উন্নত দেশগুলো বিশ্ব জলবায়ু সম্মেলনে (কপ-২৭) বৈশিক জলবায়ু পরিবর্তনজনিত ‘লস অ্যান্ড ড্যামেজ’ তহবিল গঠনের সিদ্ধান্ত নিয়েছে। আগামী দুই বছরের মধ্যে এর অবকাঠামো গঠন, অর্থায়নের প্রক্রিয়া, কোন পদ্ধতিতে পরিশোধ করা হবে- সেসব বিষয় চূড়ান্ত করা হবে।
তবে প্যারিস চুক্তি অনুযায়ী উন্নয়শীল দেশগুলোকে ক্ষতিপূরণ হিসেবে ১০০ বিলিয়ন দেওয়ার কথা থাকলেও সেটি এই আসরে গুরুত্ব পায়নি। ইউক্রেন যুদ্ধের কারণে বৈশ্বিক অর্থনৈতিক মন্দার দোহাই দিয়ে এ অর্থ পরিশোধ না করার একটি পায়তারা করা হয়েছে। তবে ক্ষতিগ্রস্ত দেশগুলো এ দাবি থেকে সরছে না, এ আসরের শেষ পর্যন্ত তারা ন্যায্য দাবি জানিয়ে যাবেন বলে জানা গেছে।
জলবায়ু সম্মেলনে অংশগ্রহকারী বিশেষজ্ঞরা জানান, ক্ষতিপূরণ হিসেবে উন্নত দেশগুলো যে প্রতিশ্রুতি দিয়েছিল সেটি এখানো বাস্তবায়ন হয়নি। পরবর্তী কপ সম্মেলনে এটি আলোচনা করা হবে। ১০০ বিলিয়নের পরিবর্তে এর অর্থ আরও বাড়ানোর দাবি তোলা হবে। এরইমধ্যে এটি নিয়ে বর্তমান সম্মেলনে আলোচনা হয়েছে।
এসব বিষয়ে মঙ্গলবার (১৫ নভেম্বর) বাংলাদেশের পরিবেশ, বন ও জলবায়ু মন্ত্রী মো. শাহাব উদ্দিন বলেন, এ বছর ক্ষতিপূরণ হিসেবে অর্থ পরিশোধ করা না হলেও সম্মেলনে লস অ্যান্ড ড্যামেজ তহবিল গঠনে উন্নত দেশগুলো একমত হয়েছে। বিশেষ করে ডেনমার্ক ও বেলজিয়ামসহ আরও কয়েকটি দেশ লস অ্যান্ড ড্যামেজে অর্থায়ন করবে বলে প্রতিশ্রুতি দিয়েছে। এই বিষয়টি সম্মেলনে গুরুত্বের সঙ্গে আলোচনা হচ্ছে। ২০২৩ বা ২০২৪ সালের মধ্যে এর অবকাঠামো, তহবিল গঠন ও প্রদান করার বিষয় চূড়ান্ত হবে।
সম্মেলয়ে যুক্ত হওয়া বাংলাদেশের পরিবেশ, বন ও জলবায়ু মন্ত্রণালয়ের অতিরিক্ত সচিব মো. মনিরুজ্জামান বলেন, জলবায়ু পরিবর্তন মোকাবিলায় উন্নত দেশগুলো যে প্রতিশ্রুতি দিচ্ছে তা বাস্তবায়ন করা হচ্ছে না। প্যারিস চুক্তি অনুযায়ী তাপমাত্রা ১ দশমিক ৫ ডিগ্রিতে রাখতে যেসব শর্ত ছিল সেটি মানা হচ্ছে না।
তিনি বলেন, জলবায়ু পরিবর্তনজনিত লস অ্যান্ড ড্যামেজ ফান্ডের জন্য বছরে ১০০ বিলিয়ন ডলার দেওয়ার প্রতিশ্রুতি থাকলেও শুরুতে ৮০ বিলিয়ন করে দেওয়া হয়। গত দুই বছর ধরে এ তহবিলে অর্থ দেওয়া হচ্ছে না। যে অর্থ দেওয়া হয়েছে তাও আবার নানা খাতের হিসাব দেখানো হয়েছে। অভিযোজন ফান্ডে ৪৩৬ মিলিয়ন দেওয়ার সিদ্ধান্ত থাকলেও ৫০ শতাংশ অর্থ পরিশোধ করা হচ্ছে না। এটি আরও ৪০ শতাংশ বৃদ্ধির দাবি জানানো হয়েছে। প্যারিস চুক্তি অনুযায়ী ২০৩০ সালের মধ্যে তাপমাত্রা এক দশমিক ৫ শতাংশে আনতে হলে ৪৫ শতাংশ কার্বন ব্যবহার কমাতে হবে। অথচ বর্তমানে এই তাপমাত্রা বেড়ে যচ্ছে, তাতে করে এ সময়ের মধ্যে আরও ৯ শতাংশ বৃদ্ধি পাবে।
মো. মনিরুজ্জামান বলেন, বর্তমানে রাশিয়া ও ইউক্রের যুদ্ধের দোহায় দিয়ে জরুরির কথা বলে ফসিল ফুয়েল (কয়লা, পেট্রল, ডিজেল) ব্যবহার বাড়িয়ে চুক্তির উল্টো দিকে হাঁটছে। জলবায়ু সংকট মোকাবিলার জন্য যে কার্যক্রম দরকার সেটি আসলে নেওয়া হচ্ছে না। আমরা আমাদের হতাশা, অবস্থা তুলে ধরেছি। অভিযোজন তহবিল বাড়ানোর দাবি জানিয়ে যাচ্ছি। কপ-২৭ এর এবারের স্লোগান ‘সবাই মিলে বাস্তবায়ন’।
কথা যদি বাস্তবায়ন না হয় তবে কথার ফুলঝুরি দিয়ে লাভ কী প্রশ্ন তুলে তিনি বলেন, প্যারিস চুক্তিতে লস অ্যান্ড ড্যামেজ আলাদা করা হলেও সেটি এবার আমলে নেওয়া হচ্ছে। এ খাতে আলাদা একটি তহবিল থাকে ও অভিযোজন ফান্ড দ্বিগুণ করা মূলত আমাদের দাবি।
কপ-২৭ এ যুক্ত হয়ে ঢাকা উত্তর সিটি করপোরেশনের (ডিএনসিসি) মেয়র আতিকুল ইসলাম বলেন, পরিবেশের ক্ষতির কারণে আমাদের শস্য নষ্ট হচ্ছে। প্রাকৃতিক দুর্যোগের কারণে প্রন্তিক খামারিরা নিঃস্ব হয়ে যায়। উন্নত দেশগুলো বেশি বেশি কার্বন নিঃসরণ করে আমাদের ক্ষতি করছে। জমিতে লবণাক্ত পানি জমে ফসল নষ্ট হয়ে যাচ্ছে। এ কারণে আমাদের শস্য বিমা করতে হবে। বিমার অর্থ উন্নত দেশগুলোকে পরিশোধ করার দাবি জানান তিনি।
ডিএনসিসি মেয়র আরও বলেন, আমাদের সময় এখন কথা কম কাজ বেশি করার। উন্নত দেশগুলো আমাদের কোনোভাবে সার্পোট দিচ্ছে না। এবারের কপ সম্মেলন বৃথা হবে যদি উন্নত দেশগুলো উন্নয়নশীল দেশগুলোকে ক্ষতিপূরণ ও সার্পোট না দেয়। এটি হ্যান্ড টু হ্যান্ড নয়, হার্ট টু হার্ট হিসেবে কাজ করতে হবে। বিশ্বজুড়ে যুদ্ধ বন্ধ করে অস্ত্র কিনতে যে অর্থ ব্যয় করা হচ্ছে তার তিনের একাংশ পরিবেশের জন্য ব্যয় করতে হবে। তাহলে আগামী প্রজন্মকে সুস্থ একটি পরিবেশ দিয়ে যেতে পারবো।
কপ-২৭ সম্মেলনে অংশগ্রহণকারী বিশেষজ্ঞরা বলেন, ঘনঘন প্রাকৃতিক দুর্যোগের কারণে আমাদের লস অ্যান্ড ড্যামেজ বেশি হচ্ছে। উপকূলীয় অঞ্চলে লবণাক্ততা বৃদ্ধি এর বড় উদাহরণ। আবার বন্যায় শুধু আমাদের অবকাঠামো ধ্বংস হচ্ছে না, বানভাসি মানুষও মারাত্মকভাবে ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছে। তারা তাদের জীবিকা ও ফসল হারাচ্ছে। তবে আশার বিষয় হলো, এবারের জলবায়ু সম্মেলনে এই হারিয়ে যাওয়া ও সার্বিক ক্ষতি স্বীকৃতি দেওয়া হয়েছে।
তারা বলেন, তহবিল নিয়ে উন্নত দেশগুলো নানা ধরনের শুভঙ্করের ফাঁকি দেওয়ার চেষ্টা চালিয়ে থাকে। এটি কোনোভাবে ছেড়ে দেওয়া যাবে না। প্রকৃতিক দুর্যোগের কারণে গত এক বছরে আমাদের তিন বিলিয়ন ডলার ক্ষতি হয়েছে। এই ফান্ডিং এর ক্ষেত্রে স্বচ্ছতা আনা খুবই জরুরি। যতক্ষণ পর্যন্ত স্বচ্ছতা আসবে না, ততক্ষণ ক্লাইমেট ফান্ডের গতিও আসবে না।
এদিকে মঙ্গলবার (১৫ নভেম্বর) কপ আসরের ১০তম দিনকে নাগরিক সমাজ এবং এনার্জি দিবস হিসেবে পালন করা হয়। এদিন মূলত জলবায়ু পরিবর্তন ঝুঁকি মোকাবিলায় ও পরিকল্পনা প্রণয়নে নাগরিক সমাজের ভূমিকা ও অবদান এবং জীবাশ্ম জ্বালানি থেকে নবায়নযোগ্য জ্বালানিতে পরিবর্তনের চ্যালেঞ্জ ও সুযোগগুলো নিয়ে আলোচনা হয়।
আয়োজকরা জানান, সম্মেলনে জলবায়ু পরিবর্তন ঝুঁকি মোকাবিলায় নাগরিক সমাজের ভূমিকা ও অবদান নিয়ে চারটি এবং এনার্জি নিয়ে আটটি অধিবেশন আয়োজন করা হয়। নাগরিক সমাজ নিয়ে প্রথম অধিবেশনে বৈশ্বিক জলবায়ু এজেন্ডা গঠন এবং প্যারিস চুক্তির অধীনে নির্ধারিত প্রতিশ্রুতি বাস্তবায়নে নাগরিক সমাজের ভূমিকার ওপর আলোচনা হয়। উন্নত দেশগুলোকে তাদের জলবায়ু অর্থ প্রদানের দায়বদ্ধতা পূরণে নাগরিক সমাজের ভূমিকা নিয়ে দ্বিতীয় অধিবেশনে আলোচনা চলে।
এছাড়াও উন্নয়নশীল দেশে জলবায়ু পরিবর্তন ঝুঁকি মোকাবিলায়, জলবায়ু পরিবর্তনের বিপর্যয় প্রতিরোধ ও ব্যবস্থাপনায় নাগরিক সমাজের দ্বারা বাস্তবায়িত প্রচেষ্টাগুলোর ওপর আলোচনা গুরুত্ব পায় তৃতীয় অধিবেশনে। সম্মেলনের চতুর্থ অধিবেশনে এইচ ফ্রেমওয়ার্ক বাস্তবায়নে নাগরিক সমাজের অবদান নিয়ে আলোচনা করার কথা রয়েছে।