কিসের ‘মেরামত’, কিসের কি!

সম্পাদকীয়

র আ ম উবায়দুল মোকতাদির চৌধুরী এমপি।
র আ ম উবায়দুল মোকতাদির চৌধুরী এমপি। ফাইল ছবি

বিএনপি ১৯ দফার ‘রূপরেখা’ দিয়ে রাষ্ট্র ও সরকারের কথিত ‘মেরামতের’ যে প্রস্তাব দিয়েছে, সেগুলোতে নতুনত্ব নেই, অধিকাংশই আগাগোড়া অন্তঃসারশূন্য। কোথাও কোথাও চটকদার শব্দের সমাহার থাকলেও বাস্তবায়নের সুনির্দিষ্ট পথরেখা নেই। অনেক বিষয়ে দলটির অবস্থান ‘ধোঁয়াশায়’। যুদ্ধাপরাধীদের বিচার চলমান রাখা না রাখা, যুদ্ধাপরাধী ও মৌলবাদী দলগুলোর সঙ্গে ঐক্য থাকবে কী না- এসব বিষয়ে বক্তব্য নেই।

একাত্তর ও পঁচাত্তর সালের নরঘাতক ও তাদের উত্তরসূরিকে সামাজিক, রাজনৈতিক স্বীকৃতি ‘দেওয়ার’ কথা কৌশলে ‘রূপরেখায়’ বলা হয়েছে। এমন কয়েকটি দফার কথা বলা হয়েছে, যা বিএনপি ক্ষমতায় যেতে পারলে বাস্তবায়ন করবে বলে প্রতিশ্রুতি আছে, তবে সেগুলো জনগণকে বিশ্বাস করানোর মতো ঘটনা দলটির অতীত ইতিহাসে নেই। কোনো কোনো দফা দলটির সাম্প্রদায়িক মতাদর্শের সঙ্গে সাংঘর্ষিক।

বিএনপির প্রতিষ্ঠাতা, ফৌজি শাসক জিয়াউর রহমানের আলোচিত-সমালোচিত ১৯ দফা ও খালেদা জিয়ার ‘ভিশন-২০৩০’ এর সংমিশ্রণে নতুন ‘রূপরেখা’ সাজানো। বাংলাদেশকে উন্নয়নশীল থেকে উন্নত রাষ্ট্রে রূপান্তরের যেসব রূপকল্প নিয়ে সরকার এখন দেশ পরিচালনা করছে, ক্ষমতায় গেলে সেখান থেকে দেশকে এগিয়ে নেওয়ার ন্যূনতম পরিকল্পনা বিএনপির ‘রূপরেখায়’ নেই। এমনকি রাষ্ট্রীয় কাঠামোগুলো কীভাবে সক্রিয় থাকবে দলটি সরকারে যেতে পারলে, এ বিষয়ে তাদের ধারণা, চিন্তার প্রতিফলন নেই ‘রূপরেখায়’।

দেশের আজকের অর্জন ও অগ্রগতিকে এগিয়ে না নিয়ে ছয়টি কমিশন ও কয়েকটি কাউন্সিল গঠনের ‘রূপরেখায়’ রাষ্ট্র ‘মেরামতের’ কোনো প্রয়োজন নেই বলে আমরা মনে করি। গত প্রায় চৌদ্দ বছরে আওয়ামী লীগের সরকারের নেতৃত্বে দেশের অর্থনৈতিক ও অবকাঠামোগতসহ সার্বিক যেসব উন্নতি হয়েছে, সেগুলোকে অস্বীকার করে দেশকে এগিয়ে নেওয়ার সুযোগ নেই। তাছাড়া, ক্ষয়ে যাওয়া পুরনো কোনো দেয়ালে সামান্য চুনকামে ভবনের মেরামত হয় না। আস্তরণ খসে পড়লে ক্ষয়রূপটা বেরিয়ে আসে।

‘দলনিরপেক্ষ তত্ত্বাবধায়ক সরকার’ ব্যবস্থা প্রবর্তনের কথা ১৯ দফায় বলা হয়েছে। অতীতে কখনোই শান্তিপূর্ণভাবে ক্ষমতা হস্তান্তর করেনি বিএনপি। সামরিক ছাউনিতে জন্ম নেওয়া এ দল প্রথম ক্ষমতাচ্যুত হয় রাষ্ট্রপতি থাকাকালে জিয়াউর রহমান নিহত হওয়ার পর। ১৯৯১ সালে ক্ষমতায় এসে ‘৯৬ সালে সরাসরি তত্ত্বাবধায়ক সরকার না মেনে ওই বছরের ফেব্রুয়ারিতে বিতর্কিত নির্বাচন দিয়ে আবার ক্ষমতায় থাকার চেষ্টা করে দলটি। ২০০৬ সালে বিএনপি-জামায়াত জোটের সরকারের মেয়াদ শেষ হওয়ার সময় আপত্তির মুখেও প্রধান বিচারপতির চাকরির বয়স বাড়ায়। রাজনৈতিক চরম অস্থিরতার পথ ধরে একপর্যায়ে আসে এক-এগারো।

দুর্নীতির শ্বেতপত্র প্রকাশের যে প্রস্তাব আছে, তাতে শুধু বর্তমান সরকারের আমলের কথা বলা হয়েছে। এটা গতানুগতিক রাজনৈতিক বক্তব্য। বিএনপি-জামায়াতের নেতৃত্বে চারদলের জোট পাঁচবছর ক্ষমতায় থাকাকালে তাদের সরকার পাঁচবার দুর্নীতিতে বিশ্ব চ্যাম্পিয়ন হয়। যা দেশের জন্য ছিল লজ্জা ও কলঙ্কজনক। নিজের সরকারের আমলের দুর্নীতির বিচারের বিষয়ে সামান্য শব্দও নেই ‘রূপরেখায়’। বিএনপি সরকারে থাকাকালে দুর্নীতি দমন কমিশনকে (দুদক) কার্যকর করেনি। প্রতিশ্রুতি দিয়েও ন্যায়পাল নিয়োগ দেয়নি। তাদের এ প্রস্তাব জনসাধারণ আস্থায় নেবে কী?

দফাগুলোর দুই নম্বরে বলা হয়েছে, ‘জাতীয় রিকনসিলিয়েশন কমিশন’ গঠন করে অংশগ্রহণমূলক সমাজ গঠনে একটি সামাজিক চুক্তিতে পৌঁছানো হবে। রিকনসিলিয়েশন, সোশ্যাল কন্ট্রাক্ট জাতীয় শব্দগুলো গত শতকে আফ্রিকা ও লাতিনের অনুন্নত কিছু দেশের জাতিগত সংঘাত নিরসনে ব্যবহার হতো। বাংলাদেশে জাতিগত বিভেদ নেই। কথিত ওই কমিশন গঠনের প্রতিশ্রুতি মূলত যুদ্ধাপরাধী, রাষ্ট্রপিতা (ফাউন্ডিং ফাদার অব দ্য নেশন) বঙ্গবন্ধুর ঘাতক ও জঙ্গিদেরকে রাজনীতিতে আবার বিএনপির সামাজিক স্বীকৃতি দেওয়ার কৌশল।

২০০৯ সালের শুরুতে আওয়ামী লীগের নেতৃত্বে সরকার গঠিত হওয়ার পর আর্ন্তজাতিক অপরাধ আদালত গঠন করে যুদ্ধাপরাধীদের বিচার করে। বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের ঘাতকদের ফাঁসির রায় কার্যকর ও জঙ্গি নেতাদের সাজা হয়। ফলে এসব ঘাতক, রাষ্ট্রবিরোধীদের প্রতি আজকের প্রজন্মের ঘৃণা জন্মায়। তাদেরকে সামাজিক স্বীকৃতি দেওয়ার প্রতিশ্রুতি হচ্ছে বিএনপির ‘রেইনবো ন্যাশন’ গঠন।

১৯তম দফায় বলা হয়েছে, ‘জঙ্গিবাদ ও উগ্রবাদের বিরুদ্ধে কঠোর ব্যবস্থা গ্রহণ করা হইবে।’ অথচ বিএনপি-জামায়াতের আমলে রাষ্ট্রীয় মদদে জঙ্গিবাদের উত্থান ঘটে। আর্ন্তজাতিক সংবাদমাধ্যম ‘ফার ইস্টার্ন ইকোনমিক রিভিউ’ এ বিষয়ে তখন প্রচ্ছদ প্রতিবেদন প্রকাশ করেছিল- ‘বাংলাদেশ থেকে সাবধান’ শিরোনামে। জোট সরকারের মন্ত্রী, যুদ্ধাপরাধের দায়ে ফাঁসির রায় কার্যকর হওয়া জামায়াতের সাবেক আমির মতিউর রহমান নিজামী তখন ঘোষণা দেন- ‘আমরা সবাই তালেবান, বাংলা হবে আফগান’!

রাজনীতিতে প্রজন্মের মধ্যকার একটা পার্থক্য থাকে। ২০০৮ সালের নির্বাচনের আগে আওয়ামী লীগের ‘ডিজিটাল বাংলাদেশ’ বিনির্মাণের শ্লোগান তরুণদেরকে আকৃষ্ট করেছিল। তারা এখন আরো স্মার্ট বাংলাদেশের স্বপ্ন দেখেন। তাদের জন্য বিএনপির নয়া ‘রূপরেখায়’ নতুন কিছু নেই। আজকের প্রজন্ম, যারা আগামীতে দেশের নেতৃত্বে আসবেন, তাদেরকে বাদ দিয়ে দেশ এগিয়ে যেতে পারবে না। সেই মিলেনিয়াম প্রজন্মের জন্য ‘রূপরেখায়’ তেমন কিছু না থাকা তাদের সম্পর্কে বিএনপির চরম ‘উদাসীনতা’। আসলে দলটির ‘রূপরেখায়’ বুমার প্রজন্মের (১৯৪৬-৬৪ সাল পর্যন্ত যাদের জন্ম) জন্য কিছু চটকদার শব্দ আছে, যা তাদের চর্চিত সাধু ভাষায় উপস্থাপিত।

আওয়ামী লীগের দেড় দশকের শাসনামলের বিচারবহির্ভূত হত‌্যা, ক্রসফায়ারের বিচারের কথা ‘রূপরেখায়’ বলা হয়েছে, যা অযৌক্তিক ও স্ট্যান্ডবাজি। চারদলের জোট সরকারের আমলে ‘অপারেশন ক্লিনহার্টের’ সময় সংঘটিত বিচার বিচারবহির্ভূত হত্যাকাণ্ডগুলো সারাবিশ্বে দেশের ভাবমূর্তি প্রশ্নবিদ্ধ করে। সমালোচনা ও নিন্দার মুখেও সরকার কোনো বিচার না করে জড়িতদেরকে দায়মুক্তি দেয়।

‘ধর্ম যার যার, রাষ্ট্র সবার’ নীতির ঘোষণা বিএনপির ধর্মীয় সাম্প্রদায়িক দৃষ্টিভঙ্গি পরিবর্তনের ইঙ্গিত দেয় না। মুক্তিযুদ্ধের পর সংবিধান অনুযায়ী নিষিদ্ধ জামায়াতসহ স্বাধীনতাযুদ্ধে বিরোধিতাকারীদেরকে রাজনীতির সুযোগ দেয় বিএনপি। ধর্মনিরপেক্ষ সংবিধানে ‘বিসমিল্লাহ’ যুক্ত হয় বিএনপির আমলে। বিএনপি-জামায়াতের আমলে ধর্মীয় সংখ্যালঘুদেরকে নির্যাতন, তাদের বাড়িঘরে হামলা, সম্পত্তি দখল, নারীদেরকে ধর্ষণের বিভৎস অধ্যায় মানুষের মনে এখনো আছে। সেগুলো হুমায়ুন আজাদের ‘পাক সার জমিন সাদ বাদ’ উপন্যাসে বর্ণিত হয়েছে।

শেয়ার করুন