যুক্তরাজ্যে সব ধরনের খাদ্যপণ্যের দাম বেড়েছে। এই মূল্যবৃদ্ধি গত ৪৫ বছরের মধ্যে সর্বোচ্চ। সবচেয়ে বেশি বেড়েছে দুধ, পনির ও ডিমের মতো নিত্যপ্রয়োজনীয় খাদ্যের দাম। সবশেষ পরিসংখ্যান অনুযায়ী, যুক্তরাজ্যে অক্টোবরে খাদ্যমূল্যস্ফীতি আগের বছরের একই সময়ের চেয়ে ১৬ দশমিক ২ শতাংশ বেশি। গত সেপ্টেম্বরে খাদ্যমূল্যস্ফীতি ছিল ১৪ দশমিক ৫ শতাংশ। খাদ্যপণ্যের পাশাপাশি বেড়েছে জ্বালানি তেল, গ্যাসসহ সব ধরনের জ্বালানি পণ্যের দাম।
নিত্যপণ্যের এই মূল্যবৃদ্ধি সবচেয়ে বেশি আঘাত হানছে যুক্তরাজ্যের কর্মজীবী ও মধ্যবিত্ত মানুষের ওপর। সংসার চালাতে হিমশিম খাচ্ছেন তারা। তাদের আয়ের বেশির ভাগই যাচ্ছে খাদ্য কিনতে ও জ্বালানির বিল মেটাতে।
খাদ্য ও জ্বালানিসহ সব ধরনের পণ্যের এই মূল্যবৃদ্ধির ফলে এ মুহূর্তে যুক্তরাজ্যের মূল্যস্ফীতি গত ৪১ বছরের মধ্যে সর্বোচ্চ। অক্টোবরে ব্রিটেনের সার্বিক মূল্যস্ফীতি দাঁড়িয়েছে ১১ দশমিক ১ শতাংশে। যুক্তরাজ্যের ইতিহাসে সবশেষ এত বেশি মাত্রার মূল্যস্ফীতি দেখা গিয়েছিল ১৯৮১ সালের অক্টোবরে।
যুক্তরাজ্যের পরিসংখ্যান কর্তৃপক্ষ অফিস ফর ন্যাশনাল স্ট্যাটিসটিকস (ওএনএস) মূল্যস্ফীতি পরিস্থিতি পর্যবেক্ষণের জন্য সাধারণ ব্রিটিশদের প্রতিদিনের প্রয়োজন হয় এমন ১০০টি নিত্যপণ্যের মূল্যের ওঠানামার তথ্য সংগ্রহ করে থাকে। এই পণ্যগুলোকে বলা হয় বাসকেটস অব গুডস। এই বাসকেটস অব গুডসের মধ্যে অক্টোবরে সবচেয়ে বেশি বেড়েছে দুধ, পাস্তা, মারজারিন, ডিম এবং দানাদার অথবা সিরিয়ালজাতীয় খাদ্যের দাম। তবে ওএনএসের তথ্যানুযায়ী সব ধরনের পণ্যের মধ্যে সবচেয়ে বেশি বেড়েছে জ্বালানির দাম।
এ ব্যাপারে ওএনএসের প্রধান অর্থনীতিবিদ গ্রান্ট ফিজনার বলেন, গ্যাসের দাম এক বছরে ১৩০ শতাংশ বেড়েছে। বিদ্যুতের বিল বেড়েছে ৬৬ শতাংশ। গ্যাস ও বিদ্যুতের এই বর্ধিত দামই মূল্যস্ফীতি বাড়ার প্রধান কারণ।
জ্বালানির দামের লাগামহীন বৃদ্ধি প্রতিরোধ করতে অবশ্য এরইমধ্যে এনার্জি প্রাইস গ্যারান্টি স্কিম নামের একটি সহায়তা কর্মসূচি চালু করেছে ব্রিটিশ সরকার। অবশ্য তাতেও মূল্যস্ফীতি পরিস্থিতির উন্নতি হচ্ছে না। তবে এই জ্বালানি সহায়তা কর্মসূচি চালু না হলে মূল্যস্ফীতি বেড়ে ১৩ দশমিক ৮ শতাংশে পৌঁছাত বলে উল্লেখ করেন গ্রান্ট ফিজনার।
এদিকে মূল্যস্ফীতি বাড়ার কারণে জিনিসপত্রের দামও বাড়াতে বাধ্য হচ্ছেন ব্যবসায়ীরা। অপরদিকে বেড়ে যাওয়া খরচ সামলাতে কেনাকাটা কমিয়ে দিয়েছেন সাধারণ ভোক্তারা। পরিস্থিতি সামলাতে সম্প্রতি ব্যাংক অব ইংল্যান্ড সুদের হার ৩ শতাংশ বাড়িয়ে দেয়। তবে এর ফলে ব্যাংক থেকে ঋণ নেয়ার খরচ বেড়েছে। এর ফলে ব্রিটেনের অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধি বাধাগ্রস্ত হওয়ার আশঙ্কা দেখা দিয়েছে।
অর্থনীতিবিদরা মনে করছেন, বর্তমান পরিস্থিতি অব্যাহত থাকলে চলতি বছর শেষ হওয়ার আগেই মন্দার মধ্যে ঢুকে পড়বে ব্রিটেনের অর্থনীতি।
সবশেষ তথ্যানুযায়ী, ব্রিটেনের অর্থনীতি জুলাই-সেপ্টেম্বর প্রান্তিকে শূন্য দশমিক ২ শতাংশ সংকুচিত হয়েছে। এই ধারা আগামী বছরও অব্যাহত থাকতে পারে বলে সতর্ক করেছে ব্রিটেনের কেন্দ্রীয় ব্যাংক।
এদিকে ব্রিটেনের বর্তমান অর্থনৈতিক পরিস্থিতিতে ধনবৈষম্য বাড়ছে। ধনী ও দরিদ্রের অর্থনৈতিক ব্যবধান বাড়ছে। খাদ্য ও জ্বালানির দাম অস্বাভাবিক হারে বেড়ে যাওয়ায় ধনীদের তুলনায় বেশি ভুক্তভোগী হচ্ছে দরিদ্র পরিবারগুলো।
পরিসংখ্যানে দেখা গেছে, সবচেয়ে দরিদ্র ১০ শতাংশ পরিবারের জীবনযাত্রার খরচ ১২ দশমিক ৫ শতাংশ বেড়েছে। অপরদিকে সবচেয়ে ধনী ১০ শতাংশ পরিবারের ওপর মূল্যস্ফীতির প্রভাব পড়ছে ৯ দশমিক ৬ শতাংশ হারে।
ওএনএসের পরিসংখ্যানে দেখা গেছে, নিম্ন ও উচ্চ আয়ের পরিবারগুলোর মধ্যে মূল্যস্ফীতির ব্যবধান ২০০৯ সালের মার্চের পর বর্তমানে সবচেয়ে বেশি।
এদিকে যুক্তরাজ্যের বর্তমান মূল্যস্ফীতি পরিস্থিতি ঋষি সুনাকের নেতৃত্বাধীন ব্রিটেনের নতুন সরকারের ওপর ব্যাপক চাপ সৃষ্টি করেছে। এর জন্য অর্থনৈতিক পরিস্থিতি সামলানোর উপায় খুঁজছেন অর্থমন্ত্রী জেরেমি হান্ট। বৃহস্পতিবার (১৭ নভেম্বর) শরৎকালীন বাজেট উপস্থাপন করতে যাচ্ছেন তিনি। ধারণা করা হচ্ছে, পরিস্থিতি সামাল দিতে কর বৃদ্ধি এবং কৃচ্ছ্রসাধনের মতো পদক্ষেপ ঘোষণা করবেন তিনি।
জেরেমি হান্ট বলেন, তার প্রাথমিক লক্ষ্য নিত্যপ্রয়োজনীয় পণ্যের লাগামহীন মূল্যবৃদ্ধিকে নিয়ন্ত্রণ করা। এ জন্য প্রয়োজনে কঠিন সিদ্ধান্ত গ্রহণ করবেন তিনি।
তার মতে, মূল্যস্ফীতি নিয়ন্ত্রণে রাখতে কঠোর অর্থনৈতিক পদক্ষেপ ছাড়া আর কোনো উপায় নেই, কারণ, বর্তমান মূল্যস্ফীতি বজায় থাকলে দীর্ঘ মেয়াদে টেকসই অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধি সম্ভব নয়।
তবে যুক্তরাজ্যের অর্থনৈতিক এ পরিস্থিতির জন্য ব্রিটেনের ক্ষমতাসীন রক্ষণশীল দলের ভুল অর্থনৈতিক নীতিকে দায়ী করছে বিরোধী দল লেবার পার্টি। লেবার পার্টির ছায়া অর্থমন্ত্রী র্যাচেল রিভস বলেন, বাড়তে থাকা মূল্যস্ফীতি এরই মধ্যে যুক্তরাজ্যের সাধারণ মানুষের মধ্যে আতঙ্ক ও অনিশ্চয়তা তৈরি করেছে।
এজন্য রক্ষণশীল দলকে দোষারোপ করে র্যাচেল রিভস বলেন, অন্যান্য দেশের তুলনায় ব্রিটেনের জনগণ মূল্যস্ফীতির কারণে বেশি ভুগছে। রক্ষণশীল সরকারের গত ১২ বছরের শাসনে অর্থনৈতিক ব্যর্থতার কারণে যেকোনো সংকটে অন্যান্য দেশের তুলনায় সবচেয়ে বেশি আক্রান্ত হচ্ছেন তারা।
তবে ব্রিটেনের এই অর্থনৈতিক দুরবস্থার জন্য কোভিড মহামারি এবং পুতিনের শুরু করা ইউক্রেন যুদ্ধকে দায়ী করেছেন অর্থমন্ত্রী জেরেমি হান্ট।