প্রযুক্তির দ্রুত বিকাশের সঙ্গে সমাজের একটা অংশ যেন ক্রমেই নির্মম গন্তব্যের দিকে এগিয়ে যাচ্ছে। যে গন্তব্যে জননৈতিকতা, অন্যের সম্মান-মর্যাদার প্রতি শ্রদ্ধাবোধের অভাব প্রকট। মানবিক মূল্যবোধ সেখানে অনুপস্থিত, সামাজিক অবক্ষয় সেখানে সারকথা। সমাজের একটা শ্রেণির মানুষের মূল্যবোধের অবক্ষয়জনিত কারণে প্রায়ই গণমাধ্যমে এমন খবর আসে, যা সভ্য সমাজের যে কোনো বাসিন্দার মনে রক্তক্ষরণ ঘটায়। প্রভাব, প্রতিপত্তি ও ক্ষমতার মদমত্তে সমাজের ওই অংশ সাধারণ কাণ্ডজ্ঞান হারিয়ে ‘যা খুশি, তা করছে’। ফলে সামাজিক অপরাধ প্রায়ই মাত্রা অতিক্রম করছে। আবার সেগুলো সংক্রমিত হয়ে সমাজের চারপাশে ভয়াবহ ব্যাধির মতো দানা বাঁধছে।
মত ও পথসহ সহযোগী গণমাধ্যমগুলোতে গত রোববার প্রচারিত এক প্রতিবেদন থেকে জানা যায়, চাঁদা না দেওয়ায় মধ্যবয়সী এক ব্যবসায়ীকে নগ্ন করে রাতের বেলা রাস্তা দিয়ে হাঁটিয়ে নিয়ে যাচ্ছেন কয়েক যুবক। তারা উল্লাস প্রকাশ করে হাততালি দিচ্ছেন। পেছন থেকে মারপিটও করছেন কেউ কেউ। এক হাত দিয়ে লজ্জাস্থান ঢেকে অন্য হাতে বারবার চোখ মুছছেন ওই ব্যক্তি। কান্নার আওয়াজও শোনা যাচ্ছে। চাঁপাইনবাবগঞ্জে ৫৩ সেকেন্ডের এমন একটি ভিডিও সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে ছড়িয়ে পড়ে। গত শনিবার রাতে ফুটেজটি পুলিশের হাতে আসে। পুলিশ ওই রাতেই ঘটনার সঙ্গে জড়িত অভিযোগে তিনজনকে গ্রেপ্তার করে।
বাবার বয়সী ওই ব্যবসায়ীকে নগ্ন করে ভিডিও ভাইরালের ঘটনায় অন্যতম অভিযুক্ত ও এ ঘটনায় দায়ের হওয়া মামলার এক নম্বর আসামি আবু বাক্কার চাঁপাইনবাবগঞ্জের পৌর মেয়র ও আওয়ামী লীগের স্থানীয় নেতা মোখলেসুর রহমানের চাচাতো ভাই। এ ঘটনা একটি উদাহরণমাত্র। আমাদের আধাসামন্তবাদী সমাজে আপত্তিকর ভিডিও ধারণ করে ফেসবুক ও ইউটিউবের মতো সামাজিক যোগাযোগের মাধ্যমগুলোতে মুহূর্তের মধ্যে ছড়িয়ে দেওয়ার জঘন্য সংস্কৃতির চর্চা চলছে। এ সংস্কৃতির চর্চাকারীদের মধ্যে সামান্যতম নীতি-নৈতিকতা নেই। সমাজের যে কোনো বাসিন্দার মান-সম্মানের সঙ্গে বসবাসের সংবিধান স্বীকৃত অধিকার আছে, এ বোধ তাদের নেই। তাদের বিকারগ্রস্ত ও ঘৃণ্য মানসিকতা নষ্ট করছে আমাদের সমাজের চিরন্তন সংস্কৃতি। সামাজিক বাস্তবতার লজ্জায় প্রায়ই জীবন দিতে নিরীহ মানুষকে।
হাতে হাতে স্মার্টফোন ও ইন্টারনেটের সহজলভ্যতা থাকায় অনেকে নানা ঘটন-অঘটন সর্বত্র ছড়িয়ে দিচ্ছেন। শিক্ষার্থী, গৃহবধূর গোসলের ভিডিও, বা কোনো তরুণীকে প্রেমের ফাঁদে আটকে ধর্ষণ, নানা শ্রেণিপেশার মানুষকে প্রকাশ্যে-অপ্রকাশ্যে অপমান করার ভিডিও কথিত ভাইরাল হওয়ায় এ পর্যন্ত কতোজন আত্মহত্যা করেছেন, বা আত্মহননের চেষ্টা করেছেন- এর সঠিক পরিসংখ্যান আমাদের মধ্যে অনেকের জানা নেই। লোকচক্ষুর আড়ালে অনেক নারী ভার্চুয়াল মাধ্যমে হয়রানির শিকার হচ্ছেন। পুরুষতান্ত্রিক সমাজের বিশ্বাস, নারীর নিজের জীবনের ওপর তার কোনো নিয়ন্ত্রণ থাকা উচিত নয়। নারীর যে কোনো ব্যক্তিগত বিষয়ে যে কোনো পুরুষ হস্তক্ষেপ করতে পারে। ফলে এ মাধ্যমে সবচেয়ে বেশি ভুক্তভোগী নারী।
ডিজিটাল নিরাপত্তা আইনে বলা হয়েছে, কারো ব্যক্তিগত বা গোপনীয় কোনো তথ্য অনুমতি ছাড়া প্রকাশ করলে তা অপরাধ বলে গণ্য হবে। নগ্ন ভিডিও ‘ভাইরাল ব্যাধি’ তাই অপরাধ। জঘন্য এ অপরাধ দমনে আইনের আরো কঠিন ও শক্তভাবে প্রয়োগ জরুরি। আপত্তিকর ভিডিও, কনটেন্ট (আধেয়) মুছে দিতে বিটিসিএল কর্তৃপক্ষকে আরো দায়িত্বশীল, উদ্যোগী হতে হবে। আমাদের সামাজিক মূল্যবোধ একটা সময় এতো শক্তিশালী ছিল যে, সেখান থেকে অসততা, দুর্নীতি ও মানুষের প্রতি অসম্মান থেকে দুরে থাকার শিক্ষা পাওয়া যেতো। সেটা যেন কোনাভাবেই ভেঙ্গে না পড়ে, সেদিকে সবাইকে খেয়াল রাখতে হবে।