গ্লোবাল এডুকেশন মনিটরিং রিপোর্ট-২০২২ প্রকাশ করেছে ইউনেসকো। প্রতিবেদনে বাংলাদেশের শিক্ষাব্যবস্থা বিষয়ে বলা হয়েছে, ‘বাংলাদেশে ছেলেমেয়েদের শিক্ষা বাবদ ব্যয়ের ৭১ শতাংশই বহন করতে হয় পরিবারকে। এনজিও বা বেসরকারি স্কুলের ফি ও ব্যয় সরকারি প্রতিষ্ঠানের তুলনায় তিনগুণ। বেসরকারি কিন্ডারগার্টেনের ক্ষেত্রে এ ব্যয়ের পরিমাণ প্রায় নয়গুণ।’ তবে ইউনেসকোর এ প্রতিবেদনের সঙ্গে একমত নন শিক্ষামন্ত্রী ডা. দীপু মনি।
তিনি বলেন, সারাদেশে ২০ হাজার বেসরকারি স্কুল-কলেজ রয়েছে। এর মধ্যে ১৮ হাজারের বেশি এমপিওভুক্ত। বাকি প্রায় ২ হাজার ননএমপিও প্রতিষ্ঠান। এমপিওভুক্ত প্রতিষ্ঠানের ৮০ শতাংশ খরচ (বেতন-ভাতা ও অন্যান্য) সরকারিভাবে অনুদান দেওয়া হয়ে থাকে। এর বাইরে শিক্ষক প্রশিক্ষণ, শিক্ষার্থীদের বৃত্তি-উপবৃত্তি, বিনামূল্যে বই বিতরণ করা হয়ে থাকে।
মঙ্গলবার (৩ জানুয়ারি) রাজধানীর একটি হোটেলে ইউনেসকোর ‘গ্লোবাল এডুকেশন মনিটরিং রিপোর্ট ২০২২’ প্রকাশ অনুষ্ঠানে এ তথ্য জানান শিক্ষামন্ত্রী।
ডা. দীপু মনি বলেন, স্কুল ভর্তির ক্ষেত্রে হয়রানি ও যুদ্ধ বন্ধ করতে আমরা লটারি পদ্ধতি চালু করেছি। গত দুই বছর ধরে লটারির মাধ্যমে সরকারি-বেসরকারি স্কুলে ভর্তি করা হচ্ছে। ভর্তি পরীক্ষায় এক ধরনের যুদ্ধ তৈরি হয়। এর মাধ্যমে শিশুদের মনে আঘাত আসলেও অভিভাবকরা সে বিষয়ে নজর দিতেন না। এসব বিবেচনা করে এখন ভর্তি প্রক্রিয়া ডিজিটাল লটারির মাধ্যমে আনা হয়েছে।
তিনি বলেন, সরকারি মাধ্যমিক স্কুলে ভর্তির জন্য বড় ধরনের চাপ থাকে। বেসরকারিতে মোট আসনের অনেক কম আবেদন ছিল। অথচ সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ে সুন্দর ভবন, বড় অবকাঠামো ও প্রশিক্ষিত শিক্ষক থাকলেও সেখানে ভর্তির জন্য আগ্রহ কম থাকে।
ইউনেসকোর প্রতিবেদনে এমপিওভুক্তিতে অনিয়ম-দুর্নীতির কথা তুলে ধরা হয়েছে। এ বিষয়ে শিক্ষামন্ত্রী বলেন, গত দুই বছর ধরে এ খাতে কোনো অনিয়ম হয়নি। যোগ্য প্রতিষ্ঠানগুলোকে এ সুবিধার আওতায় আনা হয়েছে। বেসরকারি শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান এমপিওভুক্তির আওতায় এনে সেগুলোকে নিয়মিত মনিটরিং করা হচ্ছে। কেউ পিছিয়ে গেলে তাকে সহযোগিতা করে এগিয়ে আনা হচ্ছে। বারবার চেষ্টার পরও যদি কেউ পিছিয়ে পড়ে তবে তার বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নিচ্ছি।
তিনি বলেন, ২০০৯ সালে আমরা সবাইকে স্কুলে আনার প্রতি জোর দিয়েছিলাম। ২০১৮ সাল থেকে শিক্ষার মানের দিকে গুরুত্ব দেওয়া হচ্ছে। কোন স্তরে কী ধরনের মান হওয়া প্রয়োজন তা নিয়ে আমরা কাজ শুরু করেছি। তার আলোকে নতুন কারিকুলাম তৈরি করা হয়েছে। চলতি বছর থেকে সেটি কার্যকর করা হচ্ছে। আগামী তিন বছরের মধ্যে মাধ্যমিক স্তরের সব ক্লাসে সেটি বাস্তবায়ন করা হবে। করোনায় অনেক শিশুর মধ্যে মানসিক আঘাত তৈরি হয়েছে। এ অবস্থায় শিশুদের মানসিক সুস্থতায় সারাদেশের দুই লাখ শিক্ষককে প্রশিক্ষণ দেওয়া হয়েছে।
বিগত ১২ বছর ধরে শিক্ষা আইন ঘোরাফেরা করলেও সেটি চূড়ান্ত হয়নি উল্লেখ করে মন্ত্রী বলেন, মন্ত্রিপরিষদ থেকে সংশোধন দিয়ে আমাদের কাছে পাঠালেও সেটি করে আমরা আবারও পাঠিয়ে দেই। নতুন করে আবারও কিছু সংশোধন করতে পাঠানো হয়েছে। সেটি করে ফের পাঠানো হবে। আমাদের শেখার পদ্ধতিতে ভুল আছে বলেই ১২ বছর ইংরেজি পড়লেও শিক্ষার্থীরা তা সঠিকভাবে শিখতে পারছে না। এ অবস্থায় পড়ানোর পদ্ধতিতে পরিবর্তন আনা হচ্ছে।
অনুষ্ঠানে ব্র্যাক বিশ্ববিদ্যালয়ের ব্র্যাক বিশ্ববিদ্যালয়ের ইমেরিটাস অধ্যাপক ড. মনজুর আহমেদ বলেন, ইউনেসকোর গ্লোবাল এডুকেশন মনিটরিং রিপোর্টে শিক্ষায় লিঙ্গ বৈষম্যের বিষয়টি উঠে এসেছে। অর্থনৈতিক সক্ষমতার কারণে শিক্ষার চাহিদা বৃদ্ধি পেলেও মানের দিক থেকে অনেক পিছিয়ে রয়েছে। সবার কাছে শিক্ষার সমান সুযোগ তৈরি করতে অনেক বড় চ্যালেঞ্জ রয়েছে সরকারের।
বিশ্ববিদ্যালয় মঞ্জুরি কমিশনের সদস্য অধ্যাপক ড. বিশ্বজিৎ চন্দ্র বলেন, প্রাইভেট বিশ্ববিদ্যালয়ে শিক্ষকদের জবাবদিহিতা থাকলেও পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয় স্বায়ত্তশাসিত হওয়ায় সেখানে এর গুরুত্ব নেই। সব বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষকদের জবাবদিহিতা থাকা প্রয়োজন। এমপিওভুক্তির মতো বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়ে সরকারি অনুদান দেওয়া যায় কি না তা ভেবে দেখার আহ্বান জানান তিনি।
গণসাক্ষরতা অভিযানের নির্বাহী পরিচালক রাশেদা কে চৌধুরী বলেন, ভারতে বিকেন্দ্রীকরণ হওয়ায় দিল্লিতে ৯০ শতাংশ সরাকারি আর ১০ শতাংশ বেসরকারি শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান রয়েছে। দিল্লির সরকারের ক্ষমতায় ৯০ শতাংশ শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান সরকারি করা সম্ভব হয়েছে। বাংলাদেশের সরকারকেও সে পথে হাঁটার আহ্বান জানান তিনি।
অনুষ্ঠানে আরও বক্তব্য দেন- ইউনেসকোর পরিচালক ড. মানষ এনটোনেস, ব্র্যাকের চেয়ারপার্সন ড. হোসেন জিল্লুর রহমান, মাধ্যমিক ও উচ্চশিক্ষা অধিদপ্তরের মহাপরিচালক অধ্যাপক নেহাল আহমেদ প্রমুখ।