বিএনপির ১০ ডিসেম্বরের সমাবেশকে কেন্দ্র করে যেকোনো পরিস্থিতি মোকাবিলায় ও ঢাকাবাসীর জান-মাল রক্ষায় রাজধানীতে মোতায়েন থাকবেন ঢাকা মেট্রোপলিটন পুলিশ (ডিএমপি) পুলিশের ৩০ হাজার সদস্য। এছাড়া প্রয়োজনে ঢাকার বাইরে থেকে আরও ১০ থেকে ১৫ হাজার পুলিশ সদস্য আনা হতে পারে বলে জানিয়েছে ডিএমপি। ইউনিফরমে ও সাদা পোশাকে মোতায়েন থাকবেন তারা।
এরইমধ্যে দুই সপ্তাহের জন্য ছুটি বাতিল করা হয়েছে ডিএমপিতে কর্মরত সদস্যদের। এরই পরিপ্রেক্ষিতে যেকোনো নৈরাজ্য ও অপ্রীতিকর ঘটনা এড়াতে সর্বোচ্চ নিরাপত্তামূলক প্রস্তুতি নিচ্ছে ডিএমপি। বাড়ানো হয়েছে গোয়েন্দা তৎপরতা। নিরাপত্তা ব্যবস্থার ছক সাজাতে ঊর্ধ্বতন পুলিশ কর্মকর্তারা একাধিক বৈঠক করেছেন। সেখানে কেউ কেউ সংঘাতের আশঙ্কার কথাও তুলে ধরেছেন।
নাশকতার পুরোনো মামলার আসামিদের ওপর রাখা হচ্ছে বাড়তি নজরদারি। তালিকা অনুযায়ী তাদের গতিবিধি পর্যবেক্ষণ করা হচ্ছে। এছাড়া গ্রেফতারি পরোয়ানাভুক্ত আসামিদের ধরতে মাঠপর্যায়ের পুলিশ সদস্যদের দেওয়া হয়েছে নির্দেশনা। এরই মধ্যে সারাদেশে গ্রেফতারের সংখ্যাও বাড়ছে। ঢাকা ও ঢাকার বাইরে প্রতিদিন পরোয়ানাভুক্ত আসামিরা গ্রেফতার হচ্ছে। এ পটভূমিতে জনমনে দেখা দিয়েছে প্রশ্ন- আসলে কী ঘটবে ১০ ডিসেম্বর?
অন্যদিকে, বিএনপি রাজধানীর সোহরাওয়ার্দী উদ্যানে ১০ ডিসেম্বর মহাসমাবেশের অনুমতি পেলেও দলটি এখন পর্যন্ত নয়াপল্টনে সমাবেশ করার সিদ্ধান্ত জানিয়েছে। তবে গতকাল সোমবার এক সংবাদ সম্মেলনে বিএনপির স্থায়ী কমিটির সদস্য মির্জা আব্বাস বলেছেন, প্রশাসন চাইলে পছন্দের জায়গার বিকল্প নাম দেবে বিএনপি।
ডিএমপি জানিয়েছে, আগামী ১০ ডিসেম্বর বিএনপি চাইলে টঙ্গীতে বিশ্ব ইজতেমার মাঠে অথবা পূর্বাচলে আন্তর্জাতিক বাণিজ্য মেলার মাঠে সমাবেশ করতে পারে। এ ক্ষেত্রে ডিএমপির পক্ষ থেকে কোনো আপত্তি থাকবে না। পুলিশের পক্ষ থেকে আগামী ১০ ডিসেম্বর সোহরাওয়ার্দী উদ্যানে অনুমতি দেওয়া হয়েছে। অনুমতি দেওয়ার পরেও ডিএমপি কমিশনারের সঙ্গে তারা দেখা করে বিকল্প ভেন্যুর প্রস্তাব নিয়ে এসেছিলেন। বিএনপির পক্ষ থেকে আরামবাগে বিকল্প ভেন্যুর জন্য মতিঝিল বিভাগের ডিসির কাছে প্রস্তাব দেওয়া হয়। প্রস্তাবটি আনুষ্ঠানিকভাবে ডিএমপি কমিশনারের কাছে আসেনি।
পুলিশ বলছে, এখনো ভেন্যু নিশ্চিত না হওয়ায় সঠিকভাবে পুলিশ মোতায়েনের সংখ্যা বলা যাচ্ছে না। তবে ডিএমপির পক্ষ থেকে সমাবেশের আগাম কিছু তথ্য বিশ্লেষণ করে দক্ষ ও অভিজ্ঞতাসম্পন্ন পুলিশ সদস্য বাছাই করা হয়েছে। ডিএমপিতে ৩২ হাজার সদস্য কর্মরত। এর বাইরেও প্রয়োজন হলে আরও ১০-১৫ হাজার সদস্য আনা হবে।
একাধিক কর্মকর্তা বলেছেন, ২০১৩ সালে সমাবেশ করার অনুমতি দেওয়ার পর হেফাজতে ইসলামের ঘটনা মাথায় রেখেই পরিকল্পনা সাজাচ্ছে পুলিশ। ওইদিন যেমন তারা রাস্তায় বসে পড়েছিল, বিএনপি যদি লোকসমাগম দেখে এমন কিছু করার চিন্তা করে, তাহলে কম সময়ের মধ্যে কীভাবে সরিয়ে দেওয়া যায়, তা নিয়ে বিভিন্ন বাহিনীর সঙ্গে আলোচনা হয়েছে। এ জন্য ডিএমপির ৩২ হাজার লোকবল সতর্ক থাকার নির্দেশনা দিয়েছেন কমিশনার। সমাবেশের আগে এবং পরে রাজধানীর হোটেল, মেসসহ বিভিন্ন স্থানে ধারাবাহিক তল্লাশি চালাবে পুলিশ।
উপ-পুলিশ কমিশনার পদমর্যাদার ডিএমপির এক কর্মকর্তা জানান, আগামী চার-পাঁচদিন সর্বোচ্চ সতর্ক থাকতে বলা হয়েছে। বিশেষ করে রাজধানীর বিভিন্ন আবাসিক হোটেলে কারা উঠছেন, কারা যাচ্ছেন, কোন সড়কে কী ঘটছে- এসব নজরদারিতে রাখতে বলা হয়েছে। রাজধানীর প্রতিটি সড়কে বিশেষ করে রাতের বেলায় চেকপোস্ট বসিয়ে গাড়ি তল্লাশি করতে বলা হয়েছে। কাউকে সন্দেহজনক মনে হলে গ্রেফতার করতেও বলা হয়েছে মৌখিক নির্দেশনায়।
এদিকে রাজধানীতে পুলিশের বিশেষ অভিযানের ষষ্ঠ দিনে আরও ২৮৫ জন গ্রেফতার করা হয়েছে। সুনির্দিষ্ট অভিযোগের ভিত্তিতে তাদের গ্রেফতার করা হয়েছে বলে দাবি পুলিশের। বৃহস্পতিবার (১ ডিসেম্বর) থেকে বিশেষ এ অভিযান শুরু হয়। মঙ্গলবার (৬ ডিসেম্বর) পর্যন্ত শুধু ঢাকায়ই এ অভিযানে গ্রেফতার হয়েছেন এক হাজার ১২ জন।
ডিএমপির মিডিয়া অ্যান্ড পাবলিক রিলেশনস বিভাগের উপ-পুলিশ কমিশনার (ডিসি) মো. ফারুক হোসেন গণমাধ্যমকে বলেন, ‘২০ নভেম্বর ঢাকার সিএমএম আদালতে পুলিশের কাছ থেকে দণ্ডপ্রাপ্ত দুই আসামি ছিনিয়ে নেওয়ার প্রেক্ষাপট বিবেচনা ও মহান বিজয় দিবস, বড়দিন এবং থার্টি ফাস্র্ট নাইট উদযাপন নিরাপদ ও নির্বিঘ্ন করার লক্ষ্যে চলমান অভিযানের পাশাপাশি ১-১৫ ডিসেম্বর বিশেষ অভিযান পরিচালনার নির্দেশ দেয় পুলিশ সদরদপ্তর।’
ডিসি ফারুক আরও বলেন, ওই নির্দেশনা মোতাবেক ডিএমপির ৫০টি থানা ও মহানগর গোয়েন্দা (ডিবি) পুলিশের হাতে বিশেষ অভিযানে একদিনে (ষষ্ঠদিন) গ্রেফতার হয়েছেন ২৮৫ জন আসামি। গ্রেফতারদের মধ্যে অনেকে পরোয়ানাভুক্ত আসামি। এছাড়া মাদক, দণ্ডপ্রাপ্ত, অস্ত্রধারী সন্ত্রাসী, চোর, ছিনতাইকারীসহ নানা অপরাধে জড়িত থাকার অভিযোগে তাদের গ্রেফতার করা হয়।
তিনি জানান, গ্রেফতারদের বিরুদ্ধে সংশ্লিষ্ট থানায় মামলা হয়েছে। এসব মামলায় রিমান্ড আবেদন করে আসামিদের আদালতে হাজির করা হবে।
পুলিশের আরেক উচ্চপদস্থ কর্মকর্তা জানান, ২৬ শর্ত দিয়ে সোহরাওয়ার্দী উদ্যানে সমাবেশ করার অনুমতি দিয়ে বিএনপিকে যে চিঠি দেওয়া হয়েছে, সেটার উত্তর এখনও পাওয়া যায়নি। ঢাকার বাইরে যেসব এলাকায় বিএনপি বিভাগীয় সমাবেশ এরই মধ্যে শেষ করেছে, তাদের সব কটির ভেন্যু ছিল কোনো না কোনো উন্মুক্ত খোলা মাঠ। ঢাকার বাইরেও কোনো এলাকায় রাস্তার ওপর তাদের সমাবেশ করার অনুমতি দেওয়া হয়নি। ঢাকার ১০ ডিসেম্বরের সমাবেশে কয়েক লাখ লোক জড়ো করার ঘোষণা দিয়েছে বিএনপি। নয়াপল্টনের মতো একটি ব্যস্ত এলাকার রাস্তায় জনদুর্ভোগ সৃষ্টি করে পুলিশ বিএনপিকে সমাবেশ করার অনুমতি দেবে না।
র্যাবের লিগ্যাল অ্যান্ড মিডিয়া উইংয়ের পরিচালক কমান্ডার খন্দকার আল মঈন বলেন, আগামী ১০ ডিসেম্বর রাজধানীতে ঢাকা বিভাগীয় গণসমাবেশ করবে বিএনপি। এই সমাবেশ ঘিরে উদ্ভূত যেকোনো ধরনের পরিস্থিতি মোকাবিলায় প্রস্তুত র্যাপিড অ্যাকশন ব্যাটালিয়ন (র্যাব)। র্যাবের সঙ্গে প্রস্তুত বোম্ব ডিসপোজাল ইউনিট, স্পেশাল ফোর্স, স্পেশাল ডগ স্কোয়াড ও হেলিকপ্টার ইউনিট। নাশকতার পরিস্থিতি যাতে তৈরি না হয়, সেজন্য সাদা পোশাকে থাকবে র্যাবের গোয়েন্দা সদস্যরা।
তিনি বলেন, বাংলাদেশে বর্তমানে সুষ্ঠু-স্বাভাবিক রাজনৈতিক অবস্থা বিরাজ করছে। সরকারি ও বিরোধীদল পালন করছে তাদের রাজনৈতিক কর্মসূচি। র্যাব সাধারণত জঙ্গি দমন, মাদক কারবারি, অস্ত্রধারী ও ওয়ারেন্টভুক্ত আসামিদের গ্রেফতারে আস্থা অর্জন করেছে। সাইবার ওয়ার্ল্ডে কেউ উসকানিমূলক বক্তব্য দিয়ে নাশকতা সৃষ্টির চেষ্টা করছে কি না সেটিও নজরদারিতে রাখা হয়েছে।