২০২১ সালে ভারতের প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদির বাংলাদেশ সফরের বিরোধিতায় ধর্মীয় উগ্রপন্থী সংগঠন হেফাজতের বর্বর তাণ্ডব দেশ-বিদেশে নিন্দার জন্ম দেয়। বিশেষ করে, ব্রাহ্মণবাড়িয়া ও চট্টগ্রামের হাটহাজারীতে কাণ্ডের পর সরকার সংগঠনটির বিরুদ্ধে কঠোর অবস্থান নেয়। তা ‘নীতিগত’, না ‘কৌশলগত’- সেই প্রশ্ন তখন উঠে। কারণ, ২০১৩ সালে ‘জামায়াতের দাবি-দাওয়ার হেফাজতি সংস্করণ’ নিয়ে মধ্যযুগীয় বর্বরতার মধ্য দিয়ে হেফাজতের উত্থান ঘটে। একপর্যায়ে ক্ষমতাসীন আওয়ামী লীগ ও দলটির নেতৃত্বের সরকারের একাংশের সঙ্গে সংগঠনটির তথাকথিত ‘রাজনৈতিক কৌশলগত’ সম্পর্ক গড়ে উঠে।
অবশ্য নরেন্দ্র মোদির সফর ঘিরে হেফাজতের তাণ্ডবলীলা কেন্দ্র করে প্রশাসনের নেওয়া পদক্ষেপকে দেশের প্রগতিশীল সমাজ ‘সরকারের নীতিগত সিদ্ধান্ত’ বলে আখ্যায়িত করে। বঙ্গবন্ধুর ঘাতক ও একাত্তরের নরঘাতকদেরকে ফাঁসিতে ঝুুলানো ও মৌলবাদীদেরকে দমন-নির্মূলে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার সাহসেই বাংলাদেশ সাহসী। মৌলবাদ, মৌলবাদী ও সাম্প্রদায়িক গোষ্ঠীর বিরুদ্ধে তাঁর সরকারের নীতিগত অবস্থান বিশ্বজুড়ে স্পষ্ট।
জাতীয় সংসদ নির্বাচনের সময় ঘনিয়ে এলে কথিত ‘অরাজনৈতিক’ সংগঠন হেফাজতের নেতারা ‘জামায়াত-বিএনপির দাবি-দাওয়ার হেফাজতি সংস্করণ’ নিয়ে মাঠে নামেন। মাঠ গরম রাখেন, ভোটের রাজনীতিতে জামায়াত-বিএনপিকে সুবিধা করে দেন তারা। হেফাজতের ১৩ দফা দাবির প্রতিটি দফা জামায়াতের রাজনীতির উদ্দেশ্যের সঙ্গে মিলিয়ে দেখলে কোথাও পার্থক্য পাওয়া যায় না। ২০১৩ সালে যুদ্ধাপরাধী, জামায়াত নেতা কাদের মোল্লার মামলার রায় কেন্দ্র করে ঢাকার শাহবাগে গড়ে ওঠা গণজাগরণ মঞ্চের আন্দোলনের বিপক্ষে অবস্থান নিয়ে নিজেদের ভয়ংকর শক্তি প্রথম দেখায় হেফাজত।
দ্বাদশ সংসদ নির্বাচন সামনে রেখে হেফাজতের নেতারা গত ১৭ নভেম্বর প্রধানমন্ত্রীর সঙ্গে দেখা করে সাতদফা দাবি জানান। এর পরেরদিন স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী জানান, হেফাজতের ‘যৌক্তিক দাবিগুলো’ প্রধানমন্ত্রী অবশ্যই দেখবেন। প্রধানমন্ত্রী সবার। গণতান্ত্রিক দেশে যে কেউ যৌক্তিক দাবি সরকারপ্রধান, বা প্রধানমন্ত্রীর কাছে তুলে ধরতে পারেন। সংবিধানে ঘোষিত মূল নীতি বাতিল করার মতো না হলে সরকার সে দাবি পূরণ করে থাকে। গণতান্ত্রিক রাষ্ট্রে এটা খুব পরিচিত দৃশ্য।
হেফাজতের নতুন সাতদফা দাবির মধ্যে এমন একটিও আছে কী না, যা কোনো গণতান্ত্রিক ও আধুনিক রাষ্ট্র মেনে নিতে পারে- আমরা সেই আলোচনায় যেতে পারি। বিতর্কিত সংগঠনটির সাম্প্রতিক সাতদফা হলো- এক. হেফাজতের নেতাকর্মী ও কথিত আলেম-ওলামাদের মুক্তি; দুই. তাদের বিরুদ্ধে থাকা সব ‘মিথ্যা মামলা’ প্রত্যাহার; তিন. ইসলাম ও মহানবী (সা.) সম্পর্কে কটূক্তিকারীদের বিরুদ্ধে শাস্তির বিধান রেখে জাতীয় সংসদে আইন পাস করা; চার. আহমদিয়া সম্প্রদায়কে রাষ্ট্রীয়ভাবে অমুসলিম ঘোষণা করা; পাঁচ. শিক্ষা কারিকুলামে ধর্মশিক্ষার পরীক্ষা বাধ্যতামূলক করা; ছয়. পাঠ্যপুস্তক প্রণয়নে আল-হাইয়াতুল উলইয়া লিল জামিয়াতিল কওমিয়ার প্রতিনিধি রাখা ও সাত. আসন্ন বিশ্ব ইজতেমায় মাওলানা সাদকে আসার অনুমতি না দেওয়া।
আহমদিয়া মুসলমানদেরকে ‘অমুসলমান’ ঘোষণার পরিকল্পনা রাজনীতিটা মূলত জামায়াতের। একাত্তরের যুদ্ধাপরাধীদের সংগঠন জামায়াতের প্রতিষ্ঠাতা আবুল আলা মওদুদী পাকিস্তান আমলে আহমদিয়াবিরোধী দাঙ্গার উসকানি দেন। এতে ৫০ হাজার মুসলমান নিহত হন। এ দাঙ্গা ঘটানোর দায়ে আদালতের বিচারে মওদুদীর মৃত্যুদণ্ডাদেশ হয়। বঙ্গবন্ধুর নেতৃত্বে বাংলাদেশ রাষ্ট্রের পত্তন হয় পাকিস্তানের দ্বিজাতিতত্ত্ব, ধর্মভিত্তিক রাজনীতিকে নাকচ করে ধর্মনিরপেক্ষ রাষ্ট্র হিসেবে।
সাবেক পূর্ব পাকিস্তানে, মুক্তিযুদ্ধ চলাকালে ও বর্তমান বাংলাদেশেও জামায়াতের একই ভূমিকা। বিএনপি-জামায়াতের চারদলের জোট সরকারের আমলে রাষ্ট্রীয় পৃষ্ঠপোষকতায় দেশের বিভিন্ন এলাকায় আহমদিয়ারা হত্যাকাণ্ডের শিকার হন। তাদের মসজিদে বোমা হামলার ঘটনা ঘটে। তাদেরকে ‘কাফের’ ঘোষণার দাবি জামায়াত নেতারা নিজে জানান, জোট সরকারের উপর চাপ সৃষ্টি করতে ‘আল্লার দল’ নামে উগ্র একটি সংগঠনকে মদদ দেয় জামায়াত। যুদ্ধাপরাধীদের বিচার শুরু হলে কোণঠাসা হয়ে পড়া জামায়াত একপর্যায়ে এসব দাবি নিয়ে হেফাজতকে মাঠে নামায় বলে অভিযোগ আছে।
২০১০ সালের ১৯ এপ্রিল হেফাজত আলোচনা-সমালোচনায় আসে আওয়ামী লীগের সরকারের ঘোষিত নারী উন্নয়ন নীতি ও ধর্মনিরপেক্ষ শিক্ষানীতির বিরোধিতা করার মধ্য দিয়ে। ২০১৩ সালের ৫ মে ঢাকার মতিঝিলের শাপলা চত্বর কাণ্ডের পর সরকার সংগঠনটির বিরুদ্ধে কঠোর অবস্থান নেয়। অনেক নেতাকর্মীকে গ্রেপ্তার করে, মামলা হয়। এখন সংগঠনটির দাবি, ২০১৩ সাল থেকে ২০২১ সাল পর্যন্ত হেফাজতের নেতাকর্মীদের বিরুদ্ধে করা মামলাগুলো প্রত্যাহার ও কারাবন্দী আলেমদের মুক্তি। মধ্যযুগীয় বর্বর তাণ্ডবলীলার বিরুদ্ধে দায়ের হওয়া সব মামলা প্রত্যাহারের সুযোগ নেই। আইন নিজের গতিতে চলে। হেফাজতের মতো সংগঠনগুলোর সঙ্গে যুক্ত যে কেউ, বা ধর্মীয় উস্কানির অভিযোগে কারাগারে গেলেই কেউ প্রকৃত আলেম হয়ে যাবেন- এটা মেনে নেওয়ার কোনো যুক্তি নেই।
ভারতের মাওলানা মোহাম্মদ সাদ কান্দালভির এক বক্তব্য কেন্দ্র করে ২০১৭ সালে বিশ্ব ইজতেমার আয়োজক তাবলীগ জামায়াতের নেতাদের মধ্যে বিভেদ সৃষ্টি হয়। এরপর থেকে দেশে দুটি ভাগে আলাদা হয়ে দুইপর্বে ইজতেমার আয়োজন চলছে। এ নিয়ে সংঘর্ষ ও উত্তেজনার ঘটনাও ঘটেছে। এ দেশে বিভক্তির জন্য অনেকটাই দায়ী হেফাজত। ২০১৮ সালের জুলাইয়ে সাদবিরোধী অংশকে আনুষ্ঠানিক সমর্থন দেন সংগঠনটির তখনকার শীর্ষনেতা শাহ আহমদ শফী।
আসন্ন বিশ্ব ইজতেমায় মাওলানা সাদকে আসার অনুমতি না দেওয়ার বিষয়ে হেফাজতের দাবি পূরণে প্রশাসনের হস্তক্ষেপের সুযোগ নেই। গণতান্ত্রিক প্রগতিশীল রাষ্ট্রে ধর্মপন্থী বিশেষ গোষ্ঠীর পক্ষ নেওয়ার সুযোগ প্রশাসনের থাকে না। ইজতেমায় কে থাকবেন, কে থাকবেন না- রাজনীতি ও দলাদলি বাদ দিয়ে আয়োজক সংগঠনগুলো নিজেই এ সিদ্ধান্ত নিতে পারে।
হেফাজতের নয়া সাতদফার মধ্যে তৃতীয়দফার অর্থ ব্লাসফেমি আইন প্রণয়ন। এটা জঙ্গি ও মৌলবাদীদের তোষণের আইন। এ আইনের কারণে পাকিস্তান আজও জ্বলছে। আহমদিয়াদেরকে ‘কাফের’ ঘোষণার দাবি তুলে মওদুদীর নেতৃত্বে পাকিস্তানে যে সহিংসতার সৃষ্টি হয়, তা সামলাতে লাহোরে সামরিক আইন জারি করতে হয়। পাকিস্তানের তখনকার প্রধানমন্ত্রী লিয়াকত আলী খান মৌলবাদীদেরকে হাতে রাখতে দেশটির শাসনতন্ত্রে তথাকথিত ‘অবজেকটিভ রেজল্যুশন’ অন্তর্ভুক্ত করেন। এতে অন্য যে কোনো নীতির ঊর্ধ্বে ধর্মকে স্থান দেওয়া হয়। শাসনতন্ত্রের ধর্মীয়করণের কুফল দেশটি আজও ভোগ করছে। হেফাজত, জামায়াতসহ উগ্রপন্থীরা তেমন চেহারায় বাংলাদেশকে দেখতে চায়।