এক দশক অপেক্ষার পর উদ্বোধন হতে যাচ্ছে স্বপ্নের মেট্রোরেল

নিজস্ব প্রতিবেদক

ফাইল ছবি

মেট্রোরেল এখন আর স্বপ্ন নয়; এটি বাস্তব। এক দশকের অপেক্ষার পর উদ্বোধন হতে যাচ্ছে মেট্রোরেল; কিন্তু এর পেছনের কাহিনি সুখকর নয়। প্রকল্প এলাকায় জনদুর্ভোগ, যানজট, ঘণ্টার পর ঘণ্টা অপেক্ষা। গন্তব্যে যেতে মানুষের রুদ্ধশ্বাস ছোটাছুটি। এ যেন ঢাকাবাসীর এক ভয়াবহ স্মৃতি। শুধু তাই নয়, মেট্রোরেল প্রকল্পে কর্মরত সাত জাপানির মৃত্যুও ছিল এক দুঃসহ ঘটনা। আজ এসব দুর্ভোগ ঠেলে আরও এক স্বপ্ন স্পর্শ করতে চলেছে বাংলাদেশ।

বুধবার (২৮ ডিসেম্বর) সকালে সেই স্বপ্ন বাস্তবে দেখবে ঢাকাবাসী। এদিন মেট্রোরেল উদ্বোধন করবেন প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা। পরদিন বৃহস্পতিবার (২৯ ডিসেম্বর) থেকে সাধারণ যাত্রীদের জন্য খুলে দেওয়া হবে মেট্রোরেল। প্রাথমিকভাবে উত্তরা থেকে আগারগাঁও পর্যন্ত চলবে এটি। পুরোদমে চালু হলে মেট্রোরেল ঘণ্টায় ৬০ হাজার ও দৈনিক পাঁচ লাখ যাত্রী পরিবহন করতে পারবে।

মূলত মেট্রোরেল নির্মাণ হবে রাজধানীর উত্তরা থেকে মতিঝিল পর্যন্ত। এ জন্য ২০১২ সালের জুলাই মাসে মেট্রোরেল প্রকল্প গ্রহণ করা হয়। এটি বাস্তবায়নের প্রাথমিক মেয়াদ ছিল ২০২৪ সালের জুন পর্যন্ত। যদিও পরে মেয়াদ বাড়ানো হয়। কিন্তু তার আগেই মেট্রোরেলের একটি অংশ উদ্বোধন হতে যাচ্ছে। মেট্রোরেল নির্মাণ ও পরিচালনার দায়িত্বে রয়েছে ঢাকা ম্যাস ট্রানজিট কোম্পানি লিমিটেড (ডিএমটিসিএল)।

মেট্রোরেল প্রকল্পের উদ্বোধন

২০১৭ সালের ৩ আগস্ট মেট্রোরেল প্রকল্পের পাইলিং কাজের উদ্বোধন করেন সড়ক, পরিবহন ও সেতুমন্ত্রী ওবায়দুল কাদের। রাজধানীর আগারগাঁওয়ে পরিসংখ্যান ভবনের সামনের সড়কে এর উদ্বোধন করা হয়। শুরুতে ওবায়দুল কাদের মেট্রোরেলের মূল কাজের ফলক উন্মোচন করেন। এরপর নিজেই চেপে বসেন পাইলিং মেশিনে।

মেট্রোরেল নির্মাণে অন্যতম সহযোগী জাপান

এমআরটি লাইন-৬ এর উত্তরা উত্তর থেকে কমলাপুর পর্যন্ত দৈর্ঘ্য প্রায় ২২ কিলোমিটার (২১,২৬ কিলোমিটার)। এর মোট ব্যয় ৩৩ হাজার ৪৭২ কোটি টাকা। এর মধ্যে জাপানের আন্তর্জাতিক সহযোগিতা সংস্থা-জাইকার ঋণ থেকে ১৯ হাজার ৭১৮ কোটি ৭০ লাখ টাকা ব্যয় হচ্ছে।

মেট্রোরেল প্রকল্পের মেয়াদকাল

প্রথমে প্রকল্পটির মেয়াদকাল ছিল ২০১২ সালের ১ জুলাই থেকে ২০২৪ সালের ৩০ জুন পর্যন্ত। তবে কাজ বেড়ে যাওয়ায় প্রকল্প শেষ করতে সময় লাগবে আরও এক বছর ছয় মাস। সেক্ষেত্রে এটির মেয়াদ ২০২৫ সালের ৩১ ডিসেম্বর পর্যন্ত বেড়েছে।

মেট্রোরেলের স্টেশন সংখ্যা

মেট্রোরেলের মোট স্টেশন ১৭টি। এগুলো হলো উত্তরা উত্তর, উত্তরা সেন্টার, উত্তরা দক্ষিণ, পল্লবী, মিরপুর ১১, মিরপুর ১০, কাজীপাড়া, শেওড়াপাড়া, আগারগাঁও, বিজয় সরণি, ফার্মগেট, কারওয়ান বাজার, শাহবাগ, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়, বাংলাদেশ সচিবালয়, মতিঝিল এবং কমলাপুর।

মেট্রোরেলের প্রথম টিকিট কাটবেন প্রধানমন্ত্রী

মেট্রোরেলের প্রথম টিকিট নেবেন প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা। তিনি নিজে টিকিট কেটে উত্তরা থেকে আগারগাঁও আসবেন। প্রধানমন্ত্রীর সঙ্গে মেট্রোরেলে চড়বেন সেতুমন্ত্রী ওবায়দুল কাদের, সড়ক পরিবহন ও মহাসড়ক বিভাগের সচিব এ বি এম আমিন উল্লাহ নুরী এবং জাইকার কর্মকর্তারা। এছাড়া মেট্রোরেল নিয়ে বঙ্গবন্ধু আন্তর্জাতিক সম্মেলন কেন্দ্রে একটি অনুষ্ঠান হবে, সেখানেও অংশ নেবেন প্রধানমন্ত্রী।

মেট্রোরেলের টিকিট ও কার্ড সংগ্রহ করবেন যেভাবে

মেট্রোরেলের টিকিটেও আধুনিকতার ছোঁয়া থাকছে। এখানে কাগজের টিকিট থাকবে না। স্টেশন থেকেই কার্ড কিনে যাতায়াত করতে হবে। প্রথম দিকে দুই ধরনের কার্ড পাওয়া যাবে। স্থায়ী ও এক যাত্রার (সিঙ্গেল জার্নি) কার্ড। শুরুতে উত্তরা ও আগারগাঁও স্টেশন থেকে কার্ড সংগ্রহ করা যাবে। উত্তরা থেকে আগারগাঁও পর্যন্ত ভাড়া ৬০ টাকা।

১০ বছর মেয়াদি স্থায়ী কার্ড কিনতে লাগবে ২০০ টাকা। এই কার্ড দিয়ে যাতায়াতের জন্য প্রয়োজনমতো টাকা রিচার্জ করা যাবে। তবে স্থায়ী কার্ড পেতে আগে থেকে নিবন্ধন করতে হবে। বৃহস্পতিবার ডিএমটিসিএলের ওয়েবসাইটে নিবন্ধনের লিংক দেওয়া হবে। এদিন থেকে করা যাবে নিবন্ধন। নিবন্ধন করতে নিজের নাম, মাতা–পিতার নাম, জাতীয় পরিচয়পত্র (এনআইডি) বা পাসপোর্ট নম্বর, মুঠোফোন নম্বর ও মেইল আইডি লাগবে।

মেট্রোরেলের টিকিট বিক্রয় মেশিন

স্টেশনের টিকিট অফিস মেশিন (টিওএম) থেকে বিক্রয়কর্মীর সহায়তায় কেনা যাবে কার্ড। এছাড়া ভেন্ডিং মেশিন থেকে যাত্রী নিজেই স্বয়ংক্রিয় পদ্ধতিতে কার্ড সংগ্রহ করতে পারবেন।

এক যাত্রার (সিঙ্গেল জার্নি) কার্ডের জন্য নিবন্ধনের প্রয়োজন হবে না। স্টেশন থেকে এই কার্ড কিনে যাত্রা করা যাবে। ট্রেন থেকে নামার সময় কার্ড রেখে দেওয়া হবে। সিঙ্গেল রাইডের কার্ডে নির্ধারণ থাকবে সময়। এরপর এই কার্ড আর কার্যকর থাকবে না। তবে যারা এটিএম কার্ড নিয়মিত ব্যবহার করেন, তাদের জন্য মেট্রোরেলের সেবা নেওয়া সহজ হবে। কারণ মেট্রোরেলের টিকিট, কার্ড ও টাকা জমা দেওয়ার পদ্ধতি একই ধরনের।

থাকছে না হাফ ভাড়া

মেট্রোরেলে শিক্ষার্থীদের জন্য হাফ ভাড়া থাকবে না। যারা র‌্যাপিড পাস কিনবেন তারা ১০ শতাংশ ছাড় পাবেন। তিন ফুটের কম উচ্চতার শিশুরা বাবা-মায়ের সঙ্গে ভ্রমণ করলে ভাড়া ফ্রি।

নারী ও বয়স্কদের জন্য আলাদা কোচ বরাদ্দ

মেট্রোরেলে প্রতিটি ট্রেনে নারী যাত্রীদের জন্য একটি করে কোচ বরাদ্দ থাকবে। ওই কোচে সর্বোচ্চ ৩৯০ জন নারী একই সময়ে যাতায়াত করতে পারবেন। পাশাপাশি অন্য কোচেও যাতায়াত করতে পারবেন নারীরা। অন্তঃসত্ত্বা ও জ্যেষ্ঠ নাগরিকদের জন্য মেট্রোরেলের কোচের আসন সংরক্ষিত থাকবে। এছাড়া বিশেষ চাহিদাসম্পন্ন ব্যক্তিদের জন্য মেট্রোর সব সেবায়ই রাখা হয়েছে বিশেষ সুবিধা।

মেট্রোরেলের আসন সংখ্যা

আপাতত ছয় কোচবিশিষ্ট ২৪ সেট চালু থাকবে। তবে ভবিষ্যতে আট কোচে উন্নীত করা যাবে। মাঝের চারটি কোচের প্রতিটিতে সর্বোচ্চ ৩৯০ জন, ট্রেইলর কোচের প্রতিটিতে সর্বোচ্চ ৩৭৪ জন যাত্রী পরিবহন করা যাবে। ছয় কোচবিশিষ্ট মেট্রোরেলে মোট আসন সংখ্যা ৩০৬টি। মাঝের চারটি কোচের প্রতিটিতে আসন সংখ্যা ৫৪টি, ট্রেইলর কোচের প্রতিটিতে আসন সংখ্যা ৪৫টি।

মেট্রোরেলের যাত্রীদের জন্য বিআরটিসির বাস

যাত্রীদের স্টেশনে পৌঁছে দেওয়ার জন্য ৩০টি দ্বিতল বাসের ব্যবস্থা করেছে বিআরটিসি। যার মধ্যে আগারগাঁও থেকে মতিঝিল পর্যন্ত বিআরটিসির ২০টি দ্বিতল বাস চলবে। আর উত্তরার হাউজ বিল্ডিং থেকে ১০টি দ্বিতল বাস চলবে দিয়াবাড়ীর মেট্রোরেলের উত্তরা উত্তর স্টেশন পর্যন্ত।

বিআরটিসির কর্মকর্তারা জানিয়েছেন, নগর পরিবহনে বাংলাদেশ সড়ক পরিবহন কর্তৃপক্ষ (বিআরটিএ) যে ভাড়ার হার নির্ধারণ করে দিয়েছে, বিআরটিসির বাসে সেই ভাড়াই নেওয়া হবে।

নিহত জাপানি নাগরিকের স্মরণে স্মৃতিস্তম্ভ নির্মিত

২০১৬ সালের ১ জুলাই রাতে গুলশানে হলি আর্টিসান বেকারিতে হামলা চালায় জঙ্গিরা। সেদিন জঙ্গিরা ২০ জন দেশি-বিদেশি নাগরিককে কুপিয়ে ও গুলি করে হত্যা করে। এর মধ্যে সাতজন জাপানি নাগরিক। তারা মেট্রোরেল প্রকল্পে কর্মরত ছিলেন। তাদের স্মরণে স্মৃতিস্তম্ভ করা হয়েছে। এমআরটি লাইন-৬ এর উত্তরা ডিপো এলাকায় মেট্রোরেল এক্সিবিশন অ্যান্ড ইনফরমেশন সেন্টারে এই স্মৃতিস্তম্ভ করা হয়।

নিহত সাত জাপানি প্রকৌশলীরা হলেন তানাকা হিরোশি, ওগাসাওয়ারা, শাকাই ইউকু, কুরুসাকি নুবুহিরি, ওকামুরা মাকাতো, শিমুধুইরা রুই ও হাশিমাতো হিদেইকো।

মতিঝিল থেকে কমলাপুর পর্যন্ত মেট্রোরেলের রুট বৃদ্ধি

মতিঝিল থেকে কমলাপুর পর্যন্ত দৈর্ঘ্য ১ দশমিক ১৬ কিলোমিটার। কমলাপুর রেলস্টেশনের সঙ্গে মেট্রোরেলের সংযোগ স্থাপনের জন্যই প্রধানমন্ত্রী রুট বাড়ানোর নির্দেশনা দেন। এরই মধ্যে বাড়তি অংশে ভূমি অধিগ্রহণ, নির্মাণ এবং ই অ্যান্ড এম সিস্টেম সংগ্রহ করা হচ্ছে।

এদিকে এক সংবাদ সম্মেলন সড়ক পরিবহন ও সেতুমন্ত্রী ওবায়দুল কাদের বলেন, আগারগাঁও থেকে দিয়াবাড়ী পর্যন্ত চলবে ট্রেন। এই রুটে মাঝের কোনো স্টেশনে আগামী তিন মাস যাত্রী ওঠানামা করানো হবে না।

শেয়ার করুন