দৈনিক পত্রিকাগুলোতে আজ প্রকাশিত একটি সংবাদ জাতিকে শুধু বিস্মিত ও লজ্জিতই করেনি, একই সঙ্গে নানা প্রশ্নের মুখোমুখি করেছে। পাবনার ঈশ্বরদীর ১২ কৃষক মাত্র ২৫ থেকে ৩০ হাজার টাকা ব্যাংক ঋণ নিয়ে ‘শোধ’ না করার অভিযোগে করা সমবায় ব্যাংকের একটি মামলায় কারাগারে আছেন। ব্যাংকটির মামলায় ওই উপজেলার ৩৭ কৃষকের নামে গ্রেপ্তারি পরোয়ানা জারি করেন আদালত।
হাজারো কোটি টাকা ঋণ নিয়ে বছরের পর বছর ধরে পরিশোধ না করেও দিব্যি যে দেশে বুক ফুলিয়ে ঘুরে বেড়াচ্ছেন প্রভাবশালীরা, সে দেশে প্রান্তিক কৃষকদের মাত্র ২৫ থেকে ৩০ হাজার টাকা ঋণের জন্য জেল ও জরিমানা অত্যন্ত দু:খজনক। কারণ, কৃষিপ্রধান এ দেশে কৃষকরা অর্থনীতির বিশেষ মেরুদণ্ড বলে আমরাই আবার বুলি আওড়ায়!
চলতি বছরের জুনে প্রকাশিত এক হিসাব অনুযায়ী, গত ৩২ বছরে দেশে ঋণ খেলাপি বেড়েছে ২৯ গুণ। ১৯৯০ সালে মোট খেলাপি ঋণের পরিমাণ ছিল চার হাজার ৬৪৬ কোটি টাকা। বর্তমানে এর পরিমাণ দাঁড়িয়েছে এক লাখ ৩৪ হাজার ৩৯৬ কোটি টাকায়। পদ্মা সেতুর মতো গৌরবের এমন জাতীয় স্থাপনা আরো প্রায় পাঁচটি আমরা নির্মাণ করতে পারি তিন দশকে ব্যাংকগুলো থেকে প্রভাবশালীদের খেলাপি ঋণের সমপরিমাণ টাকায়।
তাদের মধ্যে একটা অংশ ‘ইচ্ছাকৃত’ভাবেই ঋণখেলাপি হয়েছে। তারা পরিকল্পিতভাবে প্রথম থেকেই এমন কৌশল গ্রহণ করেন, যাতে তাদের ঋণ পরিশোধ করতে না হয়। বিভিন্ন সরকারের আমলে ক্ষমতাশালী দুর্নীতিগ্রস্ত পক্ষ তাদেরকে রক্ষা করে। কেন্দ্রীয় ব্যাংক তাদের সুযোগ-সুবিধার দিকে লক্ষ্য রেখে নানা নীতিমালা তৈরি করে। ফলে ব্যাংকগুলো হয়ে উঠেছে তাদের কাছে শুধুই টাকা উৎপাদনের যন্ত্র। গত ৩২ বছরে প্রভাবশালী ঋণ খেলাপিদের মধ্যে অন্তত ৩২ জনকেও জেলের ভাত খেতে হয়নি।
সরকারি, বা বেসরকারি যে ব্যাংক থেকে ঋণ নেওয়া হোক না কেন, ঋণের অর্থ ফেরত দিতে হয়। এটা প্রভাবশালী থেকে শুরু করে প্রান্তিক কৃষকদের বেলায়ও সত্য। ঋণ আদায়ে শুধু খেটেখুটে খাওয়া অসহায় কৃষককে কারাগারে যেতে হলে আইনের সমতা নিয়ে যে প্রশ্ন আছে, তা থেকেই যাবে। অর্থনীতিতে কৃষিখাতের উল্লেখযোগ্য অবদান বরাবরই আমাদেরকে অনুপ্রাণিত করে। কৃষকরাই এর প্রাণ।
গরিব কৃষক ব্যাংক থেকে সামান্য ঋণ নিয়ে নির্ধারিত সময়ে পরিশোধ করতে না পারলে যৌক্তিক কারণ অনুসন্ধান করে পরিশোধের সময় বাড়াতে পারে ব্যাংক। প্রাকৃতিক দুর্যোগে ফসলের ক্ষতি হওয়া, বা অন্য প্রয়োজনে বিশেষ বিবেচনায় কৃষকের ঋণ মওকুফও করা যেতে পারে। প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার নেতৃত্বের কৃষিবান্ধব সরকারের আমলে এ ছাড় কৃষকরা পেতেই পারেন।
অতীতের বিভিন্ন সময় আমরা দেখেছি, প্রভাবশালী খেলাপিরা ঋণ পরিশোধ না করে বিভিন্ন সুবিধা আদায় করে নিয়েছেন। তারা ঋণ পুনঃতফসিল, ঋণ অবলোপন ইত্যাদির মাধ্যমে ঋণখেলাপির দায় থেকে মুক্ত থেকেছেন।
ঈশ্বরদীর গ্রেপ্তার ১২ কৃষকের দাবি, ঋণ ‘শোধ’ করার পরও তাদেরকে গ্রেপ্তার করা হয়েছে। আমরা বিষয়টি খতিয়ে দেখতে সংশ্লিষ্টদের কাছে দাবি জানাচ্ছি। একই সঙ্গে মত ও পথ ওই কৃষকদের নি:শর্ত মুক্তির দাবি জানাচ্ছে। আমরা মনে, করি ধরা ছোঁয়ার বাইরে থাকা প্রভাবশালী ঋণ খেলাপিদেরকে ধরার এখনই সময়।