রাজধানীর সোহরাওয়ার্দী উদ্যানে রাজনৈতিক সমাবেশের কারণে সৃষ্ট শব্দদূষণে বিচারিক কাজে বিঘ্ন ঘটায় ক্ষোভ প্রকাশ করেছেন হাইকোর্ট। সোমবার (২ জানুয়ারি) হাইকোর্টের বিচারপতি মো. আশরাফুল কামাল এ বিষয়ে ক্ষোভ প্রকাশ করেন। এ সময় রাষ্ট্রপক্ষের আইনজীবীকে উদ্দেশ্য করে আদালত বলেন, ‘ঢাকা মেট্রোপলিটন পুলিশের (ডিএমপি) কমিশনার অনুমতি (সমাবেশের) দিয়েছেন কি না খোঁজ নেবেন। এছাড়া তারা অনুমতি দিলেও শুক্র-শনিবার বা সরকারি ছুটির দিনে এই সমাবেশের অনুমতি দিতে পারতো।’
প্রশ্ন তুলে হাইকোর্ট বলেন, ‘দরজা-জানালা বন্ধ থাকার পরও হাইকোর্ট বিভাগের বিজয় ৭১ বভবনের ১০ম ফ্লোরে অবস্থিত আদালতের ভেতরে এত আওয়াজ, আইনজীবীরা কী কথা বলছেন, আমরা কী বলছি, তা ঠিকমতো না শুনলে আমরা বিচার করবো কীভাবে?’
জানা গেছে, সামাবেশের মাইকের উচ্চশব্দে সোমবার হাইকোর্ট বিভাগের বিজয় ৭১ ভবনের ওই বেঞ্চের বিচারকাজ অনেকক্ষণ বন্ধও ছিল। সকালে কোর্ট শুরু হওয়ার একপর্যায়ে বিষয়টি নিয়ে আলোচনা করার জন্য সুপ্রিম কোর্টের রেজিস্ট্রার জেনারেলকে ডেকেছিলেন আদালত। কিন্তু রেজিস্ট্রার জেনারেল সংশ্লিষ্ট কোর্টে উপস্থিত হননি। এজন্যও ক্ষোভ প্রকাশ করেছেন ওই বেঞ্চের বিচারপতি মো. আশরাফুল কামাল।
ডেপুর্টি অ্যাটর্নি জেনারেল আদালতের বরাত দিয়ে বলেন, ‘১০ মিনিটের মধ্যে রেজিস্ট্রার জেনারেলকে আসতে বললেও তিন ঘণ্টা পার হয়েছে, দুপুরের বিরতি পর্যন্ত তিনি (রেজিস্ট্রার জেনারেল) আসেননি।’
আদালত বলেন, ‘এটা দুঃখজনক। আমি দেখেছি ২০১০ সালে রেজিস্ট্রার জেনারেলকে ডাকা মাত্রই ৭-৮ মিনেটের মধ্যে চলে আসতেন। এখন এর ব্যত্যয় দেখা যাচ্ছে। চাইলে রেজিস্ট্রার জেনারেলের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেওয়া যেতে পারে। কিন্তু এরকম আদেশ দিলে বিষয়টি আপনারা অন্যভাবে নেবেন। কার পাওয়ার (ক্ষমতা) নিয়ে রেজিস্ট্রার জেনারেল এরকম করছেন জানি না। কেউ কারও কমান্ড না শুনলে, নিজে কাউকে সম্মান না দিলে একদিন তাকেও অসম্মানিত হতে হবে।’
এ সময় আদালতে উপস্থিত সিনিয়র আইনজীবী অ্যাডভোকেট ইউসুফ হোসেন হুমায়ুনের সঙ্গে বিষয়টি শেয়ার করেন বিচারপতি। তিনি বলেন, ‘আপনি বিজ্ঞ সিনিয়র আইনজীবী, কোর্ট চলাকালে পরিবেশ কেমন থাকা উচিত বলুন।’ তখন ইউসুফ হোসেন হুমায়ুন আদালতকে বলেন, ‘বিচারকাজ নিরবচ্ছিন্ন শব্দদূষণ মুক্ত পরিবেশে হওয়া প্রয়োজন।’ বিচারপতি বলেন, ‘এভাবে চললে আমরা বিচার কীভাবে করবো?’
আদালত বলেন, ‘বিচারকাজ চলার সময় কোর্টের পাশে কীভাবে উচ্চশব্দে সভা-সমাবেশ করার অনুমতি দেওয়া হলো? এটি তারা কি খেয়াল করলো না? যদিও সভা-সমাবেশ করার অধিকার সবারই আছে। তারা কোর্ট ছুটির দিন বা কোর্টের সময়ের পরে এসব সভা-সমাবেশ করতে পারেন। যারা সভা-সমাবেশ করছেন, আমি বলবো তাদের কোনো দোষ নেই। তারা তো অনুমতি নিয়ে করছেন। যারা অনুমতি দিলেন তাদেরকে এ বিষয়টি ভাবা উচিত ছিল।’
আদালত আরও বলেন, ‘স্কুল, কলেজ, হাসপাতাল ও বিশ্ববিদ্যালয়ের পাশে যা ইচ্ছে তাই করা যায় না। আইনে এসব এলাকায় উচ্চশব্দের হর্ন দেওয়াও নিষেধ। অথচ এখানে কোর্ট চলার পর থেকে উচ্চশব্দ শুনছি।’
এসময় ইউসুফ হোসেন হুমায়ুন আদালতকে বলেন, ‘আমি বিষয়টি জানলাম। আপনি যা বলছেন তা সঠিক বলছেন। আমি নিজেও শুনানি করতে গিয়ে বিরক্তিবোধ করছি। এ বিষয়ে আমি উপর মহলকে অবহিত করবো, যেন বিষয়টি দ্রুত সমাধান হয়।’
হাইকোর্ট বিভাগের বিজয়-৭১ কোর্ট ভবনের পাশে উচ্চ শব্দদূষণের কারণে উচ্চ আদালতের বিচারিক কাজে বিঘ্ন ঘটার বিষয়ে মানবাধিকার সংগঠন হিউম্যান রাইটস অ্যান্ড পিস ফর বাংলাদেশ (এইচআরপিবি)-এর চেয়ারম্যান ও সুপ্রিম কোর্টের আইনজীবী মনজিল মোরসেদ বলেন, ‘আদালতের কার্যক্রমে কোনো হস্তক্ষেপ করা যায় না। একবার ভারতের আদালতের উপর দিয়ে বিমান যাওয়ার পর সেই ব্যাপারে সংশ্লিষ্ট কর্তৃপক্ষকে কোর্ট নোটিশ করেছিলেন। এখন আমাদের উচ্চ আদালতের অনেক কোর্ট-ই সোহরাওয়ার্দী উদ্যানের পাশে। সেখানে সবসময় শব্দ হয়। আদালত ক্ষোভ প্রকাশ করুক আর না করুক, আমাদের কাছে মনে হয়েছে এটা ঠিক না।’
‘যদি সভা-সমাবেশ চলেই, সেখানে মাইকগুলোকে পশ্চিমদিকে ঘুরিয়ে দিলে হয়তো শব্দটা কোর্টের দিকে কম আসবে। সাউন্ডের কারণে আদালতের বিচারিককাজে যেন বিঘ্ন না ঘটে।’ বলেন তিনি।
মনজিল মোরসেদ বলেন, ‘সভা-সমাবেশ করা যেহেতু সাংবিধানিক অধিকার, সে কারণে শুক্র-শনিবার বা অন্য সময়ে করেন। সাইন্ড সিস্টেমটা পশ্চিমদিকে ঘুরিয়ে দিলে কোর্টের দিকে শব্দ কম আসবে। সেই জিনিস খেয়াল রাখা।’ মাইকগুলোকে পশ্চিমদিকে ঘুরিয়ে রাখার পাশাপাশি আদালতের দিকে রাখা সাউন্টসিস্টেমের যেন কমিয়ে দেওয়া হয়, সে পরামর্শ দেন তিনি।
সংশ্লিষ্ট কোর্টের ডেপুর্টি অ্যাটর্নি জেনারেল আশেক মোমেন বলেন, ‘শব্দদূষণ নিয়ে কোর্ট একটু অসন্তুষ্ট হয়েছেন। উনি আমাদের বলেছেন, আগে আমরা কোর্টের বারান্দায় হাঁটলেও ভয়ে ভয়ে হেঁটেছি যে, একটু হাঁটার শব্দ হলো কি না, কোনো জজ এটা নোটিশে নিলেন কি না। আর এখন যেটা হচ্ছে, কিছু বললে হয়তো বলবে পারমিশন নিয়ে আসছি। যারা পারমিশন দিচ্ছেন তারা কি একবারও চিন্তা করছে না যে এখানে হাইকোর্ট আছে? এগুলো (সভা-সমাবেশ) ওয়ার্কিং ডে’তে না দিয়ে শুক্র-শনিবার করতে পারতো। অথবা ৪টার পরে দিলে ভালো হতো।’ অনুমতির কপি আছে কি না তা জানার বিষয়টিও তুলে ধরেন তিনি।
তিনি বলেন, সম্ভবত উনি (বিচারপতি) বিভিন্ন ফোরামে আলাপ আলোচনা করবেন কোর্ট খোলার সময় (চলাকালীন) এটা করা যায় না বা এটা উচিত কি না। ওনারা যদি বলেন, না ঠিক আছে, অসুবিধা হয় না। তাহলে তো আর কিছু করার নেই। সার্ভ হচ্ছে। এখানে হাজার হাজার ল’ইয়ার সবাই শুনছেন, প্রবলেম হচ্ছে না? একটা কনসানট্রেশনের (মনোযোগ) ব্যাপার আছে, এখানে একটা মামলা রেডি হয়ে আসলো, দেখা গেলো একটু বিরক্তবোধ করতে গিয়ে ওটা মাথা থেকে চলে গেলো। ন্যাচারালি এটা ক্লায়েন্টদের (বিচার প্রার্থী) ক্ষতি।’
‘এছাড়াও ঘটনাটি অ্যাটর্নি জেনারেলকে জানিয়েছি। এসময় সিনিয়র আইনজীবী ইউসুফ হোসেন হুমায়ুন উপস্থিত ছিলেন, ওনাকে বলা হয়েছে।’ তিনি বলছেন, ‘আসলে আমি খুব কম আসি। শব্দটা তো একটা বিরক্তিকর ব্যাপার। দরজা বন্ধ, এসি রুম, তারপরও যেভাবে আওয়াজ আসছে। সাবমিশনটা তো ঠিকমতো করতে পারছি না বা কোর্ট কী বলছে সেটাও ঠিকমতো বোঝা যাচ্ছে না। এটা তো অমার্জিত ব্যাপার। কোর্ট রেজিস্ট্রার জেনারেলকে ডেকেছেন। সাড়ে ১০টার দিকে ডেকেছে, বাট উনি দুপুর ১টা পর্যন্ত আসেননি। এই যে তিন ঘণ্টা পেরিয়ে গেলো উনি এখনো আসা দরকার মনে করলেন না। এখন আমি ওনাকে পানিসমেন্ট দিতে পারি, তখন তো বলা হবে আমি অতিরিক্ত করে ফেলেছি। এখন উনি এটা করলেন কাদের বদৌলতে, কাদের স্বার্থে। আমরা কোথায় যাচ্ছি, অধঃপতন।’
ওই আদালতে শুনানি করতে যাওয়া অপর আইনজীবী অ্যাডভোকেট ফারুক হোসেন বলেন, ‘আমার একটি মামলা নিয়ে এই কোর্টে এসেছিলাম। বিচারপতি যখন একটি মামলা শুনানির জন্য প্রস্তুতি নিলেন, তখন প্রচণ্ড শব্দ আসে কোর্টের ভেতরে। দরজা বন্ধ করে দেওয়া হয়, এরপরও উচ্চশব্দ আসে সবার কানে। আদালত তখন ক্ষোভ প্রকাশ করেন। রেজিস্ট্রার জেনারেলকে তলব করেছেন। আদালতে বিচারকাজ চলার সময় আশপাশে এভাবে সভা-সমাবেশ চলতে পারে না। বেশ কিছুদিন ধরে এভাবে সভা-সমাবেশের শব্দের কারণে বিচারকাজ বিঘ্ন হচ্ছে।