আজ বাংলাদেশসহ বিশ্বের বিভিন্ন দেশে পালিত হচ্ছে বিশ্ব ডায়াবেটিস দিবস। এবার দিবসটির প্রতিপাদ্য—‘আগামী প্রজন্ম রক্ষায় শিক্ষা’। এ দিবসটি পালনের মূল উদ্দেশ্য ডায়াবেটিস সম্পর্কে শিক্ষা ও গণসচেতনতা অর্জন। কারণ বর্তমানে শিশু থেকে বৃদ্ধ সব বয়সি মানুষের মধ্যে ব্যাপকভাবে ছড়িয়ে পড়ছে এই রোগ, যা খুবই দুশ্চিন্তার বিষয়। ডায়াবেটিসে ক্ষতিগ্রস্ত হয় দেহের প্রতিটি অঙ্গ। বেড়ে যায় দুর্ভোগ। তাই তো আমাদের আজ জানতে হবে—কীভাবে প্রতিরোধ করা যায় এই রোগ।
ডায়াবেটিসে যা হয় : ইনসুলিন নামক অতি প্রয়োজনীয় একটি হরমোনের ত্রুটি দেখা দেয়। হয় অগ্ন্যাশয়ে বিদ্যমান আইলেট্স অব লেঙ্গারহেনস, অর্থাৎ বেটা কোষ থেকে পর্যাপ্ত পরিমাণ ইনসুলিন তৈরি ও নিঃসারণ হয় না, কিংবা এটি যথাযথ হলেও সঠিকভাবে কাজ করতে পারে না। ফলে আমরা প্রতিদিন যেসব খাবার খাই সেগুলোর বিপাকীয় কাজ ভালো করে হতে পারে না। পরিণামে রক্ত শর্করা দেহের বিভিন্ন অঙ্গের কোষসমূহের মধ্যে প্রবেশ করতে না পারায় রোগী অভুক্ত অবস্থায় থাকে। পর্যাপ্ত শক্তি উৎপন্ন না হওয়ায় অনুভূত হয় দৈহিক ও মানসিক দুর্বলতা।
ইনসুলিনের ত্রুটি কেন হয় : এজন্য দায়ী হচ্ছে শারীরিক মাত্রাতিরিক্ত ওজন, স্থূলতা এবং মানুষের গড় আয়ু বৃদ্ধি। দেহের ওজন বাড়লে ইনসুলিনের কাজে বাধাপ্রাপ্ত হয়, আর বয়স যত বাড়ে অগ্ন্যাশয়ের বেটা কোষসমূহের অবক্ষয়ের প্রভাবে ইনসুলিনের নিঃসারণ তত হ্রাস পায়। বয়সের প্রভাবে দেহের ভেতরের প্রায় সব অঙ্গে ক্ষয়িষ্ণুতা দেখা দেওয়ায় অঙ্গসমূহ দৈহিক চাহিদামতো কাজ সম্পাদন করতে পারে না। পেটে অবস্থিত অগ্ন্যাশয়ের কথাই ধরি। এটির মধ্যে বিদ্যমান লাখ লাখ বেটা কোষ বয়সের প্রভাবে ক্ষয় হতে থাকে। কমে যায় ইনসুলিনের নিঃসারণ। স্বাভাবিকভাবেই পরিমাণমতো ইনসুলিন না পাওয়ায় দৈহিক কোষগুলোতে বিপাকীয় প্রক্রিয়ার মাধ্যমে যথাযথভাবে শক্তি উৎপন্ন করা সম্ভব হয় না। এতেই দেখা দেয় বিভিন্ন উপসর্গ।
ইনসুলিনের ত্রুটি হলে বোঝার উপায় : এক্ষেত্রে ডায়াবেটিসের উপসর্গ দেখা দিতে পারে, আবার নাও থাকতে পারে। ঘন ঘন প্রস্রাব, অতিরিক্ত পানির পিপাসা পাওয়া, ক্ষুধা বৃদ্ধি, ওজন কমে যাওয়া ও দুর্বলতা অনুভব করলে ডায়াবেটিসের অনুমান করা যায়। তবে নিশ্চিত হতে হলে ব্লাড সুগার পরীক্ষা করতে হয়। সকালে খালি পেটে সাত এবং খাবার খাওয়ার দুই ঘণ্টা পর কিংবা দিনের যে কোনো সময় ব্লাড সুগারের মাত্রা ১১ দশমিক ১ মিলিমোল/লিটার বা তার বেশি হলে বলা যাবে ডায়াবেটিস হয়েছে।
বয়স ৪৫ পেরিয়ে গেলে, দেহের ওজন বাড়লে, বাবা-মায়ের ডায়াবেটিস থাকলে, উচ্চ রক্তচাপ ও রক্তে কোলেস্টেরলের পরিমাণ অতিরিক্ত হলে ব্লাড সুগার পরীক্ষা করানো উচিত।
ইনসুলিনের ত্রুটি প্রতিরোধের উপায় : জীবনচর্যার মান স্বাস্থ্যকর হতে হবে। জীবনচর্যার দুটি অংশ :এক. খাদ্যাভ্যাস, দুই. ব্যায়াম। মনে রাখুন, খাদ্যাভ্যাস ও ব্যায়ামের নিয়ম মেনে না চললে, একদিকে কমবে দেহের রোগ প্রতিরোধ ক্ষমতা, অন্য দিকে দেহে প্রকাশ পাবে নানান অসংক্রামক রোগ, যেগুলোর মধ্যে ডায়াবেটিস, হৃদরোগ, স্থূলতা, কিছু ক্যানসার, বন্ধ্যাত্ব এবং মানসিক সমস্যা অন্যতম। এজন্য আপনাকে ও আপনার পরিবারের সবাইকে খেতে অভ্যস্ত হতে হবে কম গ্লাইসেমিক ইনডেক্স (লোজিআই) ধরনের খাবার, আর কমাতে হবে উচ্চ গ্লাইসেমিক ইনডেক্স (হাইজিআই) যুক্ত খাবার। কোল্ড ড্রিংক্স পরিহার করতে হবে অবশ্যই। অতিথি আপ্যায়ন ও সামাজিক অনুষ্ঠানে কোল্ড ড্রিংকসের পরিবর্তে ডাবের পানি, লেবু বা পাকা বেলের শরবত, ফলের রস, দইয়ের মাঠা ইত্যাদি পানীয় ব্যবহারের প্রচলন করতে পারলে খুব ভালো হয়। এছাড়া বিভিন্ন রকমের ব্যায়াম রয়েছে। তবে ‘একটু দ্রুত হাঁটা’ হলো সহজ ও উত্তম একটি ব্যায়াম। স্কুল, কোচিং অথবা অফিস বা ব্যবসাপ্রতিষ্ঠান বেশি দূরে না থাকলে হেঁটে আসা-যাওয়া করা উত্তম।
ইনসুলিনের ত্রুটি হলে চিকিৎসা :নিয়মিত ব্যায়ামের পাশাপাশি খাবারের মধ্যে বাদ দিতে হবে চিনি, মিষ্টি ও কোমল পানীয়। বেশি খেতে হবে শাকসবজি-টক ফল আর পরিমাণমতো খেতে হবে আলু, ভাত, রুটি, ভুট্টা, খিচুড়ি, ডাল, দুধ, ডিমের সাদা অংশ, ছোটো মাছ ও মুরগির মাংস। শসা, খিরা, টম্যাটো, পিঁয়াজ, রসুন, আদা ও বিভিন্ন মসলা খাওয়া যাবে ইচ্ছামতো। শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে ব্যায়াম ও খেলাধুলার ব্যবস্থা এবং সন্তানকে মোবাইল-কম্পিউটার অধিক ব্যবহারে নিরুত্সাহিত করতে হবে।
লেখক : ডায়াবেটিস, স্থূলতা, থাইরয়েড ও হরমোন বিশেষজ্ঞ সহযোগী অধ্যাপক, ঢাকা ন্যাশনাল মেডিক্যাল কলেজ হাসপাতাল