ফারদিনের মৃত্যু: ডিবি-র‌্যাবের তথ্যে ‘সন্তুষ্ট’ বুয়েটশিক্ষার্থীরা

বিশ্ববিদ্যালয় প্রতিবেদক

বুয়েটছাত্র ফারদিন নূর পরশের মৃত্যু নিয়ে ঢাকা মহানগর গোয়েন্দা (ডিবি) পুলিশ ও র‌্যাব যেসব তথ্যপ্রমাণ দেখিয়েছে, তাতে সন্তুষ্টি প্রকাশ করেছেন বিশ্ববিদ্যালয়টির শিক্ষার্থীরা। এজন্য তারা পূর্বঘোষিত কর্মসূচিও স্থগিত করেছেন।

শনিবার (১৭ ডিসেম্বর) সন্ধ্যায় বুয়েটের কেন্দ্রীয় শহীদ মিনারে সংবাদ সম্মেলন করে এ কথা জানান শিক্ষার্থীরা। একইসঙ্গে ফারদিনের মৃত্যুর ইস্যু নিয়ে নতুন করে যে কর্মসূচি তারা ঘোষণা করেছিলেন, তা আপাতত স্থগিত রাখার কথা জানান।

বুয়েটশিক্ষার্থীরা বলেন, আমরা তাদের (ডিবি ও র‌্যাব) সঙ্গে সাক্ষাৎকারের সময় মূলত পাঁচটি বিষয়ে প্রশ্ন তুলি। তাদের দেখানো এভিডেন্স এবং ডাটার মধ্যে আমাদের করা প্রশ্নগুলোর মোটামুটি সন্তোষজনক উত্তর পেয়েছি। তাদের তদন্ত বা যা যা ডাটা দেখিয়েছেন, এতে আর সন্দেহ করার মতো তথ্য আমাদের কাছে নেই। ভবিষ্যতে যদি নতুন করে কোনো তথ্য সামনে আসে, তখন বিষয়টি নিয়ে আবার কথা বলবো।’

শিক্ষার্থীরা বলেন, আপাতত ফারদিনের মৃত্যুর বিষয়ে তাদের আর কোনো কর্মসূচি নেই। তবে ফারদিনের পরিবার যৌক্তিক কোনো দাবিতে যদি কোনো কিছু করে, তাহলে শিক্ষার্থীরা তাদের পাশে দাঁড়াবো।

সংবাদ সম্মেলনে শিক্ষার্থীরা বলেন, বুধবার যখন ডিবি বলেছিল, এটি আত্মহত্যা। তখন আমরা বলেছিলাম, এটি কোনোভাবেই বিশ্বাসযোগ্য নয়। এতদিন হত্যাকাণ্ড বলে এখন আত্মহত্যা বলাটা আমাদের কাছে কোনোভাবেই যৌক্তিক মনে হচ্ছিল না। ১৪ তারিখ ডিবির মন্তব্য আসার পর, বুয়েটের ছাত্রকল্যাণ পরিদপ্তর থেকে বলা হয়, প্রতিবাদ কর্মসূচিতে যাওয়ার আগে যেন ডিবিকে জানানো হয়। তাদের সঙ্গে যেন আমরা বসি এবং তথ্যপ্রমাণাদি দেখে নিই।

তারা আরও বলেন, পরে ডিবির সঙ্গে বৈঠক করতে আমাদের একটি দল মিন্টো রোডের ডিবি অফিসে যায়। ওই সময় ডিবির কাছে পাঁচটি প্রশ্ন করা হয়। ডিবির কাছে করা প্রথম প্রশ্ন ছিল- ময়নাতদন্তের পর ডাক্তার জানিয়েছিলেন, ফারদিনের বুকে ও মাথায় অসংখ্য আঘাতের চিহ্ন ছিল। তবে এখন কীভাবে আত্মহত্যার আলাপ আসলো?

‘প্রশ্নের উত্তরে ডিবি জানায়, ডাক্তারের সঙ্গে তারা কথা বলেছেন। ডাক্তার তাদের বলেছেন, এ আঘাতের ধরনটা অনেকটা কিল-ঘুষির মতো। এখানে কোনো কাটাছেঁড়ার বিষয় ছিল না। বেশিরভাগ ক্ষেত্রে এটা ছিল রক্তজমাট বাঁধার মতো। জামা-কাপড় ছিঁড়ে যায়নি। ডাক্তার বলেন, ওপর থেকে লাফ দেওয়া হয় যদি, তবে স্রোতের ধাক্কায় স্প্যানে ধাক্কা খেয়ে কিংবা পানিতে লাফ দেওয়ার কারণেও এ ধরনের আঘাতের চিহ্ন আসতে পারে। সুতরাং ওই চিহ্নের ওপর ভিত্তি করে ডাক্তারও বলছেন যে, এটা যে আত্মহত্যা নয়, তা শতভাগ নিশ্চিত হয়ে বলা যায় না।’

ডিবির কাছে করা তাদের দ্বিতীয় প্রশ্ন ছিল- সিসিটিভি ফুটেজ থেকে ডিবি যে দাবি করছিল, সেই লোকটাই ফারদিন। এর ভিত্তি কোথায়?

জবাবে ডিবি জানায়, ফারদিনের শেষ কন্টাক্ট পাওয়া গেছে, যাত্রাবাড়ী থেকে লেগুনায় উঠতে দেখা যায় তাকে। সেই লেগুনা তাকে তারাবোর দিকে অর্থাৎ সুলতানা কামাল ব্রিজের অপজিট পাশে নামিয়ে দেয়। ফারদিনের লোকেশন, ওই লেগুনা ড্রাইভারের লোকেশন- এগুলো ক্রসচেক করে ডিবি প্রমাণ পেয়েছে যে, বিষয়টি সত্য। ফারদিন যে জায়গা থেকে লাফ দেয়, সেই জায়গা থেকেই তার লোকেশন ট্র‍্যাক করা হয়। ডিবি মনে করছে, ওই একই সময়ে, একই জায়গা থেকে অন্য একজনের লাফ দেওয়ার সম্ভাবনা খুবই ক্ষীণ। এছাড়া ওই সময়ের পরই ফারদিনের মোবাইল বন্ধ হয়ে যায়। এর ১৫-২০ মিনিট পর ফারদিনের হাতঘড়িও (স্মার্টওয়াচ) বন্ধ হয়ে যায়।

ডিবির কাছে করা শিক্ষার্থীদের তৃতীয় প্রশ্ন ছিল- ফারদিন যে সেদিন বিভিন্ন জায়গায় ঘুরে বেড়িয়েছিলেন, তার কোনো সলিড প্রমাণ আছে কি না?

জবাবে ডিবি জানায়, ওইদিন রাত ১০টা ৪৫ থেকে ১১টা ৯ মিনিট পর্যন্ত বুয়েটের একজন শিক্ষার্থীর সঙ্গে ফারদিনের কথা হয়। সেই কথোপকথনের সময় ফারদিনকে সম্পূর্ণ স্বাভাবিক বলে মনে হয়েছে। ট্র‍্যাক করা তথ্য বলছে, ওই সময় ফারদিন ছিল জনসন রোডে। অর্থাৎ ঢাকার বিভিন্ন জায়গায় ঘুরে বেড়ানোর যে ট্র‍্যাকটা আমরা দেখেছি, ওই সময়টার মধ্যেই সেটি ছিল। ঘুরতে ঘুরতেই সে ফোনে কথা বলেছে এবং কথার মধ্যে কোনো অস্বাভাবিক কিছু পাওয়া যায়নি। এরপর ১টা ৫৭ মিনিট থেকে ১টা ৫৯ মিনিট পর্যন্ত তার একজন বন্ধুর সঙ্গে মেসেঞ্জারে কথা হয়। সেই বন্ধুর চ্যাট দেখে সেখানেও অস্বাভাবিক কিছু পাওয়া যায়নি।

শিক্ষার্থীদের চতুর্থ প্রশ্ন ছিল- লেগুনা ড্রাইভার কতদিন আগে ফারদিনকে নামিয়ে দিয়েছিলেন, তা সে কীভাবে মনে রেখেছে?

উত্তরে ডিবি জানায়, ওই লেগুনা ড্রাইভারকে আটকের আগে পুলিশ তাকে নজরদারির মধ্যে রেখেছিল। প্রথমত, তার মধ্যে কোনো অস্বাভাবিক আচরণ পাওয়া যায়নি। দ্বিতীয়ত, আটকের পর লেগুনা ড্রাইভার ঠিক কতজন নিয়ে যাত্রা করেছিল, সে ব্যাপারে হুবহু কিছু বলতে পারেনি। কারণ ঘটনা অনেকদিন আগের। তবে তিনি বলেছেন, মোটামুটি ৫-৬ জন ছিল। তারাবোর ওইখানে অর্থাৎ ব্রিজের ওই পাড়ে বাজারের কাছে অল্পদূরত্বের দুটো ভিন্ন স্থানে দুজনকে নামিয়ে দেয়। ডিবির ধারণা, ওই দুইজনের একজন ফারদিন। এ কারণে লেগুনা ড্রাইভারের সাক্ষ্যকে তারা খুব বেশি একটা সন্দেহ করছে না। লেগুনা ড্রাইভারের কথার সঙ্গে টাইমিং পুরোপুরি মিলে গেছে।

ডিবির কাছে করা শিক্ষার্থীদের পঞ্চম ও সর্বশেষ প্রশ্ন ছিল- মাদক, চনপাড়া বস্তিসহ বিভিন্ন ঘটনা যে সামনে আসলো, এগুলোর ভিত্তি কী?

শিক্ষার্থীরা জানায়, তারা মূলত ডিবির কাছে এ পয়েন্টে প্রশ্ন করার সুযোগ পায়নি। কারণ এ বিষয়গুলো নিয়ে ডিবি থেকে আগে কিছু জানানো হয়নি। পরে র‍্যাবের কাছে যাওয়ার পর এগুলো নিয়ে প্রশ্ন করার সুযোগ হয়।

র‍্যাব জানায়, তারা যখন প্রথম তদন্ত করা শুরু করেন, তখন তিনটি জায়গা থেকে তদন্ত শুরু করেন। এক. পরিকল্পিত হত্যাকাণ্ড কি না, দুই. দুর্ঘটনাজনিত মৃত্যু কি না, তিন. আত্মহত্যা কি না। তদন্ত শুরু করার পর ফারদিনের রবি সিমের নম্বর ট্র‍্যাক করে যে এমন একটি সেলে তার লোকেশন কানেক্ট হওয়া যায়, যা মূলত চনপাড়ার বেশিরভাগ এলাকা এবং সুলতানা কামাল ব্রিজের অংশবিশেষ কাভার করে। ওইসবের ভিত্তিতে র‍্যাব চনপাড়া এলাকা টার্গেট করে। ওই সময় চনপাড়া থেকে অনেক সন্ত্রাসীরা এসে দাবি করে, তারা ফারদিনকে হত্যা করেছে। সেই জায়গা থেকে র‍্যাব তাদের আটক করে জিজ্ঞাসাবাদ করে। সেক্ষেত্রে র‍্যাব তদন্ত করে কিছু না পেলে সুলতানা কামাল ব্রিজ সংলগ্ন এলাকার দিকে ফোকাস করে।

সংবাদ সম্মেলন থেকে শিক্ষার্থীরা বলেন, আপাতত ফারদিনের মৃত্যুর বিষয়ে আমাদের আর কোনো কর্মসূচি নেই। তবে ফারদিনের পরিবার যদি যৌক্তিক কোনো দাবিতে কিছু করেন, আমরা তাদের পাশে দাঁড়াবো। তবে আমাদের কাছে এ বিষয়ে আর কোনো সন্দেহ বা প্রশ্ন করার মতো কোনো এলিমেন্ট নেই। ভবিষ্যতে যদি নতুন করে কোনো তথ্য আসে, তখন বিষয়টা নিয়ে আবার কথা বলবো।

শেয়ার করুন