২০২২ সালে বাংলা সাহিত্য যাঁদের হারিয়েছে

মত ও পথ ডেস্ক

ফাইল ছবি

বিদায়ের দ্বারপ্রান্তে ২০২২ সাল। অনেক প্রাপ্তির মাঝেও হারানোর বেদনা আমাদের আহত করেছে। এ বছর কবি, লেখক, গবেষক, সাংবাদিক ও বুদ্ধিজীবীসহ আলোকিত কিছু মানুষ বিষাদের অন্ধকারে ফেলে চলে গেছেন চিরদিনের জন্য। তবে রেখে গেছেন তাঁদের মূল্যবান সৃষ্টিকর্ম। সেইসব উজ্জ্বল নক্ষত্রের প্রস্থান নিয়েই আজকের আয়োজন—

লেখক কাজী আনোয়ার হোসেন

universel cardiac hospital

সেবা প্রকাশনীর প্রতিষ্ঠাতা, রহস্য-ঔপন্যাসিক কাজী আনোয়ার হোসেন ১৯ জানুয়ারি বিকেল ৪টা ৪০ মিনিটে বারডেমে শেষ নিঃশ্বাস ত্যাগ করেন। তাঁর বয়স হয়েছিল ৮৬ বছর।

বাংলাদেশের পাঠকদের কাছে রহস্য-রোমাঞ্চ গল্পকে জনপ্রিয় করে তুলেছিলেন কাজী আনোয়ার হোসেন। তাঁর সেবা প্রকাশনীর মাধ্যমে তৈরি হয় এ সাহিত্যধারার পাঠকশ্রেণি। তিনি ‘বিদ্যুৎ মিত্র’ এবং ‘শামসুদ্দিন নওয়াব’ ছদ্মনামে লিখেছেন অসংখ্য গল্প। পাঠকদের কাছে তিনি পরিচিত প্রিয় কাজীদা নামে। প্রখ্যাত গণিতবিদ ও সাহিত্যিক বাবা কাজী মোতাহের হোসেন ও মা সাজেদা খাতুনের ঘরে ১৯৩৬ সালের ১৯ জুলাই জন্মগ্রহণ করেন কাজী শামসুদ্দিন নওয়াব।

ঢাকা মেডিকেল কলেজের পূর্ব সীমানায় উত্তর ও দক্ষিণ কোণে যে দুটি দোতালা গেস্ট হাউজ আজও দেখা যায়, সেখানেই উত্তরের দালানটিতে আনোয়ার হোসেনের ছেলেবেলা কেটেছে। ১৯৪৩ সালে দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধ চলাকালীন বাড়ি বদল করে তারা দক্ষিণ দিকের গেস্ট হাউজে চলে যান।

পরিবারের সংগীতচর্চার ধারাবাহিকতায় প্রথমে সংগীতশিল্পী হিসেবে কর্মজীবন শুরু করলেও ১৯৬৩ সালে বাবার দেওয়া টাকায় সেগুনবাগিচায় প্রেসের যাত্রা শুরু করেন। পরে সেই প্রেস থেকেই নিজের সম্পাদনায় পেপারব্যাকে সৃষ্টি করেছেন চিরতরুণ চরিত্রগুলো। ‘কুয়াশা’ ও ‘মাসুদ রানা’ সিরিজ দিয়ে আলোচনায় আসেন কাজী আনোয়ার হোসেন।

সাংবাদিক পীর হাবিবুর রহমান

বাংলাদেশের খ্যাতিমান সাংবাদিক ও কলামিস্ট পীর হাবিবুর রহমান ৫ ফেব্রুয়ারি ৫৮ বছর বয়সে মারা যান। ২০২১ সালের অক্টোবরে মুম্বাই জাসলুক হাসপাতালে বোনম্যারো ট্রান্সপ্লান্টেশনের মাধ্যমে ক্যানসারমুক্ত হন পীর হাবিবুর রহমান।

দেশে ফিরে গত ২২ জানুয়ারি তিনি করোনায় আক্রান্ত হন। এরপর বিশিষ্ট চিকিৎসক অধ্যাপক ডা. এ বি এম আব্দুল্লাহর পরামর্শে তিনি ল্যাবএইড হাসপাতালে ভর্তি হন। করোনামুক্ত হলেও কিডনি জটিলতার কারণে তিনি বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব মেডিকেল বিশ্ববিদ্যালয় হাসপাতালে ভর্তি হন। বরেণ্য এ সাংবাদিকের জন্ম ১৯৬৩ সালের ১২ নভেম্বর সুনামগঞ্জ শহরে।

দীর্ঘ কর্মজীবনে পীর হাবিবুর রহমান দৈনিক বাংলাবাজার, যুগান্তর, মানবকণ্ঠ, আমাদের সময় প্রভৃতি পত্রপত্রিকায় কাজ করেছেন। অনলাইন নিউজ পোর্টাল পূর্বপশ্চিমবিডি.নিউজের প্রতিষ্ঠাতা ছিলেন। তিনি সর্বশেষ দৈনিক বাংলাদেশ প্রতিদিন পত্রিকার নির্বাহী সম্পাদক হিসেবে দায়িত্ব পালন করেন।

কবি কাজী রোজী

সাবেক সংসদ সদস্য, কবি ও রাজনীতিবিদ কাজী রোজী ১৯ ফেব্রুয়ারি ইন্তেকাল করেন। ২১ দিন করোনার সঙ্গে লড়াই করে রাত আড়াইটার দিকে রাজধানীর একটি বেসরকারি হাসপাতালে চিকিসাধীন অবস্থায় শেষ নিঃশ্বাস ত্যাগ করেন তিনি। তাঁর বয়স হয়েছিল ৭৩ বছর।

কাজী রোজী ১৯৪৯ সালের ১ জানুয়ারি সাতক্ষীরায় জন্মগ্রহণ করেন। তিনি ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের বাংলা বিভাগ থেকে সাহিত্যে স্নাতক ও স্নাতকোত্তর সম্পন্ন করেছেন। ১৯৬০-এর দশকে কবিতা লেখা শুরু করেন। তাঁর উল্লেখযোগ্য কাব্যগ্রন্থগুলো হলো— পথঘাট মানুষের নাম (কাব্যগ্রন্থ), নষ্ট জোয়ার (কাব্যগ্রন্থ), আমার পিরানের কোনো মাপ নেই (কাব্যগ্রন্থ), লড়াই (কাব্যগ্রন্থ), শহীদ কবি মেহেরুন নেসা (জীবনী গ্রন্থ), রবীন্দ্রনাথ: রসিকতার কবিতা (গবেষণা গ্রন্থ)।

কবিতায় বিশেষ অবদানের জন্য ২০১৮ সালে বাংলা একাডেমি সাহিত্য পুরস্কার ও ২০২১ সালের বাংলাদেশের দ্বিতীয় সর্বোচ্চ বেসামরিক সম্মাননা একুশে পদকে ভূষিত হন। কবিতা চর্চা ছাড়াও তিনি সরকারি চাকরিজীবী ছিলেন, ২০০৭ সালে তথ্য অধিদপ্ততরের একজন কর্মকর্তা হিসেবে অবসর নেন। পরে রাজনীতিতে সক্রিয় হন এবং ২০১৪ সালের ৫ জানুয়ারি অনুষ্ঠিত দশম জাতীয় সংসদ নির্বাচনের ধারাবাহিকতায় স্বতন্ত্র প্রার্থী হিসেবে সাতক্ষীরা জেলার জন্য নির্ধারিত সংরক্ষিত নারী আসন থেকে সংসদ সদস্য নির্বাচিত হন।

কলামিস্ট আবদুল গাফফার চৌধুরী

বিশিষ্ট সাংবাদিক ও কলাম লেখক আবদুল গাফ্ফার চৌধুরী ১৯ মে ভোরে যুক্তরাজ্যের লন্ডনের একটি হাসপাতালে ৮৮ বছর বয়সে শেষ নিঃশ্বাস ত্যাগ করেন।

তিনি ভাষা আন্দোলনের স্মরণীয় গান ‘আমার ভাইয়ের রক্তে রাঙানো’র রচয়িতা। তিনি স্বাধীনতা যুদ্ধে মুজিবনগর সরকারের মাধ্যমে নিবন্ধিত স্বাধীন বাংলার প্রথম পত্রিকা সাপ্তাহিক জয়বাংলার প্রতিষ্ঠাতা ও সম্পাদক ছিলেন।

পেশাদার সাংবাদিক হিসেবে তিনি ‘ডানপিটে শওকত’, ‘চন্দ্রদ্বীপের উপাখ্যান’, ‘নাম না জানা ভোরে’, ‘নীল যমুনা’, ‘শেষ রজনীর চাঁদ’ ও ‘পলাশী থেকে ধানমন্ডি’র মতো ৩৫টি বই রচনা করেন। তিনি বঙ্গবন্ধুর হত্যাকাণ্ড নিয়ে ‘পলাশী থেকে ধানমন্ডি’ নামের একটি সিনেমাও প্রযোজনা করেন। তিনি ১৯৬৭ সালে বাংলা একাডেমি সাহিত্য পুরস্কার পান। ২০০৯ সালে তিনি স্বাধীনতা পদকে ভূষিত হন। এ ছাড়া তিনি বাংলা একাডেমি পুরস্কার, স্বাধীনতা পদক, একুশে পদক, ইউনেস্কো সাহিত্য পুরস্কার, বঙ্গবন্ধু পদক, সংহতি আজীবন সম্মাননা পুরস্কার পেয়েছেন।

প্রাবন্ধিক আকবর আলি খান

সাবেক তত্ত্বাবধায়ক সরকারের উপদেষ্টা, প্রাবন্ধিক ও কলামিস্ট আকবর আলি খান ০৮ সেপ্টেম্বর রাত ১০টার পর রাজধানীর একটি হাসপাতালে মৃত্যুবরণ করেন।

হঠাৎ তিনি অসুস্থ হয়ে পড়লে তাকে হাসপাতালে নেওয়া হচ্ছিল। সেখানে যাওয়ার পথে অ্যাম্বুলেন্সেই তিনি মারা যান। হাসপাতালে নিয়ে গেলে কর্তব্যরত চিকিৎসক তাকে মৃত ঘোষণা করেন।

১৯৪৪ সালে জন্ম নেওয়া আকবর আলি খান ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়েছেন ইতিহাস, কানাডার কুইন্স ইউনিভার্সিটিতে অর্থনীতি। পিএইচডি গবেষণাও অর্থনীতিতে। আমলা হিসেবে পেশাজীবনের প্রধান ধারার পাশাপাশি চলেছে শিক্ষকতাও। অবসর নিয়েছেন মন্ত্রিপরিষদ সচিব হিসেবে। এরপর দুটো বিশ্ববিদ্যালয়ে শিক্ষকতা করেছেন। তত্ত্বাবধায়ক সরকারের উপদেষ্টা হয়েছিলেন, দায়িত্ব পালনে প্রতিবন্ধকতার মুখে পদত্যাগ করেন।

অবসরের পর তাঁর আবির্ভাব ঘটেছে পূর্ণকালীন লেখক হিসেবে। অর্থনীতি, ইতিহাস, সমাজবিদ্যা, সাহিত্য—বিচিত্র বিষয়ে তাঁর গবেষণামূলক বই পাঠকের কাছে ব্যাপকভাবে সমাদৃত হয়।

শিশুসাহিত্যিক আলী ইমাম

বিশিষ্ট লেখক, শিশুসাহিত্যিক, সংগঠক ও গণমাধ্যমব্যক্তিত্ব আলী ইমাম ২১ নভেম্বর মারা যান। শ্বাসযন্ত্র, নিউমোনিয়াসহ নানা জটিল রোগ নিয়ে ওইদিন বিকেলে রাজধানীর একটি হাসপাতালে চিকিৎসাধীন অবস্থায় তিনি শেষ নিঃশ্বাস ত্যাগ করেন। তাঁর বয়স হয়েছিল ৭২ বছর।

আলী ইমাম ১৯৫০ সালের ৩১ ডিসেম্বর ব্রাহ্মণবাড়িয়ায় জন্মগ্রহণ করেন। তিনি ছয়শরও বেশি বইয়ের লেখক। কর্মজীবনের শেষপ্রান্তে একাধিক স্যাটেলাইট টিভি চ্যানেলের প্রধান নির্বাহী কর্মকর্তার দায়িত্ব পালনের আগে তিনি বাংলাদেশ টেলিভিশন (২০০৪-২০০৬) ও অধুনালুপ্ত চ্যানেল ওয়ানের (২০০৭-২০০৮) মহাব্যবস্থাপক ছিলেন।

১৯৯৮ থেকে ২০০৪ সাল পর্যন্ত তিনি ইউনিসেফের ‘মা ও শিশুর উন্নয়নে যোগাযোগ কার্যক্রম প্রকল্প’ পরিচালক ছিলেন। মিউনিখে অনুষ্ঠিত ‘প্রি জুঁনেসি চিলড্রেনস টিভি প্রোডাকশন প্রতিযোগিতা’র (২০০০) জুরির দায়িত্ব পালন করেন।

তিনি ছিলেন ‘সার্ক অডিও ভিজুয়াল বিনিময় অনুষ্ঠানে’র প্রধান সমন্বয়কারী (২০০০-২০০১)। টেলিভিশন ও বেতারে শিক্ষামূলক অনুষ্ঠানের নির্মাতা ও উপস্থাপক হিসেবে তিনি বিশেষ প্রশংসনীয়।

বাংলাদেশ টেলিভিশনের ‘হ্যালো, আপনাকে বলছি’ (১৯৯৯-২০০৪) নামে তাঁর উপস্থাপিত সরাসরি অনুষ্ঠানটি জনপ্রিয় হয়েছিল। এ ছাড়া বাংলাদেশ টেলিভিশনের প্রামাণ্য শিক্ষামূলক অনুষ্ঠান ‘দেখা হয় নাই চক্ষু মেলিয়া’ (১৯৮০-১৯৮৭) প্রযোজনা করেন।

আলী ইমাম ২০০১ সালে বাংলা একাডেমি সাহিত্য পুরস্কার এবং ২০১২ সালে শিশু একাডেমি শিশুসাহিত্য পুরস্কার পান। শিশুসাহিত্যিক হিসেবে জাপান ফাউন্ডেশনের আমন্ত্রণে ২০০৪ সালে তিনি জাপান পরিভ্রমণ করেন। ১৯৬৮ সালে তিনি তৎকালীন পূর্ব-পাকিস্তান শিক্ষা সপ্তাহে বিতর্ক এবং উপস্থিত বক্তৃতায় চ্যাম্পিয়ন হন। ১৯৮৬ সালে ইউনেস্কো আয়োজিত শিশুসাহিত্য বিষয়ক প্রকাশনা কর্মশালায় অংশ নেন। এ ছাড়া বাংলাদেশ স্কাউটসের প্রকাশনা বিভাগের ন্যাশনাল কমিশনারের দায়িত্ব পালন করেন।

শেয়ার করুন