আগামী সপ্তাহে দুই দিনের সফরে ঢাকায় আসছেন রাশিয়ার পররাষ্ট্রমন্ত্রী সের্গেই লাভরভ। ঢাকায় অনুষ্ঠেয় ভারত মহাসাগরীয় দেশগুলোর সহযোগিতা জোটের (আইওআরএ) মন্ত্রী পর্যায়ের সভায় যোগ দেবেন তিনি। তবে রাশিয়া-ইউক্রেন যুদ্ধ ঘিরে বর্তমান বৈশ্বিক প্রেক্ষাপটে তাঁর এই সফরের আলাদা ভূরাজনৈতিক গুরুত্ব রয়েছে বলে মনে করছেন কূটনৈতিক বিশ্লেষকেরা।
কূটনৈতিক বিশ্লেষকেরা বলছেন, আন্তর্জাতিক পরিমণ্ডলে নিজেদের অবস্থান সামনে আনতে দক্ষিণ এশিয়ায় ভারতের পাশাপাশি বাংলাদেশকেও জোরালোভাবে পাশে পাওয়ার চেষ্টায় রুশ পররাষ্ট্রমন্ত্রী ঢাকায় আসছেন। অন্যদিকে তাঁর এই সফরে খাদ্যনিরাপত্তা ও রোহিঙ্গা সংকটের মতো বিষয়গুলো জোরালোভাবে তুলে ধরতে চায় বাংলাদেশও।
পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের কর্মকর্তারা গণমাধ্যমকে জানিয়েছেন, ২৩ নভেম্বর রুশ পররাষ্ট্রমন্ত্রী দুই দিনের সফরে ঢাকায় আসছেন। আইওআরএর মন্ত্রী পর্যায়ের সম্মেলনে যোগ দেওয়ার আগে তিনি ২৩ নভেম্বর সন্ধ্যায় প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার সঙ্গে সৌজন্য সাক্ষাৎ করবেন। আর ২৪ নভেম্বর সকালে তিনি পররাষ্ট্রমন্ত্রী এ কে আব্দুল মোমেনের সঙ্গে আনুষ্ঠানিক বৈঠক করবেন।
লাভরভের আসন্ন সফরের বিষয়ে জানতে চাইলে পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের জ্যেষ্ঠ কর্মকর্তারা বলেছেন, ইউক্রেনের সঙ্গে যুদ্ধের প্রেক্ষাপটে রাশিয়ার পররাষ্ট্রমন্ত্রী সের্গেই লাভরভের ঢাকা সফরটি দ্বিপক্ষীয় এবং আন্তর্জাতিক প্রেক্ষাপটে তাৎপর্যপূর্ণ। দ্বিপক্ষীয় প্রেক্ষাপট থেকে বিবেচনায় নিলে স্বাধীনতার ৫০ বছর পর রাশিয়ার কোনো পররাষ্ট্রমন্ত্রী প্রথমবারের মতো বাংলাদেশে আসছেন। খুব স্বাভাবিকভাবেই একাত্তরের মুক্তিযুদ্ধে সাবেক সোভিয়েত ইউনিয়নের জোরালো ভূমিকা আর সমর্থনের প্রসঙ্গ টেনে লাভরভ দুই দেশের সম্পর্ক ঝালাইয়ের বিষয়টিতে গুরুত্ব দেবেন। ফলে অতীতের ধারাবাহিকতায় সম্পর্ক গভীরতর করার প্রসঙ্গ এলে দুই পক্ষ নিজেদের অগ্রাধিকারগুলো সামনে আনবে। তেমনি দুই পক্ষ নিজেদের অগ্রাধিকারের চ্যালেঞ্জগুলো নিয়ে কথা বলবে।
আন্তর্জাতিক প্রেক্ষাপট থেকে বিবেচনা করলে এ বছরের ফেব্রুয়ারিতে ইউক্রেনের বিরুদ্ধে পুরোমাত্রায় যুদ্ধে জড়ানোর পর থেকেই কোণঠাসা হয়ে পড়ছে রাশিয়া। আন্তর্জাতিক সংস্থাগুলো পশ্চিমা বিশ্বের নিয়ন্ত্রণ থাকায় ক্রমে দুর্বল হয়ে পড়ছে রাশিয়ার কণ্ঠস্বর। নিরাপত্তা পরিষদে ভেটো প্রদানের ক্ষমতাধারী পাঁচটি স্থায়ী সদস্যের অন্যতম হওয়ার পরও রাশিয়া নানা বিষয় এখন সাধারণ পরিষদে তুলতে বাধ্য হচ্ছে। এমন এক পরিস্থিতিতে আন্তর্জাতিক পরিমণ্ডলে নিজের অবস্থান সামনে আনতে প্রতিবেশী ভারতের পাশাপাশি এখন বাংলাদেশকে জোরালোভাবে পাশে পেতে চাইছে রাশিয়া।
কূটনৈতিক সূত্রগুলো বলছে, আইওআরএর মন্ত্রী পর্যায়ের বৈঠকে যোগ দিতে সফরটি হলেও মূলত রাজনৈতিক সম্পর্কের বিষয়টিতে জোর দিচ্ছে মস্কো। ২৩টি দেশের সমন্বয়ে গঠিত আইওআরএতে যুক্ততার বিষয়ে রাশিয়া দীর্ঘদিন ধরে অপেক্ষায় ছিল।
এবার ঢাকায় অনুষ্ঠেয় আইওআরএর মন্ত্রী পর্যায়ের বৈঠকে সংলাপ অংশীদার হওয়ার সুযোগটিকে রাশিয়া রাজনৈতিকভাবে কাজে লাগাতে চাইছে। রুশ পররাষ্ট্রমন্ত্রী ঢাকায় আসার আগেই বাংলাদেশের প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার সঙ্গে কথা বলার বিষয়টি নিশ্চিত করতে চেয়েছেন। ফলে আইওআরএর মন্ত্রী পর্যায়ের বৈঠকে যোগ দিতে এলেও পরীক্ষিত বন্ধু বাংলাদেশের সঙ্গে রাজনৈতিক সম্পর্ক গভীরতর করার মাধ্যমে ভূরাজনৈতিক প্রতিযোগিতার কেন্দ্রে থাকা ভারত মহাসাগর নিয়ে রাশিয়ার আগ্রহের বিষয়টি সামনে চলে আসছে।
সের্গেই লাভরভের ঢাকা সফরের বিষয়টি গত শনিবার একটি কূটনৈতিক চিঠির মাধ্যমে নিশ্চিত করেছে মস্কো। ২৪ নভেম্বর ঢাকায় পররাষ্ট্রমন্ত্রী এ কে আব্দুল মোমেনের সঙ্গে রুশ পররাষ্ট্রমন্ত্রীর খসড়া আলোচ্যসূচির একটি প্রস্তাবও কয়েক দিন আগে বাংলাদেশকে দেওয়া হয়েছে। রাশিয়ার প্রস্তাবিত আলোচ্যসূচির বিষয়বস্তুতে নজর দিলেই বোঝা যাবে, আঞ্চলিক ও আন্তর্জাতিক পরিমণ্ডলের নানা বিষয় নিয়ে ঢাকার সঙ্গে কথা বলতে আগ্রহী মস্কো।
মস্কো থেকে পাঠানো আলোচ্যসূচিতে রয়েছে দ্বিপক্ষীয় সহযোগিতার পর্যালোচনা, রূপপুর পারমাণবিক বিদ্যুৎ প্রকল্পের পরিস্থিতি, শিক্ষা খাতে সহায়তা, আইনি রূপরেখার সংস্কার, জাতিসংঘে সহযোগিতা, আইওআরএর সহায়তা, রোহিঙ্গা শরণার্থী সমস্যা, ভারত ও প্রশান্ত মহাসাগর অঞ্চল নিয়ে ভাবনা এবং ইউক্রেনকে কেন্দ্র করে পরিস্থিতি।
রাশিয়ার প্রস্তাবিত আলোচ্যসূচির বিষয়ে দৃষ্টি আকর্ষণ করলে দায়িত্বশীল এক কর্মকর্তা বলেন, রোহিঙ্গা সংকটের বিষয়টি তাদের দিক থেকে আসার ফলে এটা স্পষ্ট যে রাশিয়ার কাছে বাংলাদেশ কী চায়, সেটি তারা বুঝতে পেরেছে। মিয়ানমার ও রোহিঙ্গা ঘিরে বাংলাদেশ অস্বস্তিতে আছে। এ বিষয়ে লাভরভ নিজেদের অবস্থান স্পষ্ট করার চেষ্টা করবেন।
এর পাশাপাশি ভারত ও প্রশান্ত মহাসাগর অঞ্চল নিয়ে ভাবনার কথা উল্লেখ করে রাশিয়া এখানে ভূরাজনৈতিক প্রতিযোগিতার বিষয়টি সামনে নিয়ে আসবে। আর জাতিসংঘ ও আইওআরএর সহায়তার মধ্য দিয়ে আন্তর্জাতিক পরিমণ্ডলে বাংলাদেশকে আরও কাছে পাওয়ার বিষয়টি রুশ পররাষ্ট্রমন্ত্রী তাঁর ঢাকা সফরে জোরালোভাবে তুলে ধরবেন বলে ওই কর্মকর্তার ধারণা।