট অঞ্চল থেকে যেসব যুবক হিজরত করেছেন তাদের দীক্ষা, প্রভাবিত করা, দাওয়াত দেয়া, হিজরতে উদ্বুদ্ধ ও প্রশিক্ষণ ক্যাম্পে পাঠানোর ব্যবস্থা করেন রাফাত।
কুমিল্লার ঘটনার পর নতুন জঙ্গি সংগঠনের নাম উঠে আসে। এরপর সিটিটিসিসহ অন্যান্য বাহিনী ব্যাপক অভিযান শুরু করে। তারা গা ঢাকা দেয়। তারা আবার সিলেট থেকে হিজরতের প্রস্তুতি নেয়। গত ১ নভেম্বরে গ্রেপ্তার তানিম, আনবির ও জাহিদের আরও অনেককে নিয়ে পুনরায় বড় রকমের হিজরতের কথা ছিল। তবে তাদের দেয়া তথ্যে ডা. রাফাতকে গ্রেপ্তার করা হয়।
সিটিটিসি প্রধান আসাদুজ্জামান বলেন, রাফাত দীর্ঘদিন ধরে সিলেট অঞ্চলের ধর্মভীরু যুবকদের জিহাদ ও জঙ্গিবাদে উদ্বুদ্ধ, প্রচার-প্রচারণা চালিয়ে আসছিলেন। কোরআন প্রশিক্ষণের আড়ালে জঙ্গিবাদের দিক্ষা দেয়া হচ্ছিল। তারা বেশ কয়েকজন জিহাদে উদ্বুদ্ধ যুবককে বোমা বানানোর প্রশিক্ষণ দিয়েছেন। প্রশিক্ষণের সক্ষমতাও তারা যাচাই করেছেন। আমরা সেই বোমা বানানো কারিগরকে শনাক্ত করেছি। তাকে গ্রেপ্তারে অভিযান চলছে।
‘হিজরত করতে প্রস্তুত সিলেট অঞ্চলের আরও বেশ কয়েকজন যুবককে আমরা শনাক্ত করেছি। হিজরতের আগেই আমরা মাস্টারমাইন্ড ডা. রাফাতকে গ্রেপ্তার করেছি। তাকে রিমান্ডে এনে জিজ্ঞাসাবাদ করব। সংগঠনের ভবিষ্যত পরিকল্পনা ও সিলেট কেন্দ্রিক তাদের পরিকল্পনা জানতে পারব’—যোগ করেন তিনি।
ডা. রাফাতের সঙ্গে জামায়াত বা শিবিরে কোনো যোগাযোগ রয়েছে কি না জানতে চাইলে আসাদুজ্জামান বলেন, এক সময় শিবির করেছেন ডা. রাফাত। তবে তিনি কী ধরনের নেতা ছিলেন সেটা জানায়নি। বিভিন্ন সংগঠনের সঙ্গে তার যে সিক্রেট যোগাযোগ তা খতিয়ে দেখছি।’
অন্যান্য জঙ্গি সংগঠনের ন্যায় হামলা-নাশকতার লক্ষ্য বা উদ্দেশ্য রয়েছে কি না জানতে চাইলে তিনি বলেন, ‘এই সংগঠনের (জামাতুল আনসার ফিল হিন্দাল শারক্বীয়া) মাস্টারমাইন্ড শামীম মাহফুজ। তার সহযোগী তমাল। তাদের গেপ্তার করা গেলে এর ভবিষ্যৎ পরিকল্পনা জানা যাবে। জঙ্গি সংগঠন মাত্রই হামলা, শক্তি প্রদর্শনের চেষ্টা থাকে। সেই লক্ষে হামলা করে। তবে এই নতুন জঙ্গি সংগঠন এখন পর্যন্ত ততদূর যেতে পারেনি। প্রস্তুতির পর্বেই আমরা তাদের থামিয়ে দিতে পেরেছি।