বিএনপির মরা গাঙে জোয়ার!

অজয় দাশগুপ্ত

১৯১৭ সালে রাশিয়ার সমাজতান্ত্রিক বিপ্লবের নেতা ভ্লাদিমির ইলিস লেনিন বিপ্লবের প্রস্তুতি পর্যায়ে একটি বই লিখেছিলেন, শিরোনাম ছিল- ‘এক পা আগে, দুই পা পিছে’। বিপ্লবের প্রয়োজনে নানা কৌশল গ্রহণ করতে হয়, সব সময় সরল রেখায় আগানো যায় না। বাংলাদেশ জাতীয়তাবাদী দল বা বিএনপি কি ২০২২ সালের ১০ ডিসেম্বর তাদের ঢাকা সমাবেশকে কেন্দ্র করে একই কৌশল গ্রহণ করেছে? না-কি পিছু হটেছে?

২০০৬ সালের অক্টোবর মাসের শেষ দিকে বিএনপি আওয়ামী লীগ ও তার মিত্রদের প্রবল আন্দোলনের মুখে বাংলাদেশের রাষ্ট্রক্ষমতা ছেড়ে দিতে বাধ্য হয়েছিল। এর পর ১৫ বছরের বেশি চলে গেছে। এ সময়ের মধ্যে কেল ক্ষমতা হাত ছাড়া হয়নি, দলের দুই প্রধান নেতা খালেদা জিয়া  ও তারেক রহমান দণ্ডিত হয়েছেন দুর্নীতির দায়ে। মাঝে কয়েক দফা চেষ্টা করেছেন আন্দোলনের মাধ্যমে শেখ হাসিনার সরকারকে ক্ষমতা থেকে হটাতে। হুমকি দেওয়া হয়েছে। আল্টিমেটামও শুনেছি। ‘ঈদের পর সরকার পতনের আন্দোলন’- এমনটিও বলা হয়েছে। খালেদা জিয়া থেকে শুরু করে উঁচু-নিচু পর্যায়ের নেতারা এত বার এ বাক্য উচ্চারণ করেছেন যে এক পর্যায়ে তা কৌতুকে পরিণত হয়।

অতি সম্প্রতি বিএনপি বিভাগীয় পর্যায়ে সমাবেশ করছে। ১০ ডিসেম্বর ঢাকায় সমাবেশ করা হবে, এটাও বলা হয়। দলের মধ্যম সারির কয়েকজন নেতা বলতে থাকেন- ১০ ডিসেম্বরের পর আর শেখ হাসিনার সরকার ক্ষমতায় থাকবে না। ১৯৯০ সালে এইচ এম এরশাদ সরকারের পতনের আন্দোলনের প্রধান ছাত্রনেতা আমানউল্লাহ আমান গত ৮ অক্টোবর ঢাকায় এক অনুষ্ঠানে বলেন- ১০ ডিসেম্বরের পর দেশ চলবে খালেদা জিয়া ও তারেক রহমানের কথায়। তিনি এখন বিএনপির ঢাকা মহানগর উত্তর জেলা কমিটির শীর্ষ নেতা। পর দিন বিএনপির কেন্দ্রীয় প্রচার সম্পাদক ও ছাত্রদলের সাবেক সভাপতি শহীদ উদ্দীন চৌধুরী অ্যানি লক্ষীপুর জেলায় দলের সমাবেশে বলেন- শিগগির তারেক রহমান বাংলাদেশে ফিরে আসবেন। আরেক সমাবেশে দলের চেয়ারপারসনের উপদেষ্টা জয়নুল আবদিন ফারুক বলেন, ১০ ডিসেম্বর ঢাকায় সমাবেশ হবে আটলান্টিক মহাসাগরের মতো। এই সমাবেশে খালেদা জিয়া যাবেন।

আমানউল্লাহ আমানের বক্তব্য সমর্থন করে বিএনপির মহাসচিব মির্জা ফকরুল ইসলাম আলমগীর বলেছিলেন- আমানউল্লাহ আমানের সামান্য ধমকেই শেখ হাসিনার সরকার ও আওয়ামী লীগ ভয় পেয়েছে। তারা ঘাবড়ে গিয়ে উল্টা-পাল্টা বলতে শুরু করেছে।

র‌্যাবের ওপর যুক্তরাষ্ট্রের কিছু নিষেধাজ্ঞা এবং ঢাকায় অবস্থানরত কয়েকজন বিদেশী কূটনীতিক বাংলাদেশের রাজনীতি ও নির্বাচন নিয়ে সরব হওয়ার পর থেকে বিএনপির মরা গাঙে যেন জোয়ার এসেছে। তারা বেশ চার্জড! বিভাগীয় সমাবেশগুলোতে দলের নেতা-কর্মীরা বাধা-বিঘ্ন ডিঙিয়ে বিপুল সংখ্যায় উপস্থিত হওয়ার পর ঢাকার সমাবেশ নিয়ে উৎসাহ বাড়াটাই স্বভাবিক।

অন্যদিকে, আওয়ামী লীগ পোড় খাওয়া রাজনৈতিক দল। তারা ২০১৩ সালের মে মাসের প্রথম সপ্তাহে হেফাজতে ইসলামের সমাবেশ দেখেছে। ১৩ দফা দাবিতে এ সমাবেশ ডাকা হয়েছিল, যার অন্যতম দাবি ছিল নারীরা শিক্ষা প্রতিষ্ঠান ও অফিস-কারখানায় কাজ করতে যেতে পারবে না। [আফগানিস্তানে তালেবান শাসকরা এখন যা করছে] ব্লাসফেমি আইন জারি করতে হবে। এ দাবিতে ডাকা সমাবেশ চলাকালে খালেদা জিয়া দলের নেতা-কর্মীদের আবেদন জানিয়েছিলেন, শাপলা চত্বরের সমাবেশে দলে দলে যোগ দিয়ে শেখ হাসিনার সরকারের পতন ঘটানোর জন্য। আরেক বার ঢাকায় মুক্তিযোদ্ধা সমাবেশের নামে বিএনপি রাজপথ দখলের চেষ্টা করেছিল। কিন্তু আইন শৃঙ্খলা বাহিনী এ দুটি চেষ্টা ব্যর্থ করে দিয়েছিল।

১০ ডিসেম্বর কি এমন কিছু ভেবেছিল বিএনপি? আওয়ামী লীগ রাজপথ দখলে রাখার কৌশল ভাল করেই জানে। ১৯৯৬ সালে দলটি জাতীয় প্রেস ক্লাবের সামনে টানা কয়েকদিন জনতার মঞ্চ গঠন করে খালেদা জিয়াকে ষষ্ঠ জাতীয় সংসদ (১৯৯৬ সালের ১৫ ফেব্রুয়ারি প্রহসনের নির্বাচনের মাধ্যমে গঠিত) বাতিল করতে বাধ্য করেছিল। ২০০৬ সালের অক্টোবর মাসের শেষ দিকে শেখ হাসিনার আহ্বানে দলের নেতা-কর্মীরা ‘লগি-বৈঠা’ আন্দোলন সফল করে। খালেদা জিয়া তখন পুলিশ-বিডিআর দিয়ে আন্দোলন দমন করতে পারেননি। তাঁর দলের নেতা-কর্মীরাও মাঠে ছিল। আর সর্বশক্তি দিয়ে মাঠে ছিল জামায়াতে ইসলামী। কিন্তু আওয়ামী লীগের সঙ্গে পেরে ওঠেনি। এখন বিএনপি বলছে- পুলিশ ছাড়া মাঠে আসুক, দেখি কে হারে কে জেতে। কিন্তু আওয়ামী লীগ ১৯৯৬ ও ২০০৬ সালে পুলিশ ছাড়াই রাজপথ দখলে নিতে পেরেছিল। এখন বিএনপি কি সেটা পারবে? আওয়ামী লীগ বিএনপির হুমকির মুখে হাত গুটিয়ে বসে না থেকে পাল্টা হুমকি দিয়েছে। তারা বলছে- দেখা যাবে, কার কত শক্তি। এখন বিএনপি নেতারা বলছেন- ১০ ডিসেম্বর ঢাকায় কেবল বিভাগীয় সমাবেশ হবে, সরকার পতন ঘটানোর কোন ইচ্ছে নেই।

রাজনৈতিক বিশ্লেষকরা বলতে শুরু করেছেন- বিএনপি কি পিছু হটছে, নাকি কৌশলগত অবস্থান নিয়েছে?

অতি সম্প্রতি কয়েকটি বিদেশী দূতাবাসের শীর্ষ কূটনীতিকরা বিএনপি চেয়ারপারসনের অফিসে গিয়ে রুদ্ধদ্বার বৈঠক করেছেন। তারা কি বলেছেন, কোন তরফে প্রকাশ করা হয়নি। কেউ কেউ বলছেন- এ সব কূটনীতিকদের অনুরোধ কিংবা চাপেই বিএনপির সুর নরম হয়েছে। যদি এমনটি ঘটে থাকে, বিএনপির জন্য লজ্জার। তারা একদিকে চাইছে যে ‘প্রভাবশালী দেশগুলোর’ কূটনীতিকরা শেখ হাসিনার ওপর চাপ প্রয়োগ করে তত্ত্বাবধায়ক সরকার কিংবা নির্বাচনকালীন নিরপেক্ষ সরকারের দাবি মেনে নিতে বাধ্য করুক। এ ধরনের কিছু কথা কূটনীতিকদের কেউ কেউ বলতে শুরু করায় বিএনপিকে দেখেছি দারুণ উল্লসিত।

কিন্তু সরকার ও আওয়ামী লীগের তরফে ‘১০ ডিসেম্বর কিছু ঘটবে না’ কিংবা ঘটতে দেওয়া হবে না বলতে শুরু করায় তারা পিছু হটল। বিদেশী কূটনীতিরা ‘নিজের দৌড় বা ক্ষমতা বোঝার’ জন্য কি বিএনপিকে বার্তা দিয়েছেন?

বিএনপির মহাসচিব প্রথমে বলেছিলেন, আমানউল্লাহ আমান সরকারকে ভয় পাইয়ে দিয়েছেন। তাঁর এ বক্তব্যে প্রশ্ন উঠেছিল- ১০ ডিসেম্বর কীভাবে খালেদা জিয়া ক্ষমতায় বসবেন? তিনি নির্বাচনে জয়ী হননি। এমনকি দুর্নীতির মামলায় দণ্ডিত হওয়ায় নির্বাচনে প্রার্থী হওয়ার যোগ্যতাও নেই তাঁর। তারেক রহমান নির্বাসিত জীবনযাপন করছেন। তিনি বাংলাদেশের আইনে দণ্ডিত। যুক্তরাষ্ট্রের আইনেও অপরাধী। তিনি কীভাবে বাংলাদেশ পরিচালনা করবেন? তাহলে কি জিয়াউর রহমান ১৯৭৫ সালের ১৫ আগস্টের পর যে অবৈধ পন্থায় ক্ষমতা দখল করেছিলেন, খালেদা জিয়া তেমন কিছু ভাবছেন? জিয়াউর রহমান গভীর রাতে এইচ এম এরশাদসহ কয়েকজন সেনা অফিসার নিয়ে তার হাতে প্রধান সামরিক আইন প্রশাসকের ক্ষমতা ছেড়ে দিতে বাধ্য করেছিলেন- এটা বিচারপতি আবু সাদাত মোহাম্মদ সায়েম তার ‘বঙ্গভবনের শেষ দিনগুলি’ বইয়ে লিখেছেন।

এ ঘটনার নির্ভরযোগ্য বিবরণ রয়েছে ‘বাংলাদেশ: রক্তের ঋণ’ গ্রন্থে। এ গ্রন্থে অ্যান্থনী মাসকারেণহাস লিখেছেন- ‘জিয়া ২৮ নভেম্বর (১৯৭৬) সিদ্ধান্ত নেন- প্রেসিডেন্ট সায়েমকে একসঙ্গে রাষ্ট্রপতি ও প্রধান সামরিক আইন প্রশাসকের দায়িত্বে রাখা তাঁর জন্য বিপজ্জনক। তিনি  ডেপুটি চীফ অব আর্মি স্টাফ জেনারেল এইচ এম এরশাদ, চীফ অব স্টাফ জেনারেল আবুল মঞ্জুর, নবম ডিভিশনের কমান্ডার জেনারেল মীর শওকত আলী, নৌ ও বিমান বাহিনীর প্রধান এবং রাষ্ট্র্রপতির বিশেষ সহকারী বিচারপতি আবদুস সাত্তারকে নিয়ে বঙ্গভবনে গিয়ে প্রধান সামরিক আইন প্রশাসকের পদটি তার কাছে ছেড়ে দিতে বলেন। রাষ্ট্রপতি সায়েম এতে রাজী ছিলেন না। এক পর্যায়ে বিচারপতি সাত্তার বলেন- ভাই, জিয়া যখন সিএমএলএ পদটি চাইছে, পদটি আপনি তাকে দিয়ে দিন। রাত ১ টার দিকে বিচারপতি সায়েম প্রধান সামরিক আইন প্রশাসকের পদ হস্তান্তরের কাগজে সই করেন।’ [পৃষ্ঠা ১৫৫-১৫৬]

বিচারপতি আবু সাদাত মোহাম্মদ সায়েম ‘বঙ্গভবনে শেষ দিনগুলি’ গ্রন্থে বেদনা ও ক্ষোভের সঙ্গে লিখেছেন, ‘আমি প্রধান সামরিক আইন প্রশাসকের পদ ছেড়ে দিই উপপ্রধান সামরিক আইন প্রশাসক জিয়াউর রহমানের হাতে। ১৯৭৭ সালের ২১ এপ্রিল তার হাতেই ছেড়ে দিই রাষ্ট্রপতির পদ।’ [পৃষ্ঠা ৩৫]

মির্জা ফকরুল ইসলাম বলেছেন- তারেক রহমান সাহেব চাইছেন, বর্তমানে শেখ হাসিনার সরকারের বিরুদ্ধে যারা আন্দোলন করছে, তাদের সবাইকে নিয়ে নির্বাচনের পর সরকার গঠন করা হবে। স্পষ্ট যে নির্বাচিত হোক বা না হোক, আওয়ামী লীগ বিরোধী সকলকে নিয়েই বিএনপি সরকার গঠন করতে চায়। আমরা জানি, আওয়ামী লীগের বিরুদ্ধে রয়েছে বাংলাদেশের স্বাধীনতা মানে না, এমন নানা অপশক্তি। জামায়াতে ইসলামী ১৯৭১ সালে পাকিস্তানি হানাদার বাহিনীর সঙ্গে গণহত্যা, ধর্ষণ ও লুটপাটে অংশ নিয়েছিল। এ অপরাধে দলের কয়েকজন শীর্ষনেতার শাস্তি হয়। এই দলটি শেখ হাসিনার সরকার উৎখাতের জন্য নানাভাবে সক্রিয়। যেমন সক্রিয় কয়েকটি ধর্মীয় চরমপন্থী গোষ্ঠী, যারা সশস্ত্র পন্থায় শেখ হাসিনাকে হটাতে চাইছে। বিএনপি ক্ষমতায় থাকার সময় এসব গোষ্ঠীকে মদদ দিয়েছে। শক্তি সঞ্চয়ে সাহায্য করেছে। তাদের আফগানিস্তান পাঠিয়েছে তালেবানি গোষ্ঠীর কাছ থেকে প্রশিক্ষণ পেতে। ১০ ডিসেম্বর এরাই কি খালেদা জিয়াকে ক্ষমতায় আনতে তৎপর? এ ধারণা ঠিক হলে বলতে হবে- বিএনপির ঢাকা দখল করে শেখ হাসিনার পতন ঘটানোর বিষয়টি গুরুত্বের সঙ্গে গ্রহণ করে আওয়ামী লীগ ভুল করেনি।

লেখক: বীর মুক্তিযোদ্ধা, একুশে পদকপ্রাপ্ত সাংবদিক

শেয়ার করুন